বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৪:০০
Home / আমল / সিস্টেম যখন ইবাদাতে রূপ নেয়, তখন সেখানে বিদআত গেড়ে বসে

সিস্টেম যখন ইবাদাতে রূপ নেয়, তখন সেখানে বিদআত গেড়ে বসে

ড. আবদুস সালাম আজাদী :

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের একজন ইমাম ছিলেন আব্দুল কাদির জিলানী (র)। তার লেখা, শিক্ষা, পদক্ষেপ ও সমাজ সংস্কারের রূপরেখা সে সময়ে ক্রুসেডারদের পরাজিত করতে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। তিনি সে সময়ে একটা বড় আন্দোলন গড়ে তোলেন, যার মৌলিক উদ্দেশ্য ছিলো তিনটিঃ মুসলিমদেরকে সঠিক ইসলামে নিয়ে আসা। তাদের কে প্রশিক্ষণ দিয়ে বায়তুল মাকদিস পুরুদ্ধারের একটা বাহিনী তৈরী করা। এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলিমদের পুনরায় প্রতিস্থাপন করা।

তার সামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষার এই আন্দোলন সে সময় সব চেয়ে প্রভাবশালী ও সফল হিসেবে বিবেচিত হয়। তার এই আন্দোলন একটা সাংগঠনিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। সে সময়ের সারা মুসলিম দেশ সমূহ থেকে বাছাই করে লোক নিয়ে, তার প্রতিষ্টিত প্রতিষ্ঠানে যোগ দি‍য়ে, ট্রেনিং নিয়ে আস্তে আস্তে কেন্দ্রে নিয়ে আসা হত। এখানে প্রথমেই যোগ দিত তাদের বলা হতো অলী বা আওলিয়া। এরা প্রশিক্ষিত হয়ে একধাপ এগিয়ে গেলে বলা হতো ‘অতাদ’ বা আওতাদ। এদের এক ধাপ উপরে গেলে তাদেরকে বলা হতো ‘বদল’। এদের সংখ্যা হতো অনেক। যাদের সমষ্টি কে আবদাল বলা হতো।

এঁদের কে আরো প্রশিক্ষণ দিয়ে বানানো হতো কুতুব। এঁরা হতো বড় বড় এলাকার দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত শুয়ূখ। এঁদের উপরের স্তর ছিলো গাওস। প্রথমে তিনি ছিলেন এই গাওসের স্থানে। পরে বেশ কয়েকজন লীডার বেরিয়ে আসলে তাকে ‘আল গাওসুল আ’যাম’ বা বড় গাউস নাম দেয়া হয়।

এই স্তর বিন্যাস ছিলো নিছক সিস্টেম এবং জনশক্তি ম্যানেজমেন্ট এর ধারণা থেকে তৈরি। এতে নামকরণে কোন ধর্মীয় আবহ তৈরী করা হয়নি। কিন্তু পরবর্তিতে এই গুলো হয় ধর্মের স্তর, এই গুলোকে বানানো হলো ইবাদাত, এবং এই মারাত্মক শক্তিশালী আন্দোলনকে বানানো হয় একটা সুফী তরীক্বাহ, যার সাথে ইসলাম মিশতে যেয়ে আজো হিমশিম খাচ্ছে।

তাবলীগ জামাআত যখন শুরু হয়, এর মুরুব্বি ছিলেন গত শতকের মুসলিম জাগরণের অন্যতম ইমাম। তিনি মেওয়াটের শত শত ‘নামে মাত্র মুসলমান’ এক জনগোষ্ঠিকে দাওয়াত ও তাবলীগ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং মুয়াশারাত বা সমাজ যিন্দেগীর সংশোধনের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে আবার ইসলামে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। তার এই কাজ সরে-যমীনে প্রত্যক্ষ করে সে সময়ের ভারতের প্রখ্যাত উলামায়ে কিরাম ও চিন্তাবীদগণ ভূয়সী প্রশংসা করেন। মাওলানা মাওদূদীর মত ব্যক্তিত্ব ও একে ‘এক আযীমুশশ্বান ইসলামি তাহরীক’ তথা এক মহা ইসলামি আন্দোলন নামে অভিহিত করে বিশাল প্রবন্ধ লিখেন তার তারজুমানুল কুরআনে। মাওলানা ইলিয়াস (র) যে ধরণের আন্দোলন চেয়েছিলেন তাবলীগের বর্তমান কাজগুলো ছিলো তার প্রথম স্তর। এই কথা তিনি বহু যায়গায় বলেছেন ও তার মালফুযাতে উল্লেখ করেছেন। তিনি ৩/৭/৪০ কিংবা তারো বেশিদিন ঘর থেকে বের হয়ে হাতে কলমে ইসলাম শেখার জন্য মানুষকে বলে গেছেন। তিনি দাওয়াত দানের একটা পদ্ধতি বলে গেছেন। তিনি সাংগঠনিক কাঠামোতে আমীর, রাহবার, যাকিরীন, মুতাকাল্লিম, দাঈ ইত্যাদি পরিচিত করেছেন। শুরাকে তিনি বাধ্যতা মূলক করেছেন, আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনা বা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির চিন্তা গুলো তার সাংগঠনিক প্রজ্ঞার যথেষ্ঠ প্রমান করে।

এইসব করেছিলেন তিনি সিস্টেমের জন্য। কাজকে গতিশীল, বৈজ্ঞানিক উপায়ে আঞ্জাম দেয়া, আধুনিক মনস্কতাকে কাছে আনা ইত্যাদির জন্যই ছিলো তার এই সব পদক্ষেপ। কিন্তু এখনকার এই সবই এক একটা ইবাদাতের রুপ নিয়েছে। এখন চিল্লা দেয়া দ্বীনের আবশ্যক মনে করা হয়, এইটাই নবীওয়ালা কাজের প্রথম স্তর মনে করা হয়। তাবলীগীদের প্রতিষ্ঠানে চাকুরি পেতে, তাবলীগ করা ভাইদের কোন সাহায্য নিতে, এমন কি তাদের মেয়ে বিয়ে করতে বা ছেলেকে মেয়ে দিতেও ইদানিং চিল্লার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়। আগে দাওয়াতি কাজের একটা মৌসূম বের করে দাওয়াতি মাস পালন করা হত। মাস শেষে সব গ্রুপ এক যায়গায় হয়ে কারগুযারি শোনা ও শুনানির মাধ্যমে কাজে মটিভেশান আনা হত। এটা কে আস্তে আস্তে আন্তর্জাতিক সমাবেশে পরিণত হয়। এইটা এখন একটা ধর্মীয় সমাবেশে এমন ভাবে পরিণত করা হয়েছে যে বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতিমা এখন এক হজ্জের বিকল্প ও ভাবতে শেখাচ্ছে। শত শত মানুষের কাছে শুনেছি হজ্জের আগে বিশ্ব ইজতেমায় গেলে অনেক ট্রেনিং হয়ে যায়। এখানে একত্রিত হওয়া টাকে আস্তে আস্তে এমন ধর্মীয় করা হয়েছে যে বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা, বিরোধী দলীয় নেতা নেত্রী এখানের শেষ মুনাজাতে অংশ গ্রহন করা যেন বাধ্যতা মূলক হয়ে যাচ্ছে। আমি ৪ বছর এই বিশ্ব ইজতিমায়ে থেকেছি। এখানের বায়ান শুনে মানুষকে আলোকিত বা পুলকিত যত না হতে দেখেছি তার চেয়ে দেখেছি এখানের আখেরী মুনাজাতের কান্নায় ভেংগে পড়তে। লক্ষ করেছি এই মুনাজাত হয় অনেক লম্বা, এবং এর ভাষা থাকে অধিকাংশ সময় অবোধ্য। তার পরেও এইটাকে ধর্মের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এখন তো বিশ্ব ইজতিমা বছরের সেরা ইবাদাতে রূপ নিতে যাচ্ছে।

মাওলানা মাওদূদী ও জামাআতে ইসলামি গড়ে ছিলেন খুব সুন্দর ভাবে মুসলমানদের সঙ্ঘবদ্ধ করতে। আর সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী বানাতে সেখানেও সূধী, সমর্থক, কর্মী, রুকন ও শুরা সহ আমীর কেন্দ্রিক একটা মানানসই জনশক্তি স্তর বিন্যাস করেন। পরবর্তীতে সেসব গুলোতেও দেখেছি ধর্মীয় আবহ তাবলীগের চেয়েও কম আনা হয়নি। এক কর্মীকে রুকন বানানোর পদ্ধতি, ঐ রুকনের ধর্মীয় মর্যাদাও দেখেছি তাবলীগের মতই। এই সিস্টেম কে কখনো অনইসলামী বলা যাবেনা, কিন্তু এইটাকেই বা এই সিস্টেমকেই ধর্মের কাজ মনে করা অবশ্যই সমস্যার।

মদীনায় থাকা কালীন সময়ে এই সিস্টেম নিয়ে কথা ওঠে। আমাদের আহলুল হাদীসের কিছু ভাই এই সিস্টেম কে বিদআহ বলেন। আমরা সব পক্ষ তখন আমাদের শায়খ ডঃ মূসা আলক্বারনীর কাছে যাই। তিনি সব শুনে বলেছিলেন এই সিস্টেম বিদআহ নয়। কারণ আলমুসলিমূনা আলা শুরূতিহিম। দ্বীনি কাজের আঞ্জাম দিতে সব মুসলিম মিলে একটা সিস্টেম এ চলতে একমত হলে তা গুনাহ হবেনা। বিদআহ হবে যদি এই সিস্টেমকে কেউ ইবাদাত মনে করে। ঐ সময় আহলুল হাদীসের ডঃ আসাদুল্লাহিল গালিবের ‘শুব্বান’ নামের একটা গ্রুপের সন্ধান আমার কাছে ছিলো। তাদের সাংগঠনিক কাঠামো্র উপর লেখা বই পড়ে দেখেছিলাম ওটা ও ছিলো একদম জামাআতে ইসলামির সিস্টেম এর মত। খিলাফাত মাজলিসের সাংগঠনিক স্তর ও দেখেছি এই রকম।

আমার কাছে মনে হয়েছে ইসলামি কাজের ব্যবস্থাপনা করতে যেয়ে এই সব সিস্টেম করা বিদআহ হবে না। বিদআহ হবে তখন, যখন এই গুলোকেই ধর্মের অনুষ্ঠান, বা সাওয়াব কামানোর এইটাই মাধ্যম বা এই সিস্টেম না মানলে ইসলাম মানা হবে না এই রকম মনে করা। আমার মনে হয়েছে কোন সংগঠন অনুসরণ করতে যেয়ে এই সব সিস্টেম কে মেনে চলা আবশ্যক করে দিলে বিদআহর ভয় থাকে, বরকত চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

তারাবীহ’র নামায ২০ রাকাত (১ম পর্ব)

মুফতী মাসুম বিন্নুরী:: (প্রথম পর্ব) ‘তারাবীহ’ শব্দটি আরবী শব্দ। এটা تَرْوِيْحَةٌ (তারবীহাতুন) এর বহুবচন। এর ...