মুসা আল হাফিজ কবি
কলামিস্ট ও গবেষক
দার্শনিক অঙ্গীকার
অঙ্গীকারের এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং এখান থেকে আমরা আলোচনাকে সামনের দিকে নিতে পারি। আমরা দেখবো অতীতে মাদরাসা বিশ্বসভ্যতার কোন কোন দারিদ্র্যকে দূর করতে চেয়েছে এবং কোন দানে তাকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছে। এ বিষয়টাকে ভালোভাবে ধরতে পারলে কওমি মাদরাসা আজ কি করতে পারে ও কি করছে, মানবতার কোন কোন দারিদ্র দূরীকরণ তার কাজ, এ ক্ষেত্রে সে কী করবে এবং কীভাবে করবে, তা উদঘাটন সহজ হবে। আমরা বিশ্বসভ্যতায় মাদরাসা শিক্ষার মৌলিক অবদান চিহ্নিত করতে পারি দর্শন ও শিক্ষার কয়েকটি ক্ষেত্রে।
প্রথমত: মানুষ নিজের সাথে কীরূপ সম্পর্ক রাখবে, এ সম্পর্কে ভারসাম্যপূর্ণ ও সত্যিকার কোনো দার্শনিক সমাধান কোনো শিক্ষব্যবস্থায় ছিলো না। গ্রীক বা রোমান শিক্ষা ও দর্শন মানুষের মর্যাদাময় পরিচয় এবং তার উৎস, উদ্দেশ্য ও গন্তব্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত ছিলো। এ বিভ্রান্তির ফলে মানুষ নিজের সাথে কিরূপ সর্ম্পক রাখবে, এটা নির্ণয়েও গুরুতর ভ্রান্তির কবলে পড়ে। ভারত, চীন বা আফ্রিকার যে সব প্রথাগত শিক্ষার ছিটে ফোটা ছিলো, সেখানে মানুষের সত্তাগত পরিচয় ও অস্তিত্বের মৌলিক এ ব্যাপারটি কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি। কোনো কোনো দর্শন মানুষের দেহ সত্তাকেই দেখেছে এবং ভুল করেছে। কোনো কোনো দর্শন কেবল আত্মাকেই স্বীকার করেছে এবং হোঁচট খেয়েছে। কেউই সম্পূর্ণ ও যথাযথভাবে জীবনকে উপলব্ধিই করতে পারেনি, শিক্ষাব্যবস্থায় এর পূর্ণ দার্শনিক রূপরেখা মাদরাসাই দাঁড় করাতে সক্ষম হলো। মানবসভ্যতা মানুষের মর্যাদাময় পরিচয়, প্রকৃতি এবং আত্মাও দেহের সুষম, সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশের নিশ্চয়তা পেলো। তার সামনে খুলে গেলো মহিমান্বিত জীবনবোধের বাস্তবিভিত্তিক রাজতোরণ।
দ্বিতীয়ত: মানুষ মানুষের সাথে কি রূপ সম্পর্ক রাখবে, এ বিষয়টা উন্নত সভ্যতা গঠনের মৌলিক এক দার্শনিক সমস্যা। এ বিষয়টিতে বিচ্যুতি হলে সমাজও সভ্যতায় বিপর্যয়ের দরোজা খোলে যাবে। মাদরাসা শিক্ষা পৃথিবীর কাছে ইসলামি মোয়ামালা ও মোয়াশারাতের রূপরেখায় এমন এক মানবিক সম্পর্ক কাঠামো উপস্থাপন করলো, যার আগে এর কোন নজির ছিলো না, পরেও কোন বিপল্প কাঠামো কেউ দাঁড় করাতে পারেনি। পশ্চিমা দর্শনে যে রূপরেখা লক্ষ্যণীয়, তা বস্তবাদ ও প্রবৃত্তিপূজার মানসিকতাকে পরিপুষ্ট করে। সেখানে মানবিক মহাত্মের কিছু পদচ্ছাপ থাকলেও তা মূলত ইসলামি রূপরেখার বিকৃত অনুকরণ।
কিন্তু এ অনুকরণের প্রভাবে আধুনিক সভ্যতা যে প্রাণশক্তির অধিকারী হয়েছে, তা এক কথায় অসাধারণ। এরই ফলে জামালুদ্দীন আফগানী রাহ. বলেছিলেন, পশ্চিমারা মুসলমান না হলেও তাদের মোয়ামালাত ও মোয়াশারাতে কলুষতার পর্দা ছিড়ে ইসলামের ঝলকে ফুটে উঠতে দেখেছি। অথচ ইসলামি শিক্ষার সংশ্রব পাওয়ার আগে যেভাবে ভারতবর্ষের মানুষ মানুষের সাথে সম্পর্ক বিষয়ে ভয়ানক বর্ণবাদ প্রথার শিকার ছিলো, তেমনি ইউরোপ ও ছিলো নীতিহীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। আফ্রিকায় তো জঙ্গলের নিয়ম চলতো। চীন ও তাতার উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় সামাজিক নিষ্ঠুর প্রথাই ছিলো মানুষে মানুষের সম্পর্কের নীতিমালা। যে সব প্রথার মূলে ছিলো ভয়াবহ বৈষম্য ও অবিচার। শিক্ষার মাধ্যমে এই অবিচারেরই স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা হতো। মাদরাসা সেখানে সত্যিকার সম্পর্কের রূপরেখা দাঁড় করায়।
তৃতীয়ত: মানুষ বিশ্বজগতের সাথে কিরূপ সম্পর্ক রাখবে, এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও সত্যিকার দার্শনিক নীতিমালা শিক্ষাধারায় প্রবর্তন করা হয়। আল্লাহর সৃষ্টিজগতকে গভীরভাবে উপলদ্ধি করে এর প্রতি প্রখর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের নীতি গ্রহণ করে মাদরাসা। মাদরাসা গোটা বিশ্ব জগতকে খোদার নিদর্শন এবং সমস্ত সৃষ্ট বস্তুকে মানব কল্যাণের নিমিত্তে তার প্রদত্ত নেয়ামত হিসেবে দেখলো। আনফাস ও আফাকের সত্যকে খোদা পর্যন্ত পৌছার একটা দরজা হিসেবে দেখলো, একে খোদা ভাবলো না।
আফ্রিকায় তো জঙ্গলের নিয়ম চলতো। চীন ও তাতার উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় সামাজিক নিষ্ঠুর প্রথাই ছিলো মানুষে মানুষের সম্পর্কের নীতিমালা। যে সব প্রথার মূলে ছিলো ভয়াবহ বৈষম্য ও অবিচার। শিক্ষার মাধ্যমে এই অবিচারেরই স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা হতো। মাদরাসা সেখানে সত্যিকার সম্পর্কের রূপরেখা দাঁড় করায়।
অথচ তখন গোটা বিশ্বেই সৃষ্টিজগতের বিশেষ বস্তুসমূহ মানুষের কাছে খোদা রূপে পূণ্য ছিলো। ইউরোপ-আফ্রিকা ও এশিয়ার জনপদে মানুষ চন্দ্রের, সূর্যের, উঁচু পাহাড়ের, সুবিশাল সমুদ্রের, বিশাল বৃক্ষের, কিংবা আকাশের বা ঘন অরন্যের উপাসনায় লিপ্ত ছিলো। সে ছিলো সকল কিছুর গোলাম। সর্বত্রই ছিলো তার মা’বুদের ছড়াছড়ি সে কাউকেই ব্যবহার করার সাহস পেতো না। এগুলো নিয়ে গবেষণা করবে, এ উৎসাহ তার ছিলো না। সে জানতো না বিশ্বজগতের সাথে তার সম্পর্কের প্রকৃতি কী হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় এর কোনো বাস্তব দিক নির্দেশনা ছিলনা। কোথাও কোথাও আবার বিশ্বজগতের সমস্ত বিষয়কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে গুহার ভিতরে জীবন কাঠানোরা শিক্ষা প্রচলিত ছিলো।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে কয়েক শতাব্দী ধরে জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হবার উৎসাহ বিদ্যমান ছিলো। জীবন ও জগত থেকে লোকেরা থাকতো ক্ষুদ্ধ, দুনিয়ার নাজ-নেয়ামতকে মনে করা হতো আত্মিক উন্নতির শক্র, এবং সমাধিস্থলের ভৌতিক পরিবেশে ধার্মিক লোকেরা আশ্রয় নিতো এই শক্র থেকে আত্মরক্ষার জন্য। মাদরাসার শিক্ষা জগতের সাথে মানুষের সম্পর্কের প্রকৃতি ও এর সমূহকে যথার্থভাবে উদঘাটন করে ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা দাঁড় করায়। যার ফলে প্রকৃতি যেভাবে মানুষের প্রভূ হয় না, আবার মানুষ প্রকৃতির জন্য জালেম হয় না; বরং এর দ্বারা সে নীতিমালা না থাকলে সভ্যতার উন্নতি তো অর্জিত হতোই না, বরং মানবতার সুমহান সম্ভাবনা সমূহ আতুড়ঘরেই ধুঁকতে থাকতো।
মজার ব্যাপার হলো মধ্যযুগে ইউরোপে পার্থিব জীবকে অবাঞ্চিত বলে শিক্ষা দেয়া হতো, আর আধুনিক ইউরোপ পার্থিবতাকে এমনভাবে পূজা করছে, যেভাবে পেটুক তার খাদ্যবস্তুকে গলাধ:করণ করে মাত্র। কিন্তু একে কোনো মূল্য দেয় না। মাদরাসা শিক্ষা বিশ্বজগতকে প্রশান্তি ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে শিখালো, এর প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে এর কল্যাণসমূহকে নিশ্চিত করার প্রেরণা যোগালো।
এর প্রতি উপেক্ষা বা অবমূল্যায়নের পরিবর্তে বিশ্বজগতে আল্লাহর প্রতিনিধিসূলভ ভুমিকা পালনে মানষের জন্য পদ্ধতিগত রাজপথ উন্মুক্ত করে দিলো।
চতুর্থ: বিশ্বজগতের স্রষ্টার সাথে মানুষের সম্পর্ক কেমন হবে, এ বিষয়ে জগত ছিলো সবচে, বেশি অন্ধকারে। গ্রীক সভ্যতা আল্লাহর অস্তিত্বকে এতোটাই বিকৃতভাবে জানতো যে তারা মনে করতো আল্লাহর সাথে মানষের সম্পর্ক শক্রতামূলক। এ কারণে তারা প্রমিথিউসের প্রবিত্র আগুন চুরির কাহিনী সাজিয়েছে। যেখানে মানুষ ইশ্বরের পবিত্র আগুন চুরি করার প্রতিশোধস্বরুপ তিনি মানুষের সর্বনাশের জন্য সাব ধরনের ক্ষতিকর জিনিসে ভর্তি প্যান্ডুরার বাক্স পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। গ্রীকরা আল্লাহকে জানতো আহমিকাময় কোনো সত্তা হিসবে। যাকে যেভাবেই পারা যায় খুশি রাখতে হবে। খোদা আবার বহুজন। প্রতিজনকে পৃথকভাবে খুশি রাখতে হবে। না হয় সর্বনাশ হেয়ে যাবে। যেমন পোসাইডনকে খুশ না রখলে সমুদ্র মাতাল হয়ে ওঠে। দেবতাদের মধ্যে আবার লড়াই হয় এবং প্রতিবন্ধি দুই দেবতার লড়াইয়ে পৃথিবী ধ্বংস হবে।
গ্রীকদের উর্বর মস্তিস্ক খোদা সম্পর্কে যে কল্পনা সাজায়, তা থেকে তেমন ভিন্ন নয় রোমানদের আকীদা। তারা অবশ্য খোদা সম্পর্কে মনে করতো তিনি থাকলে আছেন, না থাকলে নেই। কিন্তু পরে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করায় খৃস্টীয় আকিদায় দীক্ষিত হয়ে যায়। তবে খৃষ্টবাদ মানুষের সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ককে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। নিজেদের জন্য সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহকে সাব্যস্থ করেছে, অন্যদরে জন্য নয়, যদিও তারা পাপে গলা অবধি ডুবন্ত থাকে। তার এই সম্পর্কেও ভিত্তিতে অনাচারের বাজার গরম কওে তুলেছে এবং ইহুদিরা একই কাজ করেছে। একে তারা উন্নত মানবতার বিকাশের প্রাণশক্তি হিসেবে দেখার পরিবর্তে নিজেদের জাতিগত দুর্নীতির হাতিয়ার বানাতে চেয়েছে। অন্যান্য ধর্ম স্রষ্টা সম্পর্কে বিশ্বাস পোষণ করে, এবং মানুষের সাথে তার যে সম্পর্কের কথা শিক্ষা দেয়, তা মানুষ ও সভ্যতাকে মহিমান্বিত করে না; বরং মানুষের মর্যাদা, শক্তি ও ব্যতিক্রমী সম্ভাবনাকে এমন সব মাখলুকের পদতলে সমর্পণ করে, যারা মূলত তারই পদতলে সমর্পিত হওয়ার কথা। সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্কের সষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা ছাড়া মানুষের আধ্যিাত্মিক বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে সভ্যতা অগ্রগতির রক্ত প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হয়। পরিচ্ছন্ন জীবনবোধ সে খোঁজে পায় না। তার অগ্রগতি পদে পদে বাধাগ্রস্থ হয়ে।
এ ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষার এহসান মানব সভ্যতার উপর অত্যন্ত বিশাল। কারণ মাদরাসাই শিক্ষাধারায় সৃষ্টিকর্তার সাথে মানষের সম্পর্কের ইসলাম নির্দেশিত রূপরেখা প্রবর্তন করেছে। যা আকীদা হিসেবে যেভাবে মহোত্তম, তেমনি মানব জীবনে আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত পরিশুদ্ধিও জন্য বিকল্পহীন দিকদর্শন।এই দিকদর্শনই মানুষকে প্রতিনিয়ত আরো মানুষ বানায়, সভ্যতাকে রক্ষা কের পশুত্বের ছায়া থেকে। পৃথিবীকে দান করে জীবনীশক্তি। সভ্যতাকে দান করে পবিত্রতার বারিধারা।
বর্ণিত মৌলিক অবদানসমূহ উন্নত সভ্যতার বুনিয়াদ গঠনে কাজ করেছে। এবং এর উপর উপজাত শাখা-প্রশাখাগত যে সব অবদান, তার তুলনা সূর্যের আলোর সাথে, যার বিশেষ কোনো সংখ্যাগত বিচার চলে না। কিন্তু মাদরাসা থেকে গৃহিত যে দার্শনিক জীবনপাঠ, তাকে বিকৃত ও অস্বীকার করতে ইউরোপ যার পর নেই যত্নবান থেকেছে। কিন্তু তার পরও পশ্চিমা সভ্যতা ইসলামি শিক্ষার যে সব অবদানকে কোনো উপায়ে অস্বীকার করতে পারেনি, তার একটু ইঙ্গিত আমরা ঐতিহাসিক ভিত্তি থেকে উপস্থাপন করবো।
ইউরোপের অন্ধকার গুহায় শিক্ষা দর্শনের আলো
একথা চরম সত্য হলেও খুব কমই বলা হয়েছে যে, পাশ্চাত্যের মানচিত্রে যদি সভ্যতার কোনো ছিটে ফোঁটা থেকে থাকে, তবে তা ইসলামেরই অবদান। পৃথিবীতে এমন কোনো ঐতিহাসিক কোথায় যিনি অস্বীকার করবেন পাশ্চ্যাত্যকে মুসলমানদের সভ্যতা শিখানোর সত্যতা। যদিও পাশ্চ্যাত্য তা স্বীকার করতে চায়না। কিন্তু ঐতিহাসিক মাত্রই বলতে বাধ্য যে, আরবদের অবদানের ফলেই আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা বহু বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান স্থরে এসে পৌছেছে। ইউরোপীয় সভ্যতা বিকাশের এমন একটি স্তরও চোখে পড়ে না, যেখানে ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ছাপ নেই।
শার্লেমেন ও তার লর্ডরা যখন নাম-দস্তখত শিখছিলেন বলে কথিত, তখন মুসলমি পন্ডিতরা এরিষ্টটলের গ্রন্থ অধ্যয়নে মগ্ন। তখন কর্ডোবার বিজ্ঞানীরা ১৭টি বিরাট লাইব্রেরী নিয়ে গবেষণায় মগ্ন, যার একটি লাইব্রেরীর বই সংখ্যা ছিলো চার লক্ষ। আর সেই পন্ডিতরা যখন পরম আরামদায়ক স্নানাগার ব্যবহার করতেন, তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গ প্রক্ষালনকে এক ভয়ংকর অনাচার বলে বিবেচনা করতো।
মুসলামনরা পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য অযু-গোসলের রীতি-নীতির সুবিধার্থে নগরে হাম্মাম খানাসহ পরিচ্ছন্নতার সুন্দর উপায়সমূহ অবলম্বন করেছিল। তখনকার ইউরোপের একজন সন্যাসী দীর্ঘ ৬০- বছর পর্যন্ত স্নান না করে কেবল ধর্মগ্রন্থ পাঠের সময় অঙ্গুলির অগ্রভাগ পানিতে ভিজিয়ে পবিত্রতা রক্ষার চাঞ্চল্যকর ঘটনার সূত্রপাত করেন।
জে ডব্লিউ লিউনার্দ স্বীকার করেছেন, ইউরোপীয়রা তখনও বর্বর, বুনো অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাদের শরীর অপরিস্কার, মন কুসংস্কারে পরিপূর্ণ। অধিবাসীরা ঝুপড়িতে বাস করতো। মেঝেতে নলখাগড়া বিছিয়ে দেয়ালে মাদুর টাঙিয়ে রাখতে পারলেই তা বিত্তবানের লক্ষণ বলে ধরা হতো। সীম, বরবটি গাছের মূল এমনকি গাছের ছাল খেয়ে ওরা মানবেতর জীবন- যাপন করতো।
শিক্ষা-দীক্ষার কোনো বালাই ছিলনা। ইউরোপে তখন শিক্ষা বলতে ধর্মীয় শিক্ষাকেই বুঝতো। আর এই শিক্ষা শুধু সীমাবদ্ধ ছিল মুষ্টিমেয় কিছু পাদ্রী ও বলশালীর মধ্যে। এমনকি অনেক পাদ্রী পর্যন্ত কোনো কিছু লেখতে বা পড়তে পারতো না।
ধর্ম ইসলামকে ইউরোপ গ্রহণ করেনি, সত্য। কিন্তু জীবন সম্পর্কে এক প্রগতিশীল ধারণার প্রবর্তক ইসলামকে ইউরোপ স্বাগত জানিয়েছে বিপুলভাবে। এরই ফলে প্রাচীন ইউরোপ হয়ে উঠেছে আজকের ইউরোপ
একখানা উপাসনা পুস্তক ধার করার জন্য ফ্রান্স রাজাকে বহু মূল্যবান দ্রব্য গচ্ছিত রাখতে ও অভিজাতদের জামিন দিতে হয়েছিল। প্যারিসের বিশপ পিটারের বিশাল লাইব্রেরীতে মাত্র আঠারো খানা পুস্তক ছিল। রানী ইসাবেলা দুইশ’ একখনা গ্রন্থ সংগ্রহ করেছিলেন। যার মধ্যে সাতষট্রি খানাই ছিল ধর্মপুস্তক।
ঐতিহাসিক লেগ স্বীকার করেছেন যে, সপ্ত শতাব্দীতে ইসলাম চিন্তার স্বাধীনতার দ্বার খুলে দয়িে ইউরোপে জ্ঞানচর্চার ব্যবস্থা করে। ফ্রান্সের খ্যাতিমান ঐতিহাসিক গেষ্টার লিবন কবুল করেছেন- সকলের ধারণা মতে পরীক্ষা ও অনুদর্শন হচ্ছে আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল ভিত্তি। মানুষ মনে করে এটা ফ্রান্সিস বেকনের অবদান। কিন্তু এখন স্বীকার করতে হবে যে, এটা আসলে আরবদের অবদান।
আজকের ইউরোপীয় সভ্যতা ইসলামি সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এবং এই সভ্যতা ইসলামি সভ্যতার উত্তরসূরী ব্যতীত কিছু নয়। সহস্র বছরের নির্জীব ইউরোপ পনেরো শতকের জীবনমুখর ইউরোপ হতে পেরেছে ইসলামি বিপ্লবের ছোয়ায়। ধর্ম ইসলামকে ইউরোপ গ্রহণ করেনি, সত্য। কিন্তু জীবন সম্পর্কে এক প্রগতিশীল ধারণার প্রবর্তক ইসলামকে ইউরোপ স্বাগত জানিয়েছে বিপুলভাবে। এরই ফলে প্রাচীন ইউরোপ হয়ে উঠেছে আজকের ইউরোপ। আধুনিক ইউরোপে যা কিছু প্রগতি ও সফলতা, তা মূলত ইসলামেরই ধর্মনিরপেক্ষ সংস্করণ।
ইউরোপ এই ইতিহাসকে ধামাচাপা দিতে চায়। স্বীকার করতে চায় না। মেজর আর্থার গ্রিন লিউনার্দ বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘এখন ইউরোপ সর্বান্ত:করণে ইসলামি সংস্কৃতি ও সভ্যতার ব্যাপক ও স্থায়ী দান মনে প্রাণে স্বীকার করেনি। উদাসীন ও অনিচ্ছা ভরে তারা শুধু এটুকু স্বীকার করেছে যে, অন্ধাকার যুগে ইউরোপীয়রা যখন সামন্তপ্রথার যাথাকলে পিষ্ট হচ্ছিল, তখন আরবদের নেতৃত্বে মুসলিম সভ্যতা সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের শীর্ষে আরোহণ করেছিল। পরিণামে যা নিস্পেষিত ইউরোপকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। মুসলমানদের অবদান ছাড়া ইউরোপ এখনো মূর্খতার অন্ধাকারে নিমজ্জিত থাকতো। [চলবে]
আওয়ার ইসলামের সৌজন্যে