মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন কাসেমী :
ইমাম আযম হযরত আবু হানিফা রহ. কোনো এক মজলিসে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি দেখলেন, একটি লোক ছেঁড়াফাঁড়া কাপড় পরিধান করে রয়েছে। তিনি লোকটিকে বসে থাকতে বললেন। মজলিস শেষে অন্যান্য লোকজন যার যার গন্তব্যে চলে গেল। তখন তিনি লোকটিকে বললেন, জায়নামাযের নিচে যা কিছু আছে নিয়ে নিজ প্রয়োজনে ব্যয় কর। লোকটি জায়নায উঠিয়ে দেখল একহাজার রৌপ্য মুদ্রা রয়েছে। লোকটি সেগুলো নিয়ে তার শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে করতে চলে গেল। [আল-ইলমু ওয়াল ওলামা- ৩০৬]
একবার হযরত ইবরাহিম ইবনে উয়ায়না রহ. ঋণের কারণে বন্দি হলেন। হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ. এটা জানতে পেরে তার সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে তাকে মুক্ত করেন। উক্ত ঋণের পরিমাণ ছিল চার হাজার দিরহামের অধিক। [আল-ইলমু ওয়াল ওলামা- ৩০৬]
ইসমাইল ইবনে হাম্মাদ রহ. বলেন : যখন ইমাম আবু হানিফা রহ. -এর পুত্র হযরত হাম্মাদ স্বীয় উস্তাদের নিকট সূরা ফাতিহা পাঠের যোগ্য হলেন তখন তিনি তার উস্তাদের নিকট ৫০০ দিরহাম, অপর বর্ণনামতে ১০০০ দিরহাম হাদিয়া প্রেরণ করেন। উস্তাদ মহাশয় এ দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন, আমি এমন কী কাজ করেছি যার বিনিময় এ বিশাল অংকের অর্থ আমাকে হাদিয়া দেওয়া হল? পরে ইমাম সাহেব রহ. এ কথা জানতে পেরে নিজে উক্ত শিক্ষকের নিকট গমন করে বিনয়ের স্বরে বললেন, “জনাব! আপনি আমার ছেলেকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তাকে সাধারণ মনে করবেন না। আল্লাহর শপথ! বর্তমান আমার নিকট যদি এর অতিরিক্ত দিরহাম থাকত তাহলে তাও আপনার খেদমতে পেশ করতাম। [উকুদুল জিমান : ২৩৩]
ব¯ুÍত একেই বলে বদান্যতা এবং পবিত্র কুরআনের সম্মান দান। এসব গুণের ফলেই আল্লাহ তাআলা ইমাম আজমকে মাকবুলিয়্যতের উচ্চশিখরে অধিষ্ঠিত করেছেন।
হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ. -এর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল- যা অন্য কারো মাঝে পাওয়া একেবারেই বিরলÑ তা হচ্ছে তিনি সমকালীন উলামায়ে কেরামকে প্রচুর পরিমাণ হাদিয়া-তোহফা দিতেন। তাদের জরুরত ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন।
তাঁর একটি বিশেষ অভ্যাস এই ছিল, তিনি উলামা-মাশায়েখকে হাদিয়া দেয়ার উদ্দেশ্যে বাগদাদে ব্যবসার মাল পাঠাতেন। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতেন। এ ব্যবসায় যা মুনাফা হতো তা বিশিষ্ট উলামা-মাশায়েখ ও মুহাদ্দিসগণের জন্যে সারা বছর সঞ্চয় করতেন। অতঃপর তা দ্বারা তাদের বাৎসরিক খরচ, পোশাকাদি, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি কিনে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। এরপর মুনাফার কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকলে তা নগদ অর্থরূপে তাদের কাছে প্রেরণ করতেন। সাথে সাথে একথাও বলতেন যে, “এর দ্বারা নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মিটাবেন। আর আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কারো শুকরিয়া জ্ঞাপন করবেন না। কারণ, আমি আমার নিজের কোনো সম্পদ আপনাদেরকে দিই না। বরং এসব আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ। এসব আপনাদের সম্পদের মুনাফা। আল্লাহর শপথ! এ কেবল আল্লাহ তাআলা আমার মাধ্যমে আপনাদের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছেন; এর বেশিকিছু নয়।” [উকুদুল জিমান : ২৩৩]
মিসআর ইবনে কুদাম রহ. থেকে বর্ণিত আছে, ইমাম আবু হানিফা রহ. এর অভ্যাস ছিল যে, যখনই তিনি নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য কিছু ক্রয় করতেন তখন ওই পরিমাণ উলামায়ে কেরামের জন্যও কিনতেন। যখন কোনো পোশাক বানাতেন তখন উলামা মাশায়েখের জন্যও বানাতেন। এমনকি ফল-ফলাদি কিনলেও তখন বিশিষ্ট কোনো বুযুর্গ আলেমের জন্য ক্রয় করে আগে হাদিয়া পাঠাতেন। তারপর নিজের এবং পরিবারের জন্য কিনতেন। [উকুদুল জিমান- ২৩৪]
সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না রহ. বলেন, হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ. খুব বেশি দান-খয়রাত করতেন। একবার তিনি আমার নিকট এ পরিমাণ হাদিয়া প্রেরণ করেন যে, এতো অধিক সম্পদ আমার নিকট পছন্দ হল না। আমি ইমাম সাহেব রহ. -এর কোনো কোনো শিষ্যের নিকটও এ বিষয়টি প্রকাশ করলাম। তখন তারা বললেন, এটা তো সাধারণই। ইমাম সাহেব হযরত সাইদ ইবনে আরুবার উদ্দেশ্যে যা প্রেরণ করেছেন তা যদি আপনি দেখতেন তাহলে আপনাকে প্রদত্ত এ হাদিয়ার ব্যাপারে বিস্মিত হতেন না। [উকুদুল জিমান- ২৩৪]
ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ. নিজের পরিচিত লোকজনের ওপর অনেক বেশি পরিমাণে খরচ করতেন। কখনো কাউকে পঞ্চাশ দিনার দিয়ে দিতেন; অতঃপর ওই ব্যক্তি মানুষের সামনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাইলে তিনি খুব রেগে যেতেন। তিনি বলতেন, ভাই! আল্লাহ তাআলার শোকরিয়া-কৃতজ্ঞতা আদায় কর। এ রিজিক তোমার কাছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এসেছে। [উকুদুল জিমান- ২৩৫]
ইমাম আবু ইউসুফ রহ. স্বয়ং নিজের সম্পর্কে বলেন, আমার উস্তাজ হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ. আমার ও আমার পরিবারের খরচ চালিয়েছেন লাগাতার দশ বছর। আমি তার থেকে উত্তম গুণাবলির অধিকারী আর কাউকে দেখি নি। [উকুদুল জিমান- ২৩৫]
হাসান ইবনে সুলাইমান রহ. বলেন : আমি ইমাম আবু হানিফা রহ. এর চাইতে অধিক দানশীল কাউকে দেখিনি। তিনি নিজ শিষ্যদের প্রত্যেকের মাসিক ব্যয়ভার নিজেই বহন করতেন। আর বাৎসরিক হাদিয়া তোহফা এ থেকে ভিন্ন ছিল। [উকুদুল জিমান- ২৩৫]
আব্দুল্লাহ ইবনে বকর সাহমি রহ. বলেন, একবার মক্কা শরিফ গমনকালে পথিমধ্যে আমার উটের মালিকের সাথে ভাড়ার ব্যাপারে বাদানুবাদ হল। আমাদের এ কাফেলায় ইমাম আবু হানিফাও ছিলেন। উটের মালিক উক্ত ব্যাপারে সিদ্ধান্তের জন্য আমাকে ইমাম সাহেব রহ. -এর নিকট নিয়ে গেল। তিনি আমাদের উভয়ের বক্তব্য শুনলেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের আসল ঝগড়া কী পরিমাণের ব্যাপারে বলো? উটের মালিক বলল ৪০ দিরহামের ব্যাপারে। তখন ইমাম সাহেব রহ. বললেন, মানুষ থেকে মানবতা একেবারেই বিদায় নিয়েছে। (মাত্র ৪০ দিরহামের ব্যাপারেও ঝগড়া হচ্ছে?) এ কথা বলে তিনি নিজের পকেট থেকে ৪০ দিরহাম বের করে উটের মালিককে দিয়ে দিলেন। [উকুদুল জিমান- ২৩৭]