লুকোচুরি খেলার মতো শীতটা আসি আসি করবে ভেবেছিলাম৷ নিত্যদিনের মতো ঝটপটে যাপিত জীবন হবে আবার৷ কিন্তু না, এ কী! সন্ধ্যে নামতেই কুয়াশাকন্যারা ভিড় করতে আরম্ভ করেছে৷ দৃষ্টিসীমায়ই আনন্দে মেতে ওঠছে শীতমেঘেরা৷ নীলচে আকাশটাকে শুভ্র করে তুলছে সবার অজান্তেই৷ কখনও শ্রাবণমেঘের ঘনঘটা, কখনো বা বৈশাখি দমকা হাওয়ার মতো ব্যাকুল করে তুলছে আশপাশ৷ রাতের তারার মেলায় নিজেকে মেলে ধরতে চাই৷ পারি না৷ কাঁধের ওপর ভর করে যতোসব পাহাড়ি বরফমালা৷ ভাবনারাজ্য আর এগোতে চায় না৷ কল্পকথার গপ্পো হয়েছে অনেক৷ কিন্তু জীবনবোধের খোরাক মেলেনি কখনও হয়তো৷ একাকী নিঃসঙ্গতার মাঝেই বোধোদয় জেগে ওঠছে আজকাল৷ জীবনপাঠের দীক্ষাই যেনো বা এসব৷ তবু আশার ফুল ফোটে না৷ আমি চেয়ে থাকি কেয়াফুলের এই হাতটি ধরে৷ আর কেউ নয়তো! কেবল একাকী আমিই দাঁড়িয়ে থাকি শীতভাবনার এই দেশে৷
দুই.
শীতের ভোরটা বেশ ফ্যাকাশে বোধহয় আজকাল৷ বিছানা ছেড়ে সাতসকালে ওঠাটা বড্ডো কষ্টের৷ বাইরে বেরোলেই চোখে পড়ে ধবধবে পরিবেশ৷ সাদাটে রঙে ঠাওর করা যায় না তেমন কিছুই৷ যেনো শীতবুড়িটাই রাজ করছে আমাদের এই গোটা পৃথিবী৷ তারা না ফোটা সুখস্বপ্নে হারাতে হয় মনমহুয়ার৷ হাবুডুবু খেলতে হয় শীতশীতে এই অবেলায়৷ জবুথবু দেহে স্বপ্নের রঙধনু খেলে তবু৷ মেঘবালিকার মতোন হাতছানি দেয় জমাট বাঁধা কুয়াশার দল৷ শিশিরবিন্দু আর নজরে ভাসে না যদিও৷ তবুও বাধ্য হতে হয় বলতে, ‘এই সময় এই! তোমাকেই ভালোবাসি৷’ জীবনকে বলা হয়নি যে কথাটি আজও৷ যায় না যে বলা৷ ফুরসৎ মেলে না অতো৷ অজুহাত অার বাহানাভূমি আমায় জাপটে ধরে৷ আলসে ঘরে বন্দি করেই ছাড়ে৷ আমি উল্টো স্রোতে ভাসতেই সচেষ্ট হই৷ ভাসতে ভালোবাসি৷ ভাসতেই হবে৷ জীবনখেয়ায় ঘুমের পালক নামে৷ আমি হারাই সেই ঘোররাজ্যে৷ ‘এই শুভ্র এই!’ অধরায়ই কে যেনো ডাকে৷ আমি জাগি৷ জাগতেই হয়৷ আমার জীবননৌকো আমায় জাগায়৷ অকল্পনীয়, তবু শীতের আরাম খোঁজে আমার সত্ত্বা৷ মায়ার দোলায় কখনও এর রূপ হয় অভিমানী, কখনো বা আমার অস্থিমজ্জার অন্যরকম কিছু৷
তিন.
কনকনে শীতে কেঁপে ওঠছে বাইরের পৃথিবীটা৷ রাতের ঘুমপ্রহরে নামছে না আর খানিকটা প্রশান্তির পালক৷ বেড়িবাঁধের মতো আকড়ে ধরে তাকে দুষ্টু শীতবুড়ি৷ প্রতিরোধের মিছিল বস্ত্র হয়ে আসুক কামনা কেবল এটাই৷ রাত্তির মিহি চাদর দূর হতে না হতেই বরফের মতো জমে যাচ্ছে আশপাশ৷ তবে শীতগায়িকা পাখপাখালির নেই কোনো আনাগোনা৷ কেবল গাছগাছালির ঘরছাড়া হাল যতোটুকুন৷ যেনো শীত, কুয়াশার বিজয় মিছিল প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নীল শামিয়ানার খোলা প্রান্তরে৷ খানিক পরপরই হলিখেলার জন্য হচ্ছে পাগলপারা৷ চায় যেনো দখল করতে আজকের জীবনরাজ্য৷ দেওবন্দের আকাশে আজ মেঘবুড়ির বেশ আনাগোনা৷ তবু বৃষ্টিবিলাসের সুর-মূর্ছনায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে পাগল মন৷ কদমের গন্ধে মুগ্ধ হতে চায় ইচ্ছেআকাশ৷ কিন্তু আশপাশের সবটা খুঁজেও মেলে না এর দেখা৷ এখানে কী তবে আমার বাংলাঋতুর কদম ফোটে না!? জোছনাস্নান জোটে না কী কারোর ভাগ্যাকাশে!
চার.
কৈশোরে বেশ হুল্লোড়ে কেটেছে আমার এই শীতের সকালগুলি৷ ভোর হতেই লেপ মুড়ি দিয়ে কুঁজো বুড়ো সাজা, মিষ্টি রোদের ওপর পিঠ ঠেকিয়ে বসা, হলদে ভাত আর ডিম ভাজিকে অতি আহামরি ভাবা, মাদুর পেতে উঠোনের আঙিনাঘেঁষে মধ্যদুপুর করা৷ বেলা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিপাটি হওয়া, বইপত্র গুছিয়ে স্কুল যাওয়া, প্রথম সারির মাঝের বেঞ্চিতে বসে পড়া, ভদ্র খোকার মতোন কম কথা বলা, পড়া শুনিয়ে শিক্ষকদের মুগ্ধ করা— এসব ছিলো আমার রোজকার জীবনগল্প৷ পড়ন্তবেলায় গাঁয়ের মেঠোপথটি ধরে হেঁটে যাওয়া, বাল্যবন্ধু আজগরের বাড়িতে গিয়ে বেড়িয়ে আসা, খেলার সাথীদের সঙ্গে ডাংগুলি খেলায় সন্ধ্যে গড়ানো, সাঁঝের আজান পড়তেই বাড়ি ফেরা, হাতমুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসা— যেনো দিব্যি রুটিন বনে গিয়েছিলো বাল্যবাবুর৷ রাতের খাবার সেরে মায়ের গলা জড়িয়ে থাকা, ঘুমপাড়ানি গানের আবদার করা, কল্পগপ্পের রাজ্যে সহসাই হারিয়ে যাওয়া, সুখের ঘুমদেশে ডুবে থাকা, মুয়াজ্জিনের ডাকে ফের সাড়া দেওয়া— এইতো ছিলো আমার প্রিয় শৈশব-কৈশোরবেলা৷
পাঁচ.
প্রচণ্ড শীতের মোড়কে জড়ায় এখনও রাতদিন৷ কুয়াশামেঘেরা জেঁকে বসে ভরদুপুরেও৷ আলতো ছোঁয়াচে জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে হপ্তাজুড়ে৷ ‘যায় বয়ে যায় শীতবেলা’ বোধের আকাশে উদ্রেক হয় এমনটা৷ বয়ে যাওয়া দিনময় এইতো আমার সম্ভাবনায় সাজে৷ হঠাৎ হঠাৎ কেনো যেনো আবার এই রোদেলা ভোরে পাখিরা গান করে৷ অচেনা সুখের পাপড়িগুলি ফের মনের কাবায় ভিড়েভিড়ি করে৷ কুয়াশাকন্যাদের ছুটি মেলে আবার ছাড়পত্র বিনে৷ বেড়াতে যায় ফের মাঝেমধ্যে বয়ে যাওয়া শীতের পাগলা হাওয়ার দল৷ হাঁপিয়ে ওঠা জীবনটায় প্রশান্তির জোয়ার বয় খানিকটা হলেও৷ ছেঁড়াপাতারা নড়ে ওঠে কাব্যখোলস মুখে৷ যেনো এখনই, এই সময়েই জন্ম দেবে একটি কবিতার৷ যেটি হবে না পাওয়া, বেদনার আড়ালে পরম সুখের৷ হারিয়ে ফেলা সবকিছুর প্রতিকূল জীবনছবি৷
ছয়.
আজও এসেছে সেই শৈশব-কৈশোরবেলার মতোন শীত-সময়৷ আসে, এসে যায় প্রতিদিনকার জীবনকাহনে৷ এখনও যায় বয়ে যায় সেই শীতবেলা৷ পড়ন্ত বিকেলেই কুয়াশার চাদরে ঘিরে যায় আমার চারপাশ৷ দুধেল সাদা কুয়াশামেঘেরা গান করে রাতভর৷ ভোরের পাখিরা ডাকে৷ আলোয় আলোকিত করে সূয্যিমামা৷ কিন্তু সেইসব নেই, যা ছিলো আমার হারানো শৈশব-কৈশোরবেলায়৷ আহ! কতোই না সুখের, বড় আনন্দের ছিলো সেসব দিনরাত্রি৷ খুঁজে ফিরি আজও সেইসব অকৃত্রিম সোনালি দিন৷ জুটবে কী তা ফের কখনও! জিন্দেগি না মিলেগি দো-বারা৷ তবুও ব্যর্থ খুঁজে দেখার কোশেশ যতোটুকুন৷ হায়রে আমার সোনালি শৈশব-কৈশোর, তোমরা আজ কে কোথায়!
লেখক | শিক্ষার্থী : দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত