পাঁচ পরামর্শ ও কূটনৈতিক তৎপরতা
শোলাকিয়া ঈদগাহের গ্র্যান্ড ইমাম, জমিয়তে উলামার চেয়ারম্যান বরেণ্য আলেমেদ্বীন শায়খুল হাদীস আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ (হাফিঃ) গতকাল সন্ধ্যায় সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরেন। কমাশিসার পাঠকদের জন্য তা তোলে ধরা হলো।
♦ রোহিঙ্গা চলমান গণহত্যা নিয়ে কি ভাবছেন?
আল্লামা মাসউদঃ আমি এই বিষয় নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে মুসলমানরা নির্যাতন হলে একজন মুসলমান হিসাবে কিভাবে ভাল থাকা যায়। আর আরকানের মুসলমানরাতো আমাদের প্রতিবেশি। এই গণহত্যা বন্ধে সোচ্চার হওয়া ও স্থায়ীভাবে এর সমাধানের চেষ্টা করা আমাদের ঈমানী দ্বায়িত্ব। আমি এ নিয়ে সরকার ও কূটনৈতিক উচ্চমহলে কথা বলছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আজ মায়ানমার রাষ্টদূতকে জরুরী তলবও করেছে। আশা করি সরকার আমাদের প্রস্ততা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে।
♦ স্থায়ী সমাধান ও রোহিঙ্গাদের সঙ্কট সমাধানে কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
আল্লামা মাসউদঃ প্রথমে তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাতে হবে। তারপর মুসলিমবিশ্বকে আন্তরিকতার সাথে আন্তর্জাতিকভাবে এই সংকট নিরসনের উদ্দ্যোগ নিতে হবে। আরববিশ্ব যদি কূটনৈতিকভাবে বার্মা সরকারকে চাপ দেয় তাহলে তারা নিজেদের স্বার্থেই গণহত্যা বন্ধ করতে বাধ্য হবে।
♦ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ভূমিকা কী হতে পারে?
আল্লামা মাসউদঃ রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ কাজ করলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং সুখ্যাতি বাড়বে। এটা বর্তমান সরকারের জন্য বড় একটি পজিটিভ বিষয় হতে পারে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তিনি নিজেও বিশ্বশান্তির একটি মডেল প্রস্তাবনা সারা দুনিয়ার সামনে পেশ করেছেন। এটাকে বাস্তবে রূপ দিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা তার বড় একটি সুযোগ। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে মধ্যস্থতার জন্য প্রতিবেশি দেশ হিসেবে মুসলিম বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কূটনীতিক তৎপরতা চালাতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের উপর জালেমরা যে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল মায়নমারের আজকের ভয়াবহ নির্যাতনের যাতনা দেখে তার চেয়ে ভাল আর কে প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুধাবন করতে পারবে? আশা করছি রোহিঙ্গা বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রী কাজ করবেন। এছাড়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশ হিসেবে আরাকানে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর জন্য সরকার জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে প্রস্তাব রাখতে পারে।
♦ বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়ার দাবী উঠেছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
আল্লামা মাসউদঃ যেভাবে পারা যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবেশি মজলুমের পাশে দাঁড়ানো উচিত। তবে সীমান্ত খুলে দেয়াই একমাত্র সমাধান নয়। বার্মিজ সরকারও সেটিই চাচ্ছে, বাংলাদেশ সীমানা খুলে দিবে আর মুসলমানরা পালিয়ে এদেশে আসবে। আর তাদের ফেরৎ নিবেনা। এসব কারনে ইচ্ছে করলেই একটি স্বাধীন দেশের সীমান্ত যখন তখন খুলে দেয়া সম্ভব হয় না। তবে আন্তর্জাতিক রোল অনুযায়ী এবং জাতিসংঘও যেহেতু প্রস্তাব করেছে, একটি নির্দৃষ্ট জায়গা শরণার্থী ক্যাম্প করে জাতিসংঘের সহযোগিতায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য সাময়িক সময়ের জন্য খুলে দেয়া যেতে পারে বলে আমিও মনে করি। বাংলাদেশ এর আগেও কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করেছে। তারা এখন বাংলাদেশে আছে। বার্মা সরকার তাদের ফেরৎ নেয় নি, তারাও যেতে চায় নি।
♦ অনেকে বলেছেন আপনি এ নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সাথে কথা বলতে পারেন!
আল্লামা মাসউদঃ ইতোমধ্যে আমি সরকারের উচ্চমহলে কয়েকবার কথা বলেছি। মিডিয়াকে বলেছি। গত ক’দিন ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও কূটনৈতিকদের সাথে বারবার কথা বলছি। গত বছর রোহিঙ্গাদের উপর হামলা হলে, আমি বাংলাদেশের বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ নেতাদের সাথে বৈঠক করে, কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছি। কয়েকদিন পর বার্মার বৌদ্ধ নেতারা বাংলাদেশে তাদের একটি অনুষ্ঠানে আসার কথা রয়েছে, আমি বার্মা দুতাবাসের সাথে কথা বলে তাদের সাথে বৈঠকের সময় নিয়েছি।
♦ রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আপনার পরামর্শ কি?
আল্লামা মাসউদঃ প্রথমে তাদের অর্থাৎ সেখানকার মুসলিম লিডার ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্কট নিরসনে ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
দ্বিতীয়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সতর্কতার সাথে আমাদের বার্তা প্রচার করতে হবে। আবেগে ভুল সংবাদ পরিবেশন মূল ইস্যুকে আড়াল করতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাচাই করে সংবাদ প্রচার করতে হবে। আমাদের আবেগ ও কোন অপপ্রচার যেন মজলুমের ক্ষতির কারন না হয়ে দাঁড়ায়।
তৃতীয়, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের মাধ্যমে শান্তিরক্ষা মিশনের ব্যবস্থা করতে পারে।
চতুর্থ, মুসলিম বিশ্বকে সোচ্চারভাবে এর প্রতিবাদ করে কার্যক্রর ভুমিকা পালন করে বার্মার মুসলমানদের পাশে দাড়াতে হবে। জাতিসংঘ ও মানবধিকার সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে কাজ করতে চাপ দিয়ে বাধ্য করতে হবে এবং নিজেরা মজলুম মুসলমানের জন্য কাজ করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
পঞ্চম, বাংলাদেশ সংকট নিরসনে প্রতিবেশি রাষ্ঠ হিসাবে তৃতীয় পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে আমরা সরকারের কাছে দাবী পেশ করতে হবে। তবে সর্তক থাকতে হবে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোন মহল যেন বাংলাদেশের পরিবেশকে নষ্ট করার চক্রান্ত না করতে পারে।
♦ সময় দেয়ার জন্য জাজাকাল্লাহ।
আল্লামা মাসউদঃ তোমার প্রতিও মোবারকবাদ রইল।