গত সপ্তায় সীমান্ত পারি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন রোকসানা (১৯)। এক সপ্তায় পেটে তেমন কিছু পড়েনি। সেটা নিয়ে তিনি আদৌ চিন্তিত নন। তাকে বারবার আতঙ্কিত করছে পেটে আনাগত সন্তান।
নিজের সন্তান হলে কথা ছিল না। এটা যে নির্যাতনের ফসল। একজন বৌদ্ধ সেনার বীজ। কোনোরকম বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর থেকেই এক চিন্তা- কিভাবে এই আপদ দূর করা যায়। কিন্তু উপায় সহজ নয়। একেতো অনুপ্রবেশের ভয় দ্বিতীয় চিকিৎসার স্থান কাল অজানা।
মিয়ানমারের বৌদ্ধ সেনাদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা এমন রোকসানার সংখ্যা অসংখ্য। এদের মধ্যে অনেক নারী বিভিন্ন সহায়তায় স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারলেও অধিকাংশকেই বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে। যারা অনাগত ভবিষ্যত নিয়ে অনবরত ঝরিয়ে যাচ্ছেন চোখের পানি।
মিয়ানমারে সেনা কর্তৃক নৃশংস নির্যাতনের কথা স্বীকার করে আরেক নারী আসমা খাতুন (ছদ্মনাম) জানান, আমাদের অঞ্চলে এমন নারী নেই যারা তাদের হাতে নির্যাতিত হয়নি। ওরা কাউকেই ছাড়ছে না। প্রথমে বাড়িতে এসে পুরুষকে ধরে নিয়ে যায় তারপর নারীদের প্রকাশ্যেই নির্যাতন চালায়। এক নারীকে একাধিক সেনা নির্যাতন চালায় বলেও জানান তিনি।
আসমা বলেন, এক বাড়িতে সেনারা এসে কিশোরীকে প্রথমেই ধর্ষণ করে। তার বাবা মেয়েটিকে বাঁচাতে চাইলে তাকে ধরে নিয়ে যায়। যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তারা আর কখনো ফিরে আসে না।
কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আসা আক্রান্ত নারীদের অনেকেই আত্মীয় সজনের মাধ্যমে উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি হয়। এখানে তারা প্রাথমিক সহায়তা পাচ্ছেন। চিকিৎসা সহায়তা পাওয়া অনেকের রিপোর্ট কার্ডে দেখা গেছে তারা শারীরীক ও মানসিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। ভবিষ্যতে এই নারীরা কোনো কাজ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে।
দেশত্যাগ ছাড়া পথ নেই রোহিঙ্গাদের
এমএসএফ হাসপতালের এক কর্মকর্তা জানান, মিয়ানমারের আক্রান্ত হওয়া শতাধিক নারীকে আমরা চিকিৎসা দিয়েছি। যাদের বেশিরভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার। এরা চরম শারীরীক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার বলেও জানান তিনি।
মিয়ানমারের সেনাকর্তৃক নারীদের গণধর্ষণের উদ্দেশ্য- অঞ্চলটি থেকে মুসলিম বিতারণের পাশাপাশি তাদের ঘরে বৌদ্ধ সন্তান জন্ম দেয়া। এটিকে তারা ধর্ম যুদ্ধ হিসেবেই আখ্যা দিচ্ছে এবং সে টার্গেটেই নারীদের উপর চড়াও হচ্ছে। অতীতেও এমন যুদ্ধগুলোতে নারী বন্দিদের ওপর এমন নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে।
কুতুপালংয়ের মাহমুদ হোসেন বিষয়টি স্মরণ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, আক্রান্ত নারীদের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা সেবা দেয়া প্রয়োজন। তাদের এভাবে রেখে দিলে বা ফেরত পাঠানো হলে ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। মুসলিম নারীরা জন্ম দেবে বৌদ্ধ সন্তান।
তিনি জানান, আমি নিজে আক্রান্ত অনেক নারীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তারা শুধু মিয়ানমার নয়, বাংলাদেশে আসার পথে রাস্তায় আরো অনেকের হাতেই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। যা চরম ভয়াবহতাকেউ ছাড়িয়ে গেছে।
সাধারণ নাগরিকদের যেভাবে নির্যাতন করা হয়
মিয়ানমারে আক্রান্ত এলাকাগুলোতে এখনও যে সব মুসলিম পরিবার রয়েছে তাদের উপর নির্যাতন দিন দিন বাড়ছেই। বদলাচ্ছে নির্যাতনের ধরণ। আর কেউ যাতে তাদের বিপক্ষে সংঘবদ্ধ হতে না পারে সে জন্য চলছে রাতদিন পাহাড়া।
নির্যাতনের ভয়ঙ্কর চিত্রগুলোর কথা স্মরণ করে শাহাদাত হোসেন বলেন, এখন তো গণহত্যা চলছে ওখানে। কিন্তু এর আগেও যখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল না তখনও সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা প্রতিটি মুসলিম পরিবারের ওপর নানা পদ্ধতিতে নির্যাতন চালিয়েছে।
তিনি বলেন, মংডুর প্রতিটি বাড়িতে বৌদ্ধ ও সেনারা মিলে পাহাড়া দেয়। সন্ধ্যার পর আমাদের বাইরে বেরুনো সম্পূর্ণ নিষেধ। কেউ যদি প্রয়োজন সারতেও বাইরে বের হয় সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার করে কিংবা ধরে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, আরাকানের মুসলিমদের জন্য বাজারে যাওয়া নিষেধ। কোথাও কয়েকজন মিলে বসা, গল্প করাও আইনে নেই। এসব দেখলেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি অন্যজনের বাড়ি যেতে পারেন না।
আরাকানে মুসলিম নারী পুরুষ বিয়ে করতে চাইলেও নানা ঘাট পার হতে হয়। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আবেদন করতে হয় প্রশাসন বরাবর। সেটা অধিকাংশ সময়ই অনুমোদন পায় না। পেলেও কয়েকমাস পর এবং বিবাহ দিতে ইচ্ছুক মেয়ে পরিবারকে চাঁদা দিতে হয় কয়েক লক্ষ টাকা। এসব ঘাট পেরিয়ে অনেকেরই আর বিয়ের পিড়িতে বসা সম্ভব হয় না। আওয়ার ইসলামের সৌজন্যে