বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৫:৫৪
Home / কওমি অঙ্গন / কওমি মাদরাসা; দার্শনিক ভিত্তি ও অবদান (শেষ)

কওমি মাদরাসা; দার্শনিক ভিত্তি ও অবদান (শেষ)

মুসা আল হাফিজ
কবি কলামিস্ট ও গবেষক

পাশ্চাত্যে শিক্ষা
পাদ্রীতন্ত্রের জনক মহামতি পোপ গ্রেগরি যখন ‘অজ্ঞানতা ধ্যানের জনক’ মন্ত্রের প্রয়োগ করে রোম নগরীর সর্বপ্রকার জ্ঞানচর্চার উপকরণ ধূলিস্যাত করে শিক্ষার নাম নিশানা মুছে দিয়েছিলেন, সম্রাট সিজারের প্রতিষ্ঠিত পেলাটাইন গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন এবং জ্ঞান চর্চার উপর কড়া বিধি নিষেধ আরোপ করেছিলেন, তিনি গ্রিস ও রোমের প্রাচীন রচনা পাঠ নিষিদ্ধ করেছিলেন, আর গোড়া ধর্ম সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলো।

রোম, গ্রীক কার্তেজ পারস্য জগতে যখন বিদ্যা শিক্ষার বালাই ছিলো না, তখন ইউরোপের উপকন্ঠে মুসলামানরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে যাচ্ছিলেন। যেগুলো কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ছিলো ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় হতে শ্রেষ্ট।

আর এরই মাধ্যমে ইউরোপ সভ্যতার আলো দেখতে পায়। এটা অত্যান্ত স্পষ্ট যে স্পেনের আরবরাই পশ্চিমা ইউরোপে আধুনিক শিক্ষার মৌলিক মূল।
ইউরোপ রেঁনেসার আগে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠে মাদরাসার মাতো উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং তাদের কারিমুলামের আদলে। যদিও সে সব প্রতিষ্ঠানে ধর্ম প্রাধান্য বিস্তার করতো। অন্য বহু বিষয়ও তাতে অন্তর্ভূক্ত থাকতো।

এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হলো, এর সাথে হয়েছিলো ১১০০-১২০০ সালে লেখাপড়ার পূন:প্রবর্তন, যা এসেছিলো মুসলিম সিসিলি ও আরব স্পেন থেকে জেরুসালেম থেকে ফেরত এক তীর্থযাত্রী পশ্চিম ইউরোপে-প্যারিসে প্রথম একটা কলেজ তৈরি করেন ১১৩৮ সালে। কাক্সফোর্ড বেলিওল কলেজও তেমনি। সেই সময় ইউরোপীয় শিক্ষা প্রতিষ্টান ও মাদরাসার শিক্ষা পদ্ধতি ও ক্যারিকুলাম একই প্রকারের ছিলো। ইউরোপে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় জনকেলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়। তা প্রতিষ্ঠার আগেই ইউরোপে এসে গেছে ইসলামি পদ্ধতি… পশ্চিমা নানাভাবে ঋনি আরব ও ইসলামের কাছে। আর তা শুধু প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে নয়। ঋনী শিক্ষার সংগঠনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ক্যারিমুলামে, ইউরোপে যখন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, মুসলিম স্পেনের কর্ডোভা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় তখন গৌরবের চূড়ায় অবস্থান করছে। সেই শহরে রয়েছে জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন লাইব্রেরি। এর মধ্যে একটি লাইব্রেরির বইয়ের তালিকার নাম সূচি। অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়ে চীন থেকে সমরকন্দে প্রথম কাগজ আমদানি করা হয়। সমরকন্দে তৈরি কাগজ ছিলো সবার সেরা। মুসলমানগণ ৭০৪ সালে সমরকন্দ দখল করেন। অষ্টম শতকে শেষে হবার অনেক আগেই বাগদাদে কাগজের কল স্থাপিত হয়। পরবর্তিতে আরো অনেক কাগজের কল তৈরি হয় এদিকে সেদিকে। ৯০০ সালের আগেই মিশরে ১১০০ সালের কাছাকাছি মরক্কোতে ১১৫০ সালের দিকে স্পেনে কাগজের কল স্থাপিত হয়। মুসলিম অধ্যুষিত স্পেন ও ইতালি থেকে বারো তেরো শতকে কাগজে তৈরির প্রক্রিয়া ইউরোপে প্রবেশ করে।

মুসলিম অধ্যুষিত স্পেনের কলেজগুলোর প্রধান গেটের যে লিপিগুলো সব সময় নজরে পড়তো, তা হলো; চারটি বস্তু পৃথিবীকে ধারণ করে আছে। জ্ঞানী বিদ্যা, ভালোজনের সুবিচার, সত্যান্বেষীর প্রার্থনা আর সাহসীজনের শক্তি। শিক্ষাকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়ার অনুপ্রেরণা মুসলমানদের কাছে থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। আরবীয় শক্তিমত্তা পশ্চিমা মানসিকতার গভীরে রেখাপাত করলে সে ছোয়া বেশিদিন টিকে থাকেনি। কিন্তু মুসলমানদের জ্ঞান ও মণীষা পাশ্চাত্য চিন্তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে।

পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান ও দর্শনের জাগরণ

প্রাচীন জগত ছিলো প্রাক বৈজ্ঞানিক গ্রীকদের জ্যেতির্বিদ্যা ও গণিত শাস্ত্র ছিলো বিদেশ থেকে আমদানি করা। এগুলো আবার গ্রীক সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ হতে পারেনি। গ্রীকগণ পদ্ধতিকরণ কতগুলো দৃষ্টন্ত থেকে সাধারণ শ্রেণিবদ্ধকরণ এবং হির্ডারি গঠনে নিপুন ছিলো। কিন্তু ধৈর্য সহকারে অনুসন্ধান পদ্ধতি পরিক্ষণ নিরীক্ষণ পদ্ধতি এবং গুণত শাস্ত্রেও অগ্রতির ফলে ইউরোপেই বিকাশ লাভ করে। সেই মন ও পদ্ধতি ইউরোপকে সরবরাহ করেছিলো আরবগণ।

আরবদের এ বিজ্ঞান চেতনার মূল কী? রোম ল্যান্ডোর বয়ান শুনুন- আল্লাহর সৃষ্ট জগতকে গভীরভাবে উপলব্দী করার বসনা বস্তুগতকে আত্মিক জগতের মতোই গুরুত্বদান আরব মানে বাস্তবতাবাদ এবং অদম্য কৌতূহল। ইসলামে ধর্ম এবং বিজ্ঞান আলাদা পথ ধরে অগ্রসর হয়নি। বস্তুত প্রথমটা দ্বিতীয়টারকে সাহস যুগিয়েছে।

এটা অনস্বীকার্য যে মুসলিমগণ পাশ্চাত্যের মতো বিজ্ঞানকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয়নি। বস্তুত ইসলামই বিশ্বকে নিয়ে কগবেষণার সাহস যুগিয়েছে তাকে। খৃষ্টান জগতের বিজ্ঞান ও ধর্মেও সংঘর্ষ এখানে ছিলো না। ধর্মীয় আবেগ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানো হতো। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের অনেকেই একেবারে অন্যায়ভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের গ্রীকদেও শিষ্য হিসেবে অভিহিত করেন। তারা মুসলামনদের বিজ্ঞান চেতনার মূল হিসেবে গ্রীকদের কৃতিত্ব দেন। বেরন ডি ভাক্স তার বিখ্যাত দি লিগগসি অব ইসলাম গন্থে মুসলমানদেও অবদানের কথা স্বীকার করলেও তাদেরকে প্রাচীন গ্রীকদের অনুসরণকারীর অধিক মর্যাদা দেননি।

বার্ট্রার্ড রাসেল নিজেই আবার কবুল করেছেন- আরবদের সময় পর্যন্ত বিজ্ঞান দু ধারায় বিকাশমান ছিলো। ১. আমাদেরকে এর যোগ্য করে তোলা যে আমরা বস্তুকে জানবো। ২. আমাদেরকে বস্তুনিচয় ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা। আর্কিমিডিসের একমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রীকদের আকর্ষণ ছিলো কেবল প্রথম ধারার প্রতি। বস্তুত এ এক সিদ্ধ সত্য যে, প্রাচীন গ্রীসের যা কিছু কীর্তি উন্নতি তার সবই দর্শন ও শিল্পকলার এলাকাতেই সীমাবদ্ধ।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অবদান এতাই অপ্রতুল যে আর্কিমিডিসের শহরতলীর বালুকাবেলায় কোন জটিল জ্যামিতিকে সমস্যায় মগ্ন অবস্থায় এক রোমান সৈন্য যাকে হত্যা করেছিলো। একমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রীস আর কোন বৈজ্ঞানিক সন্তান প্রসব করতে পারেনি। খৃষ্টপূর্ব সমগ্র পাশ্চাত্যে প্রবল প্রতাপ নিয়ে রোপ ছিলো এ সমৃদ্ধ সভ্যতা। কিন্তু জ্ঞান ও বিজ্ঞান বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস অনুসন্ধানকারীদের কাছে রোম এক অন্ধকার এলাকার নাম। বস্তুত রোমান সভ্যতা সীমাহীন শক্তি অর্জন করেছিলো। সমরবিদ্যা ও এর প্রয়োগ সাধনে লাভ করেছিলো প্রকৃত উন্নতি। উপরন্তু গ্রীকদের বিপুল জ্ঞানের উত্তরাধিকার তার পেয়েছিলো সরাসরি অতি সহজে। কিন্তু এরপও রোমান সভ্যতা হাজার বছরের আয়ুস্কালে একজন বৈজ্ঞানিক ও জন্ম দিতে পারেনি।

প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং চেতনায় ইউরোপে আমরা যাকে বিজ্ঞান বলে থাকি, বিজ্ঞান অনুসন্ধানের সেই নবচেতনা নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি এবং অংকশাস্ত্রেও উন্নয়ন পরিমাণ পদ্ধতি প্রভৃতি গ্রীকদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলো। ইউরোপে এই নবচেতনা ও পদ্ধতি আরবরাই প্রবর্তন করেছিলো।
আজকের জগতকে রূপান্তরিত করেছে সেই মুসলিম গবেষণাপদ্ধতি, যা ইউরোপে অনুপ্রবেশ করেছে। মুসলিমগণ অনসন্ধানের নতু নতুন ক্ষেত্র খুলেছে। তারা ধৈর্য সাহস মুক্ত সন এবং বাস্তবমুখী প্রজ্ঞা নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছে। শ্রদ্ধাভাজন কতৃত্বের চাপ যেমন টলেমির তাদেরকে ভিত করেছে। তারা সব সময় একটা থিউরিকে নিয়ে পরীক্ষা চালাতে আগ্রহী ছিলো। পরীক্ষণ নিরীক্ষণ কাজে তারা কোন দিন ক্লান্ত হয়নি। তারা তাদেও ধর্মীয় চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলো। কিন্তু কোন গোঁড়ামি তাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কলা বিজ্ঞানের কর্ষণে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রত্যক শহর অন্য শহরকে অতিক্রম করার চেষ্টা করতো। প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও প্রধানেরা সুলতানের অনুসরণ করতেন। বিশ্বেও প্রত্যক জায়গা থেকে শিক্ষার্থী ও গবেষক আরব্য পন্ডিত ও বিশেষজ্ঞদেও বাণী শবণের জন্য কর্ডোভা বাগদাদ ও কায়রোতে ভিড় জমতো। এমনকি খৃষ্টানগণ ইউরোপে সুদূর প্রত্যান্ত সীমা থেকে মুসলানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে বিদ্যা লাভের জন্য আসতো।

এভাবে ইসলামি সভ্যাতার আলো সিসিলি স্পেন হয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিলো সমগ্র ইউরোপজুড়ে। ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠলো অন্ধাকর ইউরোপ। অনেক অগ্রসর ইউরোপ এটা বুঝলো এই যোগাযোগের ফলে। তারপর যখন এই সত্য উপলদ্ধি করতে পারলো, ল্যাটিন ভাষায় মুসলিম গ্রন্থ সম্ভার অনুবাদ করে মুসলমানদের সাথে সংযোগকে তারা আরো প্রগাড় করে তুললো।

ব্রিটিনিকার নিবন্ধকার লিখেছেন, এই সময় মুসলমানদের কাছে লক্ষাধিক জ্ঞান সমৃদ্ধ বহু পাঠাগার ছিলো। অনুবাদের মাধ্যমে এগুলো ইউরোপের হাতে চলে আসে। ইউরোপে রেঁনেসা সংগঠনের পিছনে এগুলোই ছিলো সক্রিয় বারুদ। গুস্তাভেলবা, রবার্ট ব্রিফল্ট, ডি এইস রবার্টস, ম্যান্ডোর মতো সত্য সন্ধানী বহু গবেষক এখন স্পষ্টভাবে কবুল করেছেন যে আরবদের গবেষণা ও আবিস্কারের বদৌলতে বিজ্ঞানময় আধুনিক যুগের সূচনা ইউরোপ করতে পেরেছিলো। মুক্ত জ্ঞান চর্চার পরিবেশে পৃথিবীর প্রতি ইসলামি শিক্ষার উপহার। প্রকৃতির গবেষণা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানব মেধা ও আচরণ সম্পূর্ণ স্বাধীন। ইসলামের ঘোষণা ছিলো এমনই উদার। এর ফলে মুক্ত জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। এই স্পন্দন প্রথমে মক্কাতে সূচিত হলেও ক্রমশ মদিনা সিরিয়া বাগদাদ সিসিলি ইটালি ঘুরে সমগ্র ইউরোপ বরং সমগ্র বিশ্বে তার প্রতি স্পন্দন ছড়িয়ে পড়লো। সূচিত হলো যাকে বলে, আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্পসমৃদ্ধ যুগ। প্রগতির যাত্রাপথে সবচে বড় বাধা, চিন্তানৈতিক প্রতিবন্ধকতা থেকে মানবমেধাকে মুক্ত করা এবং প্রগতিশীল যুগের বাস্তব সূচনা, আধুনিক সভ্যতায় এই ছিলো ইসলামি শিক্ষার সবচে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। -আওয়ার ইসলামের সৌজন্যে

পূর্বের পর্ব পড়ুন : কওমি মাদরাসা; দার্শনিক ভিত্তি ও অবদান ২

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...