এডিটর’স নোট
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ‘মিডল ইস্ট আই’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট ও সাংবাদিক পিটার ওবোর্ন যৌথভাবে রশিদ ঘানুশীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন এবং এর আলোকে ম্যাগাজিনটিতে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন লেখেন। আরব বসন্ত পরবর্তী তিউনিশিয়ার রাজনীতি ও সেখানকার ইসলামপন্থীদের কর্মকৌশল বোঝাপড়ার ধারাবাহিকতায় এটি পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী।
তিউনিসের প্রাণকেন্দ্রে আমাদের হোটেলের সদর দরজার ঠিক বাইরেই হাবিব বুরগিবার একটি স্মারক ভাস্কর্য রয়েছে।
বুরগিবাকে কেউ কেউ জাতির জনক মনে করেন, আর অন্যরা তাকে কুখ্যাত স্বৈরশাসক হিসেবেই বিবেচনা করেন। ব্রোঞ্জ নির্মিত এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে তার অতীত মহিমাই যেন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অশ্বারোহী বুরগিবা যেন সবাইকে ছাপিয়ে অনুসরণীয় হয়ে ওঠেছেন। দৃশ্যটি প্যারিসের চ্যাম্পস এলিসিতে স্থাপিত নেপোলিয়নের মূর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
তিরিশ বছর পূর্বে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বুরগিবা বিরোধী দলের একজন শীর্ষনেতাকে পুনরায় বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। ওই নেতার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে বুরগিবা যথেষ্ট মনে করেননি। তাই তিনি তাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুদণ্ডের জন্য অপেক্ষমান এই ব্যক্তিটি ছিলেন শায়খ রশিদ ঘানুশী। আরব বসন্তের আধ্যাত্মিক নেতা। বিপ্লবোত্তর তিউনিশিয়ার জনক বলে অনেকে যাকে সম্মান করে থাকেন।
বুরগিবার পর ক্ষমতায় আসেন আরেক স্বৈরশাসক বেন আলী। তিনি বুরগিবা ও তার ঘোড়ার ভাস্কর্যকে ঝেটিয়ে বিদায় করেন। পরবর্তীতে আমরা এই ভাস্কর্য সম্পর্কে শায়খ ঘানুশীর মতামত জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন:
“বুরগিবা অনেক বড় মাপের ব্যক্তিত্ব। আপনি চাইলেই তাঁকে আমাদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারবেন না। তিউনিশিয়াকে স্বাধীন করার জাতীয় আন্দোলনের তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমি তা অস্বীকার করতে পারি না। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। আমি যদিও তার ভাস্কর্যের পক্ষে নই, তবে এটি আমার জন্য কোনো সমস্যাও নয়।”
বুরগিবা ও বেন আলী দুজনেই হাজার হাজার ইসলামপন্থীকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন, নির্যাতন করেছেন এবং জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠিয়েছেন।
সংসদে আন নাহদার তুলনায় সংখ্যালঘু দল নিদা তিউনেসকে সমর্থন করা আন নাহদার জন্য কোনো সমস্যা নয়। যদিও নিদা তিউনেস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিল ইসলামপন্থীদের বিতাড়িত করা এবং সেক্যুলার শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তাদের সাথে মিলে সরকার গঠন কিংবা বর্তমান প্রেসিডেন্ট বেজি সাইদ এসেবসিকে সমর্থন প্রদান – কোনোটিতেই আন নাহদার আপত্তি নেই। উল্লেখ্য, এসেবসি ছিলেন বুরগিবা সরকারের মন্ত্রী।
নিদা তিউনেসের একটি সূত্র মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছে, আন নাহদার সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির যে সমঝোতা হয়েছে তা পরিত্যাগ করার শর্তে এসেবসির নিকট আরব আমিরাত প্রস্তাব দিয়েছিল, তিউনিশিয়াকে ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার দেয়া হবে। তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এ ব্যাপারে ঘানুশীর বক্তব্য হলো,
“আমাদের প্রেসিডেন্টের উপর আমার যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। তার দেশপ্রেমের প্রতিও আমার আস্থা রয়েছে। তাছাড়া তিনি তিউনিশীয় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। ফলে বাইরের কোনো শক্তির সমর্থনের উপর তার ক্ষমতা নির্ভরশীল নয়।”
সমঝোতার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা যা করেছেন, ঘানুশীও স্পষ্টত তাই করছেন। একইসাথে তিউনিশিয়ান এই নেতা রাজনীতির কঠিন বাস্তবতাকেও আমলে নিচ্ছেন। তার ধারণা, এসেবসিকে তিনি সঠিক পথেই রাখতে পারবেন।
“তিনি জানেন, জনগণের বিরাট একটা অংশ আন নাহদাকেও নির্বাচিত করেছে। আর সরকারকে শক্তিশালী করতে আন নাহদাকে তার প্রয়োজন রয়েছে। আবার, আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারের একটি শক্ত ভিত এবং ক্ষমতার ভারসাম্য গড়ে তোলার জন্য তার দলকে আমাদের প্রয়োজন। ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমেই ক্ষমতা টিকে থাকে। তিউনিশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার স্বার্থে প্রেসিডেন্ট, তার দল এবং আমাদের দলকে একযোগে কাজ করতে হবে। ৭০ শতাংশেরও বেশি তিউনিশীয় যে গণতন্ত্র অক্ষুন্ন রাখতে আগ্রহী তা সব জনমত জরিপে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে চক্রান্তের মাধ্যমে কারো পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া সহজ হবে না।”
তিউনিশীয় এই নেতা নিছক এ ধরনের সমঝোতার উদ্যোগেই থেমে যাননি। তার দ্বিতীয় পদক্ষেপটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
গত মাসে অনুষ্ঠিত আন নাহদার দশম কংগ্রেসে ঘানুশী যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটাই হলো প্রকৃতপক্ষে তার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণও বটে। যার বর্ণাঢ্য জীবন রাজনৈতিক ইসলামের সমার্থক বলে বিবেচিত, সেই তিনিই ঘোষণা করলেন, তার দেশে রাজনৈতিক ইসলামের আর প্রয়োজন নেই। দাওয়াতী কাজ এবং মসজিদভিত্তিক কার্যক্রম থেকে সরে এসে আন নাহদা এখন থেকে কেবল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবেই কাজ করবে। তবে এর ইসলামী চরিত্র বজায় থাকবে।
এ ব্যাপারে ঘানুশী বলেন, “আমাদের দলে কয়েকজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর এখন তাদেরকে সংসদে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে ইমামের দায়িত্বে থাকা যাবে না। ইমামের দায়িত্বে থাকতে চাইলে পার্লামেন্টে যাওয়া যাবে না। এ দুটির যে কোনো একটি তাদেরকে বেছে নিতে হবে।” এই নীতি দলের যে কোনো কর্মীর মতোই তার নিজের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হবে বলে তিনি স্পষ্ট করেছেন। উল্লেখ্য, তিনি নিজেও একজন সুপরিচিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব।
আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, এই সিদ্ধান্ত কি যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির অনুচ্ছেদ-৪ বিলুপ্তির মতোই তাৎপর্যপূর্ণ? উল্লেখ্য, ৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী লেবার পার্টি রাষ্ট্রকেই উৎপাদনের উপকরণের মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতো। কিন্তু ১৯৯৪ সালে ব্ল্যাকপুলে অনুষ্ঠিত বৈঠকে টনি ব্লেয়ার অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করেন। এর মাধ্যমে লেবার পার্টির নবযাত্রা সূচিত হয়।
সহমত পোষণ করে ঘানুশী বলেন,
“হ্যাঁ। ধর্মের সাথে না জড়িয়ে রাজনৈতিক ময়দানে কাজ করার উদ্দেশ্যে আমরা আমাদের আন্দোলনের নবসূচনা করতে চাই। আমরা আন আহদার নতুন পরিচয় তুলে ধরতে চাই। বিপ্লবের আগে আমরা মসজিদ, ট্রেড ইউনিয়ন ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মিশে গিয়েছিলাম। কারণ, তখন সত্যিকারের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন আমরা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারছি। তাই এখন আর মসজিদে রাজনীতি করার দরকার কী? বরং রাজনৈতিক দল হিসেবে আন আহদার প্রকাশ্যেই রাজনীতি করা উচিত।”
‘ঘানুশী ইসলামকেই বাদ দিয়ে দিচ্ছেন’ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন,
“আমরা সিভিল পার্টির ধারণাকে গ্রহণ করেছি। যাতে করে আমরা ইসলামের অলঙ্ঘনীয় বিষয়গুলো এবং ব্যাখ্যার সুযোগ থাকা বিষয়গুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে পারি। রাজনৈতিক ক্ষেত্র কোনো ঐশ্বরিক বিষয় নয়, অপরিবর্তনীয় ব্যাপারও নয়। এটি নাগরিক ও মানবীয় ব্যাপার। এটি ইজতিহাদ তথা স্বাধীন মানবীয় যুক্তিবোধের আলোকে পরিচালনার জন্য উন্মুক্ত একটি ব্যাপার। অনেক মুসলমানই ধর্মগ্রন্থের বিষয়বস্তু সংক্রান্ত এই শ্রেণীবিভাগকে গুলিয়ে ফেলেন। কোরআন-হাদীসের সকল অংশকেই তারা অলঙ্ঘনীয় ও তর্কাতীত মনে করেন। তাদের ধারণা, এগুলোর কেবল একটিমাত্র অর্থই হতে পারে। কোরআন-হাদীসের রাজনীতি সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ রয়েছে। আমরা এখন যা করছি, এটা ঠিক তা-ই।”
তবে রাজনৈতিক ইসলামকে তিনি পশ্চিমা ধারণা হিসেবেই দাবি করেছেন। আর অন্তত তিউনিশিয়ায় রাজনৈতিক ইসলামের সাথে ‘ইসলামিক স্টেট’ গ্রুপটিকে (আরবীতে যাদের ‘দায়েশ’ বলা হয়) গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। তাই তিনি রাজনৈতিক ইসলাম ত্যাগ করছেন।
“আমি রাজনৈতিক ইসলামের সাথে আর সংশ্লিষ্ট না থাকার অন্যতম একটি কারণ হলো, ‘দায়েশ’ এখন রাজনৈতিক ইসলামের অংশ হয়ে গেছে। তাই আমি নিজেকে ‘দায়েশ’ থেকে আলাদা করতে চাই। আমি হলাম মুসলিম ডেমোক্র্যাট, আর তারা গণতন্ত্রবিরোধী। দায়েশ গণতন্ত্রকে হারাম মনে করে। দায়েশ এবং আমাদের মাঝে বিস্তর ফারাক আছে। আমি বলছি না যে, তারা মুসলমান নয়। তবে তারা ক্রিমিনাল। তারা স্বৈরতন্ত্রী। দায়েশ স্বৈরতন্ত্রেরই আরেকটা রূপ। অন্যদিকে, আমাদের বিপ্লব হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিপ্লব। ইসলামী মূল্যবোধ গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
আত্মপরিচয়ের রাজনীতির পরিবর্তে জনগণের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিপ্লবোত্তর তিউনিশীয় রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তনের জন্য ঘানুশী চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, চারপাশের চলমান বিশৃঙ্খলা থেকে তিউনিশিয়াকে নিরাপদ রাখার এটাই একমাত্র উপায়।
যাই হোক, পরিবর্তনের এই প্রচেষ্টা ঘানুশীর দলটিকে দেশ ও বিদেশে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আন নাহদার সামাজিক শক্তিগুলো কেন দলটির প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে? মিশর, ইয়েমেন ও সিরিয়ার ইসলামপন্থী অর্থাৎ, যাদের নিরাপত্তার জন্য অনুকূল রাষ্ট্রীয় শক্তি নেই, তাদের উপর আন নাহদার এই পরিবর্তনের প্রভাব কী হতে পারে?
এই পরিবর্তনের অভ্যন্তরীণ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া নিয়ে ঘানুশী তেমন একটা ভাবছেন না। তার মতে, অনেকেই দল ছেড়ে যাবে। তারচেয়েও বেশিসংখ্যক লোক দলে যোগ দেবে বলে তিনি আশা করছেন। তবে তার এই সিদ্ধান্তের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সঙ্গত কারণেই তিনি বেশ সতর্ক। যুদ্ধের মাঝখানে দলত্যাগ করার মতো অভিযোগও তার বিরুদ্ধে আসতে পারে।
এ ব্যাপারে তিনি জোর দিয়ে বলেন, আননাহদার এ সিদ্ধান্ত শুধু তিউনিশিয়ার জন্যই। তিনি স্বীকার করেছেন, যেসব রাষ্ট্রে ইসলাম এখনো নিপীড়িত সেখানে একটি বৈপ্লবিক আদর্শ হিসেবে রাজনৈতিক ইসলাম কাজ করতে পারে। কিন্তু তিউনিশিয়ায় এর আর দরকার নেই।
মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি পরামর্শ
মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন,
“এই অঞ্চলের সকল ইসলাপন্থীদের প্রতি আমাদের উপদেশ হলো –অন্যদের সাথে মিলে কাজ করার জন্য এবং ঐক্যমত গড়ে তোলার জন্য তাদেরকে আরো বেশি উদারতার পরিচয় দেয়া উচিত। কারণ, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা ব্যতীত মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। ইসলামপন্থী-সেক্যুলারপন্থী এবং মুসলিম-অমুসলিমদের মাঝে সত্যিকারের সমঝোতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এসব পক্ষের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে স্বৈরতন্ত্রই লাভবান হয়।”
মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে ঘানুশী সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। আন নাহদা এখন থেকে আর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব দ্য মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য থাকছে না। তবে ঘানুশী নিজে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলারস এবং ইউরোপিয়ান ফতোয়া কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে থাকছেন। উভয় প্রতিষ্ঠানই অরাজনৈতিক। যদিও দুটি প্রতিষ্ঠানেরই প্রধান হচ্ছেন মুসলিম ব্রাদারহুডের শীর্ষতম স্কলার ইউসুফ আল কারজাভী।
রাজনৈতিক ইসলামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার যে ঘোষণা ঘানুশী দিয়েছেন, তা পাশ্চাত্যের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কারণ, পাশ্চাত্য এই ঘোষণাকে আধুনিকতার পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে মনে করছে। যাইহোক, আরব বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ঘোষণাকে ভীতির সাথে গ্রহণ করেছে। ইসলাম ও গণতন্ত্রের সম্মিলনের ব্যাপারে যিনি সবচেয়ে সম্মানিত কণ্ঠস্বর তিনিই কিনা এই আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন! অথচ এর সাথেই তিনি সারাজীবন জড়িত ছিলেন! – এই ধরনের হতাশা তাদের মধ্যে কাজ করছে।
ঘানুশীর চিন্তার এই পরিবর্তনের পেছনে কিছু বাস্তব কারণও রয়েছে। তিনি দেখেছেন, আরব স্বৈরতন্ত্রের অধীনে থাকা গণমানুষের জন্য দুটি উপায় রয়েছে – স্বৈরতন্ত্রকে মেনে নেয়া, নয়তো সালাফী চরমপন্থার পথ বেছে নেয়া। এর বাইরে নতুন আরেকটা পথ তিনি দেখিয়েছেন।
এ বিষয়ে ঘানুশীর সহযোগীদের বক্তব্য হলো, এটা এক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যা শুধু তিউনিশিয়ার ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। এখনই এ ব্যাপারে মূল্যায়ন করার সময় হয়নি। ঘানুশীর মেয়ে বিশিষ্ট কলামিস্ট সুমাইয়া ঘানুশী লিখেছেন,
“আমরা যে পরীক্ষা-নিরীক্ষাটি করছি, তা একান্তই স্থানীয় ব্যাপার এবং তিউনিশিয়ার প্রেক্ষাপটেই এটি প্রযোজ্য। অত্র অঞ্চলের অন্যান্য দেশে এই পদ্ধতিটিই প্রয়োগ করতে হবে, ব্যাপারটি তা নয়। প্রত্যেকটি দেশেরই নিজস্ব প্রেক্ষাপট ও সমস্যা রয়েছে। … শেষ পর্যন্ত সময়ই কেবল এ ব্যাপারে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করতে পারবে এবং কোনটা সঠিক তা বলতে পারবে। তাই এখনই কোনো ধরনের মূল্যায়ন করা যাবে না। হোক তা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক।”
নতুন পরিচয়ের আন নাহদা নাম পরিবর্তন করতেও পারে। নতুন নাম হতে পারে কনজার্ভেটিভ পার্টি। তাছাড়া সামনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ঘানুশীর প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর যে গুজব শোনা যাচ্ছে, তা তিনি একেবারে উড়িয়ে দেননি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনো সুযোগ তৈরি হলে কী করবেন – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটি নিয়ে কখনো ভাবিনি।”
তিউনিশিয়া হচ্ছে আরব বসন্তের আঁতুড়ঘর। দেশটি আবারো আরব বিশ্বকে এক নতুন পথ দেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এ প্রচেষ্টা কি সফল হবে? তিউনিশীয় গণতন্ত্র এখনো বেশ নাজুক। পর্যটন শহর সুসা’য় গতবছর সংঘটিত ব্রিটিশ পর্যটকদের উপর আইএসপন্থীদের নির্বিচার গুলিবর্ষণের ঘটনা থেকে এটি স্পষ্ট প্রমাণিত।
রাজধানী তিউনিসে ঘানুশীর সিদ্ধান্তকে বেশ সাদরেই গ্রহণ করা হয়েছে। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এ বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি, যখন রাজধানী থেকে ২’শ কিলোমিটার দক্ষিণে দেশটির কেন্দ্রে অবস্থিত শহর সিদি বুজিদে পৌঁছি। এখানেই পাঁচ বছর আগে হতাশাগ্রস্ত ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বুআজিজি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে মৃত্যুবরণ করার মাধ্যমে আরব বসন্তের সূচনা করে যান।
বিপ্লবের আগেই তো ভালো ছিলো!
বুয়াজিজি যেখানে আত্মহত্যা করেন, তারচেয়ে বড়জোর ১০০ মিটার দূরের একটি ক্যাফেতে বসে আমরা চার যুবকের সাথে কথা বলেছিলাম। তারা কফি পান করছিলো। তাদের মধ্যে মাত্র দুইজনের চাকরি আছে। এদের একজন হাতেম। তেল শ্রমিক। তিনি বললেন, “কোনোই উন্নতি হয়নি। কোনো পরিবর্তনও আসেনি।” তিনি আমাদেরকে জানালেন, তার পরিচিতদের মধ্যে এমনও লোক আছে যারা দায়েশ যোদ্ধাদের সাথে যোগ দিতে ইরাক ও সিরিয়ায় গিয়েছে। এছাড়া তিনি এমন লোকদেরও চেনেন যারা অভিবাসী হিসেবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে উত্তরে যাচ্ছে।
ক্যাফের উল্টো দিকে জুতা বিক্রেতা আবদেল কাদেরের সাথে কথা হলো। তার মতে, বিপ্লবের আগে জীবনযাপন আরো ভালো ছিল। তিনি বলেন, “এখনকার চেয়ে তখনকার দৈনন্দিন ব্যয় আরো কম ছিল।” তিনি আমাদেরকে জানান, একটিমাত্র রুমে স্ত্রী ও নয়জন সন্তান নিয়ে তিনি থাকেন। তারপরও ভাড়া পরিশোধ করতে তার হিমশিম খেতে হয়।
পাশেই কথা হলো আলী নামের আরেকজন ফলবিক্রেতার সাথে। বুআজিজি’র মতো তারও কোনো ব্যবসায়িক লাইসেন্স নেই। তিনি ভ্যানে করে তরমুজ, ডুমুর ও লেবু বিক্রি করেন। আমরা তার কাছে জানতে চাইলাম, জীবনযাত্রার কোনো উন্নতি হয়েছে কি না? তার জবাব ছিল, “বলে কী লাভ! কেউ তো শোনে না!”
আলীর কাছ থেকে আরো জানা গেলো, তার মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিজেদের ভ্যানেই রাত্রিযাপন করে। বিপ্লবের আগেই অবস্থা আরো ভালো ছিলো বলে তিনিও মন্তব্য করেন।
সিদি বুজিদের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নওফেল আল জামালী তরুণদের বেকারত্বকে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে বলেন,
“এই সমস্যাগুলো নিয়ে আমরা পাঁচ বছর আগেও কথা বলেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। জনগণ এখনো অপেক্ষা করে আছে, সরকার তাদের সকল স্বপ্ন পূরণ করে দেবে। তরুণদের জন্য এখানে কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। ভবিষ্যতের ব্যাপারেও তারা নিরাশ। ফলে তাদের সন্ত্রাসের পথে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
জাতীয় ঐক্য গঠন এবং আত্মপরিচয়ের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা অগ্রগতি সাধন করলেও দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত এখনো অনিশ্চিত। ঘানুশী এবং এসেবসির মতো নেতৃবৃন্দকে সস্তা প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিলেও পাশ্চাত্য এখন পর্যন্ত কোনো অর্থসহায়তা নিয়ে আসেনি। এ প্রসঙ্গে ঘানুশীর বক্তব্য হলো,
“আমার ধারণা, গণতন্ত্রের প্রশ্নে পাশ্চাত্য তিউনিশিয়ার চেয়ে পূর্ব ইউরোপকে বেশি সহায়তা করেছে। অথচ দায়েশ থেকে ইউরোপকে রক্ষায় তিউনিশিয়া সুরক্ষাদূর্গ হিসেবে কাজ করছে। দায়েশ তিউনিশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারলে ইউরোপ সত্যিকারের হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। লিবিয়ার ক্ষেত্রে আমরা যেমনটা দেখছি।”
তার এ যুক্তি এখন পর্যন্ত পাশ্চাত্যের সরকারগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। তিউনিশিয়ার মতো যেসব দেশ নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে চায়, পাশ্চাত্য তাদেরকে সমর্থন করার চেয়ে বরং ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে দেখার অপেক্ষায়ই থাকে।
সিএসসিএস-এর সৌজন্যে