মুফতি জিয়াউর রহমান :
আমাদের পক্ষ থেকে সবসময় একই অভিযোগ প্রকাশ পায় যে, আমরা এত দুআ করি৷ কিন্তু কবুল হয় না৷ অথচ আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না যে, সমাজটা সুদে ছেয়ে গেছে৷ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সুদ খেতে খেতে আমাদের রক্ত-মাংস হারাম হয়ে গেছে৷ গ্রামের সুদী কারবারীকে সুদখোর বললেও ব্যাংকের সুদকে আমরা সুদই মনে করি না৷ আজ সমাজের প্রায় মানুষ, যাদেরকে সমাজ ভালোমানুষ হিসেবে চিনে; অধিকাংশই ব্যাংকিং সুদের সাথে জড়িত৷
এক ভাই প্রশ্ন করেছেন, তিনি একটি প্রাইভেট ভার্সিটির স্টুডেন্ট৷ তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা৷ একেবারে বৃদ্ধ হয়ে গেছেন৷ পেনশনের টাকা ব্যাংকে রেখেছেন৷ মাসে মাসে ইন্টারেস্ট পান৷ এর থেকেই তাদের পরিবার এবং তার পড়ালেখার খরচ নির্বাহ করেন৷ তাদের আর কোনো ভাই নেই৷ উপার্জনক্ষম কেউ নেই৷ এই টাকাগুলো দিয়ে ব্যবসা করার মতোও কোনো সুযোগ নেই৷ তিনি সুদের টাকা নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছেন যে, এগুলো তো হারাম ইনকাম৷ কী করবেন? পরামর্শ দেয়ার জন্যে৷ উত্তরে যে কথাগুলো লিখেছি:
১. প্রথমত আমাদের খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে হবে যে, ইসলামে সুদ দেয়া, নেয়া এবং সুদ সংক্রান্ত যে কোনো কাজে সহযোগিতা করা মারাত্মক গোনাহের কাজ৷ সুদই একমাত্র গোনাহ, যে গোনাহে জড়িতদের সঙ্গে আল্লাহ যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন৷ অভিশপ্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন৷ সুদী টাকা-পয়সা, খাদ্যদ্রব্য ও যে কোনো সামগ্রী নিরেট হারাম৷ পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা- أَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا “আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন” (সূরা আল-বাকারাহ: ২৭৫)।
২. আপনার বাবার পেনশনের টাকা ব্যাংকে রেখেছেন মাসে মাসে লাভ পেয়ে আপনাদের পারিবারিক প্রয়োজন পুরা করার জন্যে৷ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মাসে মাসে একটা হারে লাভ দিবে৷ এই টাকাগুলোর প্রকৃত মালিক কিন্তু আরেক ব্যক্তি৷ তারা আপনার বাবার টাকা সুদে খাটিয়ে আরেকজনের টাকা সুদী সিস্টেমে এনে এর একটা অংশ আপনার বাবাকে দিচ্ছে৷ আপনার বাবা কিংবা আপনি অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করবেন না৷ কোনো প্রকৃত মুমিন এটা করতে পারে না৷ তবে এই যে ব্যাংক থেকে লাভ পাচ্ছেন, শুনতে খারাপ লাগলেও প্রকৃত অর্থে সেগুলোও আরেকজন কিংবা একাধিক জনের টাকা পরোক্ষভাবে আপনারা অন্যের সহায়তায় আত্মসাৎ করে খাচ্ছেন৷ সুদের হাকীকত কিন্তু এটাই৷ যা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না৷ গভীরে যাই না৷
৩. উচিত হলো পারতপক্ষে ব্যাংকে টাকা না রাখা৷ যদি একান্ত রাখতেই হয়, তাহলে যে সিস্টেমের একাউন্টে লাভ আসে না, সেই সিস্টেমে রাখা৷ আর যদি অজান্তে সুদ চলেই আসে, তাহলে সেগুলোকে প্রকৃত মালিকের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা৷ না পেলে গরীব-মিসকীনের মাঝে সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সাদাকা করে দেয়া৷
৪. এখন আসি আপনাদের পারিবারিক অবস্থা ও উপার্জন অক্ষমতার আলোচনায়৷ আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন- وما من دابة في الأرض إلا علي الله رزقها. আর পৃথিবীতে কোনো বিচরণশীল নেই, তবে সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন৷ (সূরা হুদ: ৬)
যেহেতু আমাদের রিযিকের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তাআলা নিয়েছেন, তাই তিনি আমাদের জন্যে হালাল রিযিকেরই ব্যবস্থা করবেন৷ তবে হালাল রিযিকের অন্বেষণ, চাহিদা এবং গুরুত্ব আমাদের ভেতর থাকতে হবে৷ আল্লাহ তাআলার কাছে হালাল রিযিক চাইতে হবে৷ হারাম থেকে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা থাকতে হবে৷ হারাম গ্রহণের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার ভয় ভেতরে কাজ করতে হবে৷ তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে৷
৫. আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ আপনি এখন উপার্জনক্ষম৷ আল্লাহ তাআলার ভয় অন্তরে রেখে একটু হিম্মত করলেই হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ! তাই এখন আপনার করণীয় হচ্ছে, আপনি নিজে আয়-রোজগারে লেগে পড়ুন৷ নিজের আয়ে নিজে পরিবারের ভরণপোষণের চিন্তা করুন৷ পেনশনের টাকাগুলো বিশ্বস্ত জায়গায় হালাল ব্যবসায় লাগানোর চিন্তা করুন৷ নিজ আয়ের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এখন থেকেই শুরু করে দিন এবং আল্লাহ তাআলার কাছে চাইতে থাকুন৷ তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা করে দিবেন ইন-শা আল্লাহ! কেননা আল্লাহ তাআলা নিজেই ওয়াদা করেছেন- ومن يتق الله يجعل له مخرجاً، ويرزقه من حيث لا يحتسب ومن يتوكل على الله فهو حسبه إن الله بالغ أمره. (سورة الطلاق:٢-٣) “আর যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন৷ এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন৷ আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট৷ আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন৷” (সূরা আত্ব-ত্বালাক: ২-৩)
তাছাড়া হারামের উপর নির্ভরশীল থাকলে হালালের পথ প্রশস্ত হয় না৷ সারাজীবন হারামের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়৷ জীবন নির্বাহে বরকত চলে যায়৷ দুআ কবুলের পথ বন্ধ হয়ে যায়৷ তাই এখনই সুদ গ্রহণ থেকে সরে আসুন৷ আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন৷ ক্ষমা করুন৷