শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৪:৩৫
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / আরাকান: সেই সালতানাত, এই গণকবর (শেষ কিস্তি)

আরাকান: সেই সালতানাত, এই গণকবর (শেষ কিস্তি)

মুসা আল হাফিজ

এভাবেই চলতে থাকলো দিনের পর দিন। ৩রা জুন থেকে নিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। জ্বলতে থাকলো ব্যবসা কেন্দ্র, ফসলের মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জ্বালিয়ে দেয়া হলো বহুসংখ্যক মসজিদ। হত্যা করা হলো আকিয়াবের প্রাচিনতম শফিকখান মসজিদের ইমাম সকলের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব মাওলানা যিয়াউল ইসলাম। জ্বলে পুড়ে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম। মানুষের ঘরবাড়ি। যারা অবস্থাসম্পন্ন জীবন যাপন করতেন। তারা মুহূর্তেই নিঃস্ব হয়ে গেলেন। সারা জীবনের উপার্জন লুণ্ঠিত হলো শত শত রোহিঙ্গার। লুণ্ঠিত হলো টাকা পয়সা, ধান, চাল, পোশক-আশাক, এমনকি নুন লাকড়িও। মৃত্যুর জনপদে পরিণত হলো মংডু জেলার দক্ষিণ নয়াপাড়া, বমুপাড়া, মাঙ্গালাপাড়া, সম্মান্যপাড়া, চারমাইল, হাদিরবিল, ঝড়ারপাড়া। একেবারে ভষ্মিভূত হয়ে গেলো আকিয়াবের নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, মংলেপাড়া, বাহারছড়া, ছাক্কিপাড়া, জালিয়াপাড়া, রোহাইঙ্গা ও ওয়ালিদপাড়া । জ্বালিয়ে, গুলি করে এবং জবাই করে হত্যা করা হলো শিশু, মহিলা সহ ৭০০ মুসলমানকে। জীবন বাঁচাতে মানুষ পালাতে লাগলো। উদ্বাস্তুতে পরিণত হলো হাজার হাজার মানুষ। রাখাইন রাজ্যে স্থায়ী ৩৭টি আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিলো ৩৫০০০ রোহিঙ্গা।হাজার হাজার মুসলমান সমুদ্রে পাড়ি জমালো বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে।

২০১২ সালের সেই ঘটনার পর নাফ নদীতে অনেক পানি বয়ে গেছে। সু‘চি ক্ষমতায় বসেছেন। ভাবা হয়েছিলো রোহিঙ্গারা অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে। কিন্তু সুচিও গ্রহণ করলেন পোড়ামাটি নীতি। তার রোহিঙ্গাপীড়ন নতুন আকার ধারণ করলো। একের পর এক বৈষম্য ও উৎপীড়নের ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গারা হারালো নাগরিক অধিকার। আইন করা হলো তাদেরকে আর রোহিঙ্গা বলা যাবে না।তাদের জাতিসত্ত্বাকে অস্বীকার করা হলো। শুরু হলো বিদ্বষমূলক প্রচারের নতুন মাত্রা রোহিঙ্গারা নাগরিক হিসাবে চলাফেরার স্বাধীনতা হারাল।শিক্ষার অধিকার, শি্ক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হল। তাদের এলাকায় দেশের সবচেয়ে ভয়ানক অপারাধীদের জড়ো করা চল্লো। ওরা তাদেরকে উচ্ছেদ করতে থাকল ঘর-বাড়ি, জমি-জমা থেকে। ব্যবসা বাণিজ্যসহ কোথাও তারা ঠিকে থাকতে পারল না। যুগ যুগ ধরে চলৈ আসছে তাদের বিয়ে-শাদিতে কড়াকড়ি। সেনাবাহিনীর অনুমতি ছাড়া বিয়ে সেখানে অপরাধ। রোহিঙ্গাদের সে অনুমতি মিলে না। ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা তরূনী বৃদ্ধা হচ্ছেন বিয়ে ছাড়াই।

সবধরনের জুলুম অবিচারে পিষ্ঠ হতে থাকা এই জনগোষ্ঠির আহাজারি যখন বেড়েই চলছে, এর মধ্যে খবর এলো ৯ অক্টোবর মংডোর চিকান পিনে রাত তিনটার দিকে লাঠি ও কাটের তরবারি দিয়ে কারা মেরে ফেলছে ৯ পুলিশ ।

আর যান কোথা? শুরু হলো সেনা অভিযান। ১৩ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যের মংডোর উত্তর এলাকার এক গ্রামে বহু রোহিঙ্গাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারলো সেনাবাহিনি। গ্রামে গ্রামে তাদের হামলা চলতে লাগলো। সেনাবাহিনির ভাষ্য হলো তারা হত্যা করেছেন ৬৯ জনকে। কিন্তু বাস্তবতা এর চে অনেক ভয়াবহ। শুধু মংডো এলাকায় গুম হয়েছেন কয়েক শত নারী-পুরুষ।ঘর হারিয়েছেন হাজার হাজার পরিবার।

বাংলাদেশের সীমান্তে লাখো রোহিঙ্গর ঢল। অনেকেই প্রবেশ করেছেন জীবন বাজি রেখে। প্রবেশের অপেক্ষায় আছেন অসংখ্য অগণিত মাজলুম।জঙ্গলেও তারা পারছেন না জীবন বাঁচাতে। ক্ষুধা, পিপাসায় মারা যাচ্ছেন অকাতরে। গোটা জাতির উপর এথনিক ক্লিনজিং চালানো হচ্ছে। বিশ্বের চোখের সামনে শেষ করে দেয়া হচ্ছে একটি জাতীকে। নারী, শিশু বৃদ্ধসহ বিপন্ন মানবতার উপর নৃশংসতার যে সব দৃশ্য ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে, তাতে আদিম বর্বতাও লজ্জিত। প্রাণ বাঁচাতে আগত বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় বড় প্রয়োজন। প্রয়োজন আশ্রয় গ্রহণকারী মুহাজিরদের খাদ্য, বস্ত্র ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ১৯৭৮ সালে অপারেশন ড্রাগংকিং এর মাধ্যমে সামরিক জান্তা রুহিঙ্গাদের গনহত্যা শুরু করলে আশ্রয়ের আশায় চলে আসা ২লাখ ৫০হাজার রুহিঙ্গাকে আশ্র্রয় দিয়েছেলো বাংলাদেশ। ১৭টি ক্যাম্পে অবস্থান করতেন এইসব উদ্বাস্ত। ১৯৯১ এবং ১৯৯৯ সালেও জান বাঁচাবার আশায় আরাকানী মুসলমানরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।

১৯৭৮ এ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তী বেগম খালেদা জিয়া মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেন। জাতিসংঘের মাধ্যমে এদের অনেককে আরাকানে ফেরত পাঠানো হলেও এখনো বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ৩০হাজার রুহিঙ্গা শরণার্থী, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশন (ইউএনএইচসিআর) এর ত্রাণ ও সাহায্য পেয়ে তারা কোনমতে জীবন-যাপন করছেন। সম্প্রতি প্রাণ বাঁচাতে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা লক্ষের উপরে। তাদের নিরাপত্তা লঙ্গিত হচ্ছে, নারীরা কোথাও হচ্ছেন বলাৎকারের শিকার। এদেশে আশ্রয় নিয়ে কোন রোহিঙ্গার বিপন্ন হওয়া চরম অমানবিক নজির। এখনো বহ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেই বার্মায়, যেখানে তাদের জন্য দাউ দাউ করছে মৃত্যুর জাহান্নাম। আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে অসংখ্য সজনকে।

বিপন্ন রোহিঙ্গাদের নিশ্চিত মৃত্যু হাতে ফিরিয়ে না দিয়ে সাময়িক আশ্রয় দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জোরালো হচ্ছে দেশের বাইরে এবং ভেতরেও। কিন্তু সরকার সবার দাবিকে অগ্রাহ্য করছেন। এক শ্রেনীর মিডিয়া রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বেশ তেঁতে আছে মনে হয়। তারা মানবিক দাবিটাকে পিছনে ফেলে বিপন্ন এই প্রতিবেশীর পাশে না দাঁড়ানোকে এক ধরণের কৃতিত্ব হিসাবে অভিনন্দন করছেন। অথচ আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় অধিকাংশ রোহিঙ্গাই বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাদের সংস্কৃতিও আমাদের সমান্তরাল। তারাই আশ্রয় দিয়েছিলেন আমাদের কবি আলাওলকে। তাদের সহযোগীতায় আমাদের ভাষার হয়েছে বিচিত্র বিকাশ। আর ধর্মীয় সহমর্মিতার বিষয়টি কী তুলবো? এটা উঠিয়ে কী লাভ? এর উচ্চারণ করলেই তো হায় হায় করে উঠবে দালাল মিডিয়া। চটে যাবেন সুশীল সমাজ!

না এখন চটে যাবার সময় নয়। মিয়ানমারে মানবতা বিপজ্জনক খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদয়হীনতার কুর্দনে থেমে যাচ্ছে তার শ্বাস-প্রশ্বাস।

পৃথিবীর সবচে বিপন্ন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবতার বিবেকের দরোজায় কড়া নাড়ছে বরবার। প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে এবার সাড়া দেয়া উচিত। নতুবা পাশবিকতার অসুর বিক্রম বাড়াতে থাকবে ক্রমাগত। চোখের সামনেই সেটা ঘটতে দেয়ার কলঙ্কে কলুসিত হবো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা প্রত্যেকেই।

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও গবেষক

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...