বুধবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৪:৩০
Home / কওমি অঙ্গন / চেতনার বৈঠক, সিদ্ধান্তবলী ও পর্যালোচনা

চেতনার বৈঠক, সিদ্ধান্তবলী ও পর্যালোচনা

%e0%a6%9a%e0%a7%87%e0%a6%a4%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%95%e0%a6%93%e0%a6%ae%e0%a7%80-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%beপা চাটা গোলাম, দরবারি আলেম, দালাল এ জাতীয় আপত্তিকর লেখা ও বক্তব্য প্রদানকারীদের বয়কটের আহ্বান।

সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::

গতকাল ২৯ অক্টোবর “চেতনায় কওমী মাদরাসা”র উদ্যোগে আয়োজিত তরুণ আলেমদের মতবিনিময় সভার পুরোটা লাইভে দেখছিলাম। তরুণ আলেমরা হৃদ্যতা চান। প্রেম চান। ভালবাসা চান। বড়দের ব্যাপারে বসে আলোচনা চান। ঐক্য চান। সর্বোপরি তারা স্বীকৃতি চান। অধিকাংশ বক্তা স্বীকৃতির পক্ষে জোরালো ও যৌক্তিক বক্তব্য রেখেছেন। এই বৈঠক অনেকের চিন্তা, দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি, আবেগকে বদলে দিবে বলে আমার বিশ্বাস। হয়তো কিছুটা হলেও কমবে মাঠ গরমের সস্তা আবেগি বক্তব্য। কমে আসবে হুজুগের ছলে আবেগের বশে স্বীকৃতির বিরোধীতা।

ভিডিওতে যা দেখলাম প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল আয়োজকদের পক্ষের কেউ কেউ স্বীকৃতির বিষয়ে তাদের রাজনৈতিক মতকে প্রতিষ্ঠিত করার ও চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কারন স্বীকৃতির প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই নানা কৌশলে তারা এর বিরোধীতা করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে আসছিলেন। শুভংকরের ফাঁক, বাংলালিংক সিমের মতো নানা বির্তকিত কথা বলে তরুণদের উস্কে দেয়া হচ্ছিল। তবুও মেধাবি তরুণ আলেমরা স্বীকৃতি চান। তাই তারা নিসংকোচে হাজির হয়েছিলেন বৈঠক। যারা হাজির হতে পারেন নি তারাও এক টেবিলে বসাকে সমর্থন করে স্বাগত জানিয়েছেন।

গতকাল গোলটেবিলে অধিকাংশ তরুণদের বক্তব্য ছিল স্বীকৃতি ও ঐক্যের পক্ষে। তারা বাস্তবতাকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। অনেকেই বলেছেন, খুব দ্রুত স্বীকৃতি হয়ে যাবে এটাকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত আয়োজকরা তাদের অবস্থান থেকে সরে এসে অধিকাংশ তরুণের মতামতের ভিত্তিতে চমৎকার কিছু সিদ্ধান্তে একমত হয়েছেন। এজন্য আয়োজকবৃন্দ বিশেষ সাধুবাদ পেতে পারেন।

আমরা আশা করব তারা গতকালের বৈঠকের দ্বারা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন চিন্তাশীল তরুণরা কী চাচ্ছেন এবং কী ভাবছেন। আমরা এটাও আশা করতে পারি তারা ছলে বলে কৌশলে স্বীকৃতির কালক্ষেপণ ও বিরোধীতা এবং খসড়ার অপব্যাখ্যা থেকে কালকের গোলটেবিল বৈঠকের পর সরে আসবেন। আমরা তাদের কাছ থেকে আবেগি-আপত্তিকর কোন কথার বিপরীত গঠনমূলক দিক নির্দশনাই এখন থেকে পাব- এমন প্রত্যাশা সকলের। ভাই ভাই হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বীকৃতির জন্য কাজ করব।

বৈঠক সিদ্ধান্তাবলী:
এক.
আমাদের মুরব্বী ওলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও বেয়াদবীমূলক, অশোভন উক্তি ও মন্তব্য করা থেকে সকলকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো ৷কওমী মাদরাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি ইস্যুতে যেই মুরব্বীর অবস্থান যেদিকেই থাকুক না কেন, সকলের প্রতি আমরা সন্মান প্রদর্শন করব ৷

নোটঃ বিষয়টি খুবই সময়োপযোগি এবং গুরুত্বপূর্ণ। প্রশংসার দাবি রাখে। মুরুব্বিদের অবস্থান যে দিকেই থাকুক তাদের পজিটিভ বিষয় আমরা তুলে ধরতে পারি, শ্রদ্ধার সাথে কোন ভুল চোখে পড়লে আদব ও এহতেরামের সাথে কথা বলতে পারি। কিন্তু আমরা বিগত ক’বছর যাবত এবং সম্প্রতি জঙ্গিবাদ বিরোধি ফতোয়া প্রদান এবং স্বীকৃতি বিষয় শায়খুল হাদীস আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ সাহেবকে কিছু দলান্ধ ও আবেগি কওমি তরুণরা জামাতের সুরে সুর দিয়ে এহেন আপত্তিকর কোন শব্দ নেই যা বলে নি। এই সিদ্ধান্তের পরে তাদের কিছু বোধদয় হবে বলে আশা করতে পারি। কোন মুফতি আর মিডিয়ার সামনে বড় কোন হযরতকে তাসলিমা নাসরিনের সাথে তুলনা করার সাহস দেখাবেন না। দেখালে কওমি চেতনা থেকে তাদের বয়কট করা হোক। কওমি চেতনার তালিকায় তাদের দেখলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় অনেক কওমি সন্তানের।

মানুষের সৃজনী ও মূল্যবোধ চর্চা যেখানে বিপথে হয়, অবক্ষয় শুরু হয়, সেখানে ইতি ঘটে সৃজনকালের। ইতি ঘটে সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ব, শ্রদ্ধাবোধের; আসে মড়ক সাৎস্যন্যায়। কখনো আসে স্বল্পকালের জন্য, কখনো দীর্ঘকালের জন্য। তরুণদের সম্মিলিত উদ্দ্যোগ ও প্রচেষ্টাই পারে কেবল মূল্যবোধের এই অবক্ষয়ের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।

দুই. উপস্থিত তরুণ ওলামায়ে কেরাম নিজেরাও বড়দের ব্যাপারে কটু কথা না বলা এবং পরস্পরও ব্যক্তি আক্রমণ না করার ব্যপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন এবং নিজ নিজ ফেসবুক আই.ডি থেকে ও অন্যান্য উপায়ে ব্যক্তিগতভাবে তরুণ প্রজন্মের প্রতি বিতর্ক ও পর্যালোচনার ক্ষেত্রে সৌজন্যতা ও শালীনতা রক্ষার প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন ৷ সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত থাকার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাবেন ৷

নোটঃ বৈঠকে উপস্থিত তরুণদের এই বোধদয় একটি ঐতিহাসিক পজিটিভ চিন্তা। যে নিজেরাও বড়দের ব্যাপারে কটুকথা বলব না। বদলে যাও বদলে দাও, শ্লোগানের আগে নিজেকে বদলাও। তারা সাহসের সাথে সেই শপৎটিই নিয়েছেন। হাতে হাত রেখে, ভাই ভাই হয়ে আমরা কওম ও কওমির জন্য কাজ করব। আমাদের পক্ষ থেকে যদি বড়দের কটুকথা বলা, পরস্পরে আক্রমণ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তরুণরা নিয়ন্ত্রিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

তিন. যে সকল ব্যক্তি ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশালীন, আপত্তিকর বা ব্যক্তিআক্রমণাত্মক পোস্ট, কমেন্ট ইত্যাদি করবে, তাদেরকে সংশোধনের ও এ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা হবে ৷ এক্ষেত্রে যার সাথে যার যোগাযোগ বা সু-সম্পর্ক রয়েছে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখবেন ৷ অন্যরাও প্রয়োজনে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে ৷

নোটঃ বিষয়টি নিয়ে অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে কথা বলে আসছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবেও নানা বৈঠকে, সেমিনারে, লেখাতে এই সামাজিক অবক্ষয় থেকে উত্তরণের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও প্রতিরোধের কথা বলে আসছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ গতকাল কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে বৈঠকে এই বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রাধান্য পাওয়াতে অনেকেই খুশি হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কওমি তরুণ ও ইসলামিকদের যে মূল্যবোধ বিসর্জন, মানবিকতা ও শ্রদ্ধা -ভালবাসার বোধগুলো হারিয়ে যাওয়া, তা হঠাৎ করে হয় নি। মানবিক মূল্যবোধ যেমন একদিনে অর্জন করা যায় না তেমনি একদিনে হারিয়েও যায় না। আমাদের পারপার্শিক অবস্থান ও সম্পর্ক থেকে এসব আমাদের ভেতর ভাইরাস হিসেবে ছড়িয়েছে। বিশেষ করে জামাতের সাথে দীর্ঘমেয়াদি সখ্যতা তাদের নানা হীন রাজনৈতিক অপপ্রচার আমাদের কওমি তরুণদের ধীরে ধীরে প্রভাবিত করে আর্দশ থেকে দূরে সরিয়ে, মানবিক মূল্যবোধের বির্পযয় ঘটিয়েছে। তৈরি করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিংসা ,ক্লেশ, ঘৃণা ও শত্রুতা। কারন কওমির ভ্রাতৃত্ব আর আদব এহতেরাম একদিনের অর্জন নয়। সেটা এভাবে বিনষ্ট হতে দেয়া যায় না। সম্প্রতি কয়েকটি আপত্তিকর বিষয়ের পর তরুণদের সর্তক করতে এমন বৈঠকের ফলে, আমাদের কালের সৃজনী -প্রতিভাগণ অমর হয়ে থাকবেন ইতিহাসে।

চার. ফেইক বা ছদ্ম পরিচয়ের ফেসবুক আইডি থেকে কারো বক্তব্যে আপত্তিকর কমেন্ট ইত্যাদি করলে তা তিনি ডিলিট করবেন এবং প্রয়োজনে ছদ্ম পরিচয়ধারীকে ব্লক করে এহেন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন ৷

নোটঃ ছন্মবেশিরাই মূলত আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে। বিশেষ করে হেফাজত আন্দোলনের পর থেকে কওমি তরুণরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি। তার আগ থেকেই একটি বিশেষ দলের কর্মিরা হেফাজত ইসলামের নামে ফেসবুকে অসংখ্য আইডি, পেইজ, গ্রুপ খুলে আমাদের তরুণদের বিভ্রান্ত্র করেছে। অবক্ষয় ঘটিয়েছে সৃজনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধে। এছাড়া কওমি মাদরাসা, কওমি মাদরাসার ছাত্র, আকাবিরে দেওবন্দ এসব আবেগি নামে বিশেষ ভ্রান্ত দলটির অসংখ্য আইডি দিয়ে আমাদের ভেতর প্রবেশ করে এই হীন কাজটি করে আসছে। এই উদ্যোগের ফলে তরুণরা যদি সর্তক হয় আর ছন্দবেশি ফেক আইডিদের ও অশালীন কমেন্টকারীদের ব্লক দেয় তবে বড় একটি সাহসী কাজ হবে।

পাঁচ. কওমী মাদরাসা ও বোর্ডসমূহের মুরব্বিয়ানে কেরামের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সামনে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ তুলে ধরা হবে-
ক) ওলামায়ে কেরাম যেন যে কোনো সিদ্ধান্ত ঐক্যবদ্ধভাবে গ্রহণ করেন ৷ স্বীকৃতি নিলেও যেন ঐক্যবদ্ধভাবে নেন, না নিলেও যেন ঐক্যবদ্ধভাবে প্রত্যাখ্যান করেন ৷
খ) বেফাকুল মাদারিসের সাথে অপরাপর চার বোর্ডের প্রস্তাবিত বৈঠকটি যেন যে কোনো মূল্যে বাস্তবায়ন করা হয় ৷
গ) কওমী কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়ায় সরকারের হাতে কর্তৃপক্ষ গঠনের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকা ও পরবর্তিতে কওমী বিশ্ববিদ্যালয় গঠন ও তাতে ভিসি নিয়োগসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারী হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টির আশংকার কথা জানানো ৷এসকল লক্ষ্য বাস্তবায়নে ছয় সদস্য প্রতিনিধিদল সাব্যস্থ হয়েছে ৷

নোটঃ আমরা স্বীকৃতি নিয়ে কাজ করার শুরু থেকেই ফেসবুকে মোটাদাগের সমালোচক যারা তাদের অনুরোধ করে আসছি, এভাবে বিভ্রান্তি না ছড়িয়ে আমাদের সকল বক্তব্য ও শঙ্কা বড়দের কাছে গিয়ে বলি। তাদের কাছে বসে শ্রদ্ধার সাথে আলোচনা করে ধরিয়ে দেই। ইনশাআল্লাহ সমাধান বেরিয়ে আসবে। আমি, রশীদ জামীল ভাইসহ বার বার কসম খেয়ে বলেছি, বড়রা ঐক্যমত হয়ে যা বলবেন এদেশের সব কওমি তরুণরা তা মেনে নিবে। আপনারা এক হয়ে বলুন, স্বীকৃতি চাই বা চাই না, চাইলে এভাবে চাই। কারো কোন আপত্তি থাকবে না।

এই ঐক্য প্রক্রিয়াকে তড়ান্বিত করতে ছয় সদস্যের কমিটির জন্য শুভকামনা ও দোয়া রইল। নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারিম…..

আল্লাহ প্রত্যেকের মেহনতকে কবুল করুন।

লেখক : তরুণ গবেষক ও গ্রন্থকার

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...