ধারাবাহিক : সমুদ্র ঈগল ১ (খ)
কুতায়বা আহসান :
মেয়েটির এবংবিধ প্রশ্নে মুনযির বিন যুবাইর কিছুটা হতচকিত হয়ে উঠলেন। সাথে সাথে তাঁর জবান দিয়ে কোনো কথা উচ্চারিত হচ্ছিল না। তাঁর মাথাটা নিচের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল।
মুনযির প্রসঙ্গটাকে ধামাচাপা দেয়ার নিমিত্তে বলতে লাগলেন: মা, মা‘আয! ভারাক্রান্ত হৃদয় আর উদাস চাহনি মেলে এই রাহিবপল্লীর দিকে আমার তাকিয়ে থাকাটা অবশ্যই কারণবিহীন নয়।
বেটি মা‘আয! আমার স্বভাবজাত মানসিকতা আমার চিন্তাকে সবসময় আমার জাতির অতীত ইতিহাসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আমার অবচেতন মন সবসময় আমাকে এটা ভাবতে বাধ্য করে— কোন সে অভিশপ্ত কারণ আমাদেরকে এতোটা দুর্বল করে দিল যে, শেষপর্যন্ত আমরা ৮০০ সালা একটা প্রতিষ্ঠিত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ধরে রাখতে পারলাম না।
সেই বালিকা— মুনযির যাকে মা‘আয নামে ডেকেছিলেন, তাঁর কথাগুলো শুনে বিষন্ন হয়ে পড়েছিল। তার বড় বোনের অবস্থাও তার থেকে ভিন্নতর ছিল না। আর তাদেরই পাশে পড়ন্ত যৌবনের যে হাবশী তাদের সকলের ঘোড়ার লাগাম হাতে দাঁড়ানো ছিল সে তাদের থেকেও অধিকতর বিষন্ন হয়ে উঠেছিল। বিষন্নতার কালি লেগে তার চেহারাটা অধিকতর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।
মা‘আয নামক মেয়েটি পুনরায় মুনযিরকে লক্ষ করে বলল: চাচা! আপনার ধারণাটা এতো বিশাল ও মজবুত রাষ্ট্রব্যবস্থা হঠাৎ করে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে খানখান হয়ে পড়ার পেছনে কী কারণ খুঁজে পেয়েছো?
জবাবে মুনযির কতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন। তাঁর চোখের কোণা বেয়ে অশ্রুর ফোঁটা চিকচিক করছিল। সীমাহীন কষ্টের সাথে বলতে লাগলেন:
বেটি মা‘আয! আমার বিশ্বাস— এ ভূখণ্ডের এই দুর্ভোগের ইতিহাস অনাগত দিনের প্রতিটি ধর্মের মানুষের জন্যই ঔৎসুক্য আর গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠার পাশাপাশি ভবিষ্যতের মুসলিম উম্মাহর জন্য ইবরত আর শিক্ষার উপকরণ হয়ে দাঁড়াবে। মা! এটা আত্মপ্রতারণার দাস্তান বৈ কিছুই নয়। ভবিষ্যতের মুসলিম প্রজন্ম যখন স্পেনের ইতিহাস পড়বে তখন দেখতে পাবে— এখানে মুসলমানদের যে মহাপুরুষরা দ্বীনের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের ঈমানে যে দৃঢ়তা ছিল, যে ধরণের জাতীয় সম্প্রীতি ও ঐক্য ছিল, যে সভ্যতা আর সংস্কৃতির উপর তাঁরা এখানে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, পরবর্তীদের মধ্যে সে ঈমানের ছিঁটা-ফোটাও ছিল না। তারা আত্মপ্রতারিত হয়ে আল্লাহর রশিকে মজবুতভাবে না ধরে তা ছেড়ে দিয়েছিল। তারা শত্রুর মোকাবেলায় না দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই আর হানাহানিতে জড়িয়ে পড়েছিল। এই গৃহযুদ্ধের অভিশাপেই তারা আন্দালুসিয়ায় তাদের শৌর্য আর ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছিল। ফলে ইউরোপের সর্দারীর পাশাপাশি তাদের সবকিছুই চলে গিয়েছিল। আর একসময় তাদেরকে এখান থেকে আস্তিনে চোখ মুছে সাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
এতটুকু বলার পর মুনযির বিন যুবাইর অধিকতর ধরাগলায় বলতে লাগলেন:
মা রে! আল্লাহর চিরন্তন নীতি অপরিবর্তনীয়। এ নীতি সবার বেলায়ই সমান। যাঁরা আজ আল্লাহর শরীয়ত পালন করে দুনিয়ার নেতৃত্বে সমাসীন, তারাই যদি কাল আল্লাহর না-ফরমানিতে লিপ্ত হয়ে যায় তাহলে তাদের উপর লাঞ্ছনা আর অধোগতি নেমে আসতে সময় লাগবে না।
কারণ আল্লাহ বলেছেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি দ্বীন থেকে প্রত্যাবর্তন হয়ে যাও, তাহলে আল্লাহ তোমাদের স্থলে এমন জাতি নিয়ে আসবেন যেমন তিনি চান”।
বেদনায় মুনযির বিন যুবাইরের মাথা ঝুকে পড়ছিল, তাঁর চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। তিনি ব্যথাভরা আর্তিতে বলে উঠলেন, হায়! যদি এমন কোনো তারিক বিন যিয়াদ এখানে জন্ম নিত; যে এই ভূখণ্ডের মানুষের বেদনা লাগবের জন্যে মাঠে বেরিয়ে আসবে। বিপদের তুফানের মোকাবেলা করে জাতিকে উজ্জল ভবিষ্যতের পথ দেখাবে। জাতির হারা শৌর্য আর ঐতিহ্য উদ্ধার করে আবার তাঁদের মাথা উঁচু করার প্রয়াস পাবে।
হায়! যদি আব্দুর রহমান আদ দাখিলের মতো কেউ এখানে তাকবীরের আওয়াজ উচ্চকিত করে প্রবেশ করতো এবং অস্থিরতার সাথে অস্ত যাওয়া সূর্যের আকাশপটে ঘৃণিত জিন্দেগীর ইতিহাস মুছে নতুন দাস্তান লেখার প্রয়াস পেতো।
হায়! যদি কোনো ইউসুফ বিন তাশফিন এখানকার প্রতিটি ঘরের দরজা খুলে মৃত্যুশিয়রে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর কাছে জীবনের পয়গাম শোনাতো।
হায়! যদি সোনালি জীবনের পয়গাম নিয়ে মরক্কো থেকে কোনো আব্দুল মুমিন এই আন্দালুসিয়ার সাগর সৈকতে পা রেখে এখান থেকে যিল্লতি তাড়ানো আযান দিতো। যদি বারুদের স্তুপে ঝলসে যাওয়া দেহগুলোতে প্রাণের স্পন্দন নিয়ে আসতো। কিন্তু হায়! মনে হচ্ছে আমাদের চোখের ভ্রুতে হতাশার সুরমা পরিয়ে দেয়া হয়েছে। সূর্যকিরণ আমাদের ভাগ্যে কেবল ধুসর আর ফ্যাকাশে, সোনালি নয় কখনো। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে যে জাতি এই ভূস্বর্গটা শাসন করে আসছিল আজ তাদের তকদিরে ফোটা ফোটা রক্ত আর শরীর ঝলসে দেয়া আগুনের শিখা ছাড়া কিছুই নেই।
মুনযির বিন যুবাইরকে দেখে মনে হচ্ছিল বাহ্যত যদিও তিনি নিজেকে সামলে রাখছেন, কিন্তু অন্তরে অন্তরে তিনি উচ্ছাস আর বেদনার প্রচণ্ড একটি ঘুর্ণিঝড়ের মোকাবেলা করে চলছেন। যে ঝড় তাঁর জাতির শেষ বৃক্ষটিকেও স্পেনের ভূমি থেকে সমূলে উপড়ে ফেলতে চায়।
তিনি কতক্ষণ নীরব থেকে অত্যন্ত বেদনাকাতর কণ্ঠে বলে উঠলেন: অবশেষে আমরা আর কতদিন আল বাশারাতের এই ওয়াদিতে রক্ত আর আগুনের বিভিষিকাময় ইন্তেজারের মধ্য দিয়ে কাল অতিবাহিত করবো? আমাদের জ্বলে যাওয়া স্বাধীনতার আকাশে গোলামীর ধোঁয়া আর কতকাল আকাশ স্পর্শ করতে থাকবে? কতদিন আর আমরা এমন বে-চইন জিন্দেগী অতিবাহিত করতে থাকবো?
মুনযির বিন যুবাইরের আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিল। তিনি ডুবন্তপ্রায়-যাত্রীর-কণ্ঠে বলে যেতে লাগলেন: হায়! আর কতকাল না জানি আমরা আল বাশারাতবাসীরা অভিভাবকহীন জীবনে মান্না আর সালওয়ার খুঁজে বের হওয়া লোকগুলোর সাথে অস্থিত্বের শেষ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকবো।
হায়! যদি জীবন ও শক্তির এমন কোনো চারণ কবি জেগে উঠতো— যে উদাস রাত, নির্লিপ্ত আবেগ, আর ফ্যাকাশে হওয়া হলদে পাতায় জীবনের কোনো নতুন জয়গান লিপিবদ্ধ করবে। মুসলিম জাতির ভাগ্য-ডায়রির প্রতিটি পাতায় পাতায় সৌভাগ্য সূর্যের কিরণ রেখে যাবে।
এটুকু বলার পর রাখাল মুনযির বিন যুবাইর একেবারে নীরব হয়ে গেলেন। তাঁর চেহারার হতাশা, চোখের কোণের অশ্র দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেমন এমন এক মুসাফির, যাকে তার মনযিলের প্রায় কাছেই ছিনতাই করে একেবারে নিঃস্ব বানিয়ে দেয়া হয়েছে।
তাঁর অবস্থা দেখে মা‘আয, তার বড় বোন নাবিল এবং তাদের হাবশি গোলামের অবস্থাও একেবারে করুণ হয়ে উঠেছিল। তারাও মানসিকভাবে বেদনাহত হয়ে উঠেছিলেন। এরই মধ্যে তারা দেখতে পেলেন মুনযির রাহিবপল্লীর দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাঁদের দৃষ্টিগুলো যখন মুনযিরের দৃষ্টির অনুগামী হলো তখন তারা দেখতে পেল ওখানকার একটি খানকাহ থেকে বেরিয়ে আসছেন দুজন রাহিব। বয়সে একজন টগবগে যুবক অপরজন এখনো যেন এক টাটকা তরুণ। তাদের উভয়ের গায়ে রাহিবদের পোষাক।
মা‘আয সম্ভবত মুনযির বিন যুবাইরের অবস্থা অনুমান করে নিতে পেরেছিল। সুতরাং সে তার বড় বোন নাবিলের দিকে ইশারা করেই ঘোড়ায় চড়ে সেটিকে বস্তি অভিমুখে ছেড়ে দেয়। তার দেখাদেখি নাবিল এবং তাদের হাবশি গোলাম বাসিতও তাদের ঘোড়ায় পদাঘাত হেনে সেগুলোকে বস্তি অভিমুখে হাঁকিয়ে দেন।
কিছু দূর যাবার পর মা‘আয ঘোড়া থেকে নেমে একটি চাটানের আড়ালে বসে পড়ল। নাবিল তার প্রতি প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে তাকালে মা‘আয ঠোঁটে আঙ্গুল টেকিয়ে তাকে কোনো কথা না বলতে ইঙ্গিত করল। মা‘আযের ইঙ্গিত পেয়ে নাবিল তার ঘোড়া থেকে নেমে মা‘আযের কাছে চলে আসল। বাসিতও তাদের ঘোড়াগুলোর লাগাম ধরে একদিকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
পাহাড়ের পাদদেশে ফারদিশ নদীর কিনারে রাহিবপল্লী থেকে যে দু‘জন রাহিব বেরিয়ে আসছিল তারা দ্রুত পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হয়ে একসময় মুনযির বিন যুবাইরের কাছে চলে আসে। মা‘আয আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল— এরা উভয় অত্যন্ত আনন্দের সাথে মুনযিরের সাথে মুসাফাহা করছেন। এরপর তাদের মধ্যকার যুবক রাহিব মুনযিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন: আমাদের আগমন সংবাদ কি সরদারদ্বয়ের কানে পৌঁছে দেয়া হয়েছে?
মুনযির বিন যুবাইর অত্যন্ত প্রীত-কণ্ঠে বললেন: হ্যাঁ আপনাদের আগমনবার্তা উভয় সর্দারের কানে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। কাহতানী কবীলার সর্দারের নাম হচ্ছে কা‘ব বিন আমির, আর আদনানী কবীলার সর্দারের নাম হচ্ছে সা‘দ বিন সালামা। খুব সম্ভব তাঁরা উভয়ে এখন কাহতানী সর্দারের কেল্লাসদৃশ্য হাবেলিতে বসে আপনাদের অপেক্ষা করছেন। অনুগ্রহ করে আপনারা এখানে একটু অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ছেলে কাসির বিন মুনযির এখানে এসে পৌঁছে যাচ্ছে। সে এলেই আমি ভেড়া-বকরিগুলোকে তার হাওয়ালায় ছেড়ে আপনাদের নিয়ে তাঁদের খেদমতে চলে যাব।
মুনযির কথাটা বলে শেষ করার আগেই দেখতে পান কাসির দ্রুত তাদের দিকে ছুটে আসছে। মুনযির তাদেরকে যুবক কাসিরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন: এই দেখুন আমার ছেলে এসে গেছে এবার চলুন আমরা সর্দারদ্বয়ের কাছে যাই।
কতটুকু যাবার পর যুবক রাহিব মুনযির বিন যুবাইরকে উদ্দেশ্য করে বললেন: সামনে এই যে বস্তি দেখা যাচ্ছে সর্দারদ্বয়ের মধ্যে এটি কার অধীনস্ত?
মুনযির বিন যুবাইর বললেন: সামনে দৃশ্যমান বস্তিটি কাহতানী সর্দারের অধীনস্ত। কাহতানী কবীলার অধীনে বড় বড় বস্তিগুলোর মধ্যে ‘কুরায়তিয়া ইউরা’, ‘জাবালে আসিম’, ‘বাসতা’ এবং ‘যুসতার’ অন্যতম। আর আদনানী কবীলার বড় বড় বস্তি হচ্ছে ‘হাসান কাসীর’, ‘হাসান ফাইনানা’ ‘বানী আবদূস’ এবং ‘খান্দাকে আশ’। মনে হচ্ছিল মুনযির বিন যুবাইরের জবাব শুনে রাহিবদ্বয় প্রফুল্ল হয়ে উঠছেন এবং আর কোনো কথা না বাড়িয়ে তাঁরা তাঁর পিছনে পিছনে বস্তি অভিমুখে এগিয়ে চললেন। (চলবে)