মাওলানা আনওয়ার শাহ তাঁর বক্তব্যে কী বলেছেন আর কীভাবে বলেছেন, কথাগুলো যৌক্তিক ছিল কিনা, সেটা বিশ্লেষণের জায়গা এটা নয়, তবে ওটা ছিল। তিনি কথা বলছিলেন আপন আঙিনায়। বেফাকের সম্মেলন ছিল উলামা-মাশায়েখ সম্মেলন। উদ্দেশ্য ছিল সিনিয়াররা আল্লামা আহমদ শফীর সামনে কথা বলবেন। স্বীকৃতির স্বরূপ এবং প্রকৃতি নিয়ে খোলামেলা মত বিনিময় করবেন। স্বীকৃতি গ্রহণের লাভ-লোকসান নিয়ে ভাববেন। একটা সিদ্ধান্তে উপনিত হয়ে ব্রিফ করবেন। সঙ্গতকারণে সেখানে সিনিয়ারদের জন্য উন্মুক্ত ফ্লোর ছিল। যার যার নযরিয়া পেশ করার জন্যই ডাকা হয়েছিল তাদের। ব্যাপারটি তো এমন ছিল না যে, সবাইকে ডাকা হয়েছে বেফাকের গৃহিত কোনো সিদ্ধান্তে সমর্থন জানাতে। এমনটি হলে আল্লামা আহমদ শফী পারতেন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সবার উপর চাপিয়ে দিতে। সেটা তো করা হয়নি। তাহলে কেন এই অস্বস্থিকর উদাহরণ সৃষ্টি করাহল?
বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামের চিন্তা-ধারা এক নয়। সবার চিন্তা-চেতনা সমান হলে কেউ খেলাফত আর কেউ জমিয়ত করতেন না। কেউ শাসনতন্ত্র আর কেউ গণতন্ত্রে যেতেন না। তারমানে যদি এই হয়, আমি যে দল পছন্দ করি, শুধু সেই দলের আলেমদের সম্মান করব, বাকিদের মূল্যায়ন থাকবে না আমার কাছে, তাহলে তো ভয়াহব ব্যাপার!
দুই
গতকাল মাওলানা আনওয়ার শাহ যে ভাষায় যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা যথাস্থানে যথার্থই ছিল। ‘যথাস্থানে যথার্থ’র তর্জমা হল, যেহেতু আকাবির উলামা-মাশায়েখ স্বীকৃতি ইস্যুতে পরিষ্কার দ্বিধা-বিভক্ত, সে জন্যই ছিল বেফাকের এই আয়োজন। সবাইকে ডাকা হয়েছিল ভিন্নমতের জায়গাগুলো আলোচনার মাধ্যমে দূর করে একটা শুরাহা খুঁজে বের করবার জন্যে। আর সবার সব কথা সকলের মনের কথা হয় না, এটা দুনিয়ার নিয়মের মধ্যে পড়ে না।
যেহেতু ছিল উলামা-মাশায়েখ সম্মেলন, সুতরাং পারষ্পরিক ইখতিলাফি পয়েন্টগুলো নিয়েই তো তাঁরা কথা বলবেন সেখানে। কথা পালটা কথা, যুক্তি পালটা যুক্তির মাধ্যমে নিজেরা একটা ঐক্যেবিন্দুতে পৌঁছাবেন। বিকেলবেলা হাতে হাত রেখে সুন্দর একটা বিকেল উপহার দেবেন তাদেরকে, সারাদিন ধরে যারা তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে। কিন্তু এত সুন্দর এবং ঐক্যের বীজতলা তৈরির একটা আয়োজনে শীর্ষ আলেমদের উপস্থিতিতে তাদের সাথী একজন আলেমকে এভাবে অপমান করার অর্থ তো মঞ্চে থাকা সবাইকেই অপমান করা। এমন তো হবার কথা ছিল না!
তিন
মাওলানা আনওয়ার শাহ’র পুরো বক্তব্যটির ভিডিও লিংক প্রচারিত হয়েছে। উনার উত্থাপিত বিষ্যগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে উনার সম-পর্যায়ের সিনিয়ার আলেমরা কথা বলবেন। শুধু একটি ব্যাপারে আমরা কথা বলতে পারি। কারণ সেটির সাথে আমাদের সম্পর্ক আছে। উনার উত্থাপিত একটি পয়েন্ট ছিল-
— উলামা মাশায়েখে সম্মেলনে ছাত্ররা কেনো?
যৌক্তিক পয়েন্ট। অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি সময়ে তারচে’ও স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে কথা বলবার জন্য দেশের আলেমদের শীর্ষ মুরব্বি আল্লামা আহমদ শফী সিনিয়ার উলামা-মাশায়েখকে ডেকেছিলেন। সেই মাহফিলে ছাত্রদের এলাউ করা হবে কেনো?
বড়দের আলোচনায় তাদের কাজ কী ছিল?
স্লোগান দেয়া?
এটা তো কোনো প্রতিবাদ সমাবেশ ছিল না যে, রক্ত গরম করা স্লোগান ধরতে হবে।
— বরং আরেকটু এডভান্স হয়ে বললে এই প্রোগ্রাম তো অপেন প্লেইসে হওয়াই অনুচিত হয়েছে। জামেয়া আরজাবাদের মাঠে না হয়ে হতে পারত মাদরাসা মিলনায়তনে। যেখানে থাকতেন শুধুই শীর্ষ আলেম-উলামা। তাহলে তো এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটত না। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো এতবেশি আবেগি হয় কেনো?
চার
ঘটনাটি খুবই সামান্য আবার একেবারে সামান্যও নয়। কওমি মাদরাসাগুলো টিকে আছে আদব আর আখলাকের উপর ভর করে। এটাও যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে আর থাকে কী? মাওলানা আনওয়ার শাহ বেফাকের একজন শীর্ষ মুরব্বি। সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একজন আলেম। উনার বক্তব্যে ভুল ইনফরমেশন দেয়া হতে থাকলে সেখানে অন্যান্য বড়রা ছিলেন। দর্শক-শ্রোতারা কেনো চিল্লাফাল্লা করবে? এটা তো কোনোন পাবলিক মিটিং ছিল না। সাধারণ মানুষ তো ছিল না সেখানে।
শুনেছি মঞ্চ থেকে দু’একজন নাকি ইশারায় উস্কে দিয়েছিলেন! আমি জানি না সত্য কিনা। সত্য হয়ে থাকলে ব্যাপারটি তো আরো ভয়াবহ। তাহলে বুঝতে হবে এরাই আসলে, (যারাই হোন) নাটের আসল গুরু, বেয়াদব তৈরির কারিগর। খুঁজলে হয়ত দেখা যেতে পারে এরা তারাই, দু’হাজার তেরোতে যারা আহমদ শফীর চোখের পানিতে পা মাড়িয়ে শাপলা ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছিল।
কীভাবে ভুলে যাব আমরা! যে আহমদ শফী তাঁর ডাকে ছুটে আসা একটি ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে শোনামাত্র যায়নামাজে পড়ে গিয়ে চোখের পানিতে যায়নামাজ ভিজিয়ে দেন আর বলতে থাকেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর কাছে গিয়ে কী জবাব দেব’, সেই আহমদ শফীর সরলতার সাথে বেঈমানি করে হাজার হাজার ছেলের জীবন নিয়ে মরণখেলা করা ইতিহাসের খলনায়কের কথা আমরা কীভাবে ভুলে যেতে পারি!
সংশ্লিষ্টদের উচিত ভিডিও ফুটেজ দেখে আগে মঞ্চের এই অংশকে চিহ্নিত করা। তারপর সেই বেয়াদবদের, যারা সিনিয়ারদের মাহফিলে ঢুকে সিনিয়ারদের সামনে একজন সিনিয়ার আলেমকে এভাবে অপদস্ত করেছে!
আমরা এখনো বিশ্বাস করতে চাই এরা কওমি মাদরাসার কেউ নয়। বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী ছিল। কওমি মাদরাসা বেয়াদব তৈরি করে না। আর যদি দেখা যায় এরা কোনো না কোনো মাদরাসার ছাত্র, তাহলে সবকিছু বাদদিয়ে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংস্কারটা ঠিক কোথা থেকে শুরু করা দরকার। সিলেবাস-টিলেবাস তো পরে, আগে তো মানুষ বানানো।
পাঁচ
আজকাল আরেকটি ব্যাপার আমাকে বিস্মিত করে। মতের অমিল হলেই শুরুহয় আক্রমণ! শুরুহয় গালাগালি। কেনোরে বাবা! কারো কথা তোমার পছন্দ না হলে পালটা যুক্তি দাও। কথার জবাব কথা দিয়েই দাও। গালি দিয়ে কেনো? কোনো ভদ্র বাবার সন্তানের মুখে তো গালি শোভা পায় না। আর যদি, কথার জবাব যদি কথা দিয়ে দেওয়ার মুরোদ তোমার না থাকে, তাহলে কে বলেছে তোমাকে মক্তব ছাড়তে!
কেউ একজন তাঁর নিজের মত করে একটা মতামত লিখেছে। হতে পারে সে ভুল বলছে। হতে পারে সঠিক। সে ক্ষেত্রে আমি দু’টির একটি কাজ করতে পারি।
১, আমি তাকে বা তাঁর লেখাকে এভয়েড করতে পারি।
২, আমি পালটা যুক্তি দিয়ে তাকে ভুল প্রমাণ করতে পারি।
কিন্তু দু’টির একটিও না করে গালি-ঘায়েলের রাস্তা এখতিয়ার করার অর্থ যে নিজের ঝুড়ি শুন্যতা আর চিন্তার দৈন্যতার প্রমাণ দেয়া, এটা কি আমরা বুঝি? আমরা না বুঝলেও বাকিরা যে বুঝে ফেলে, অন্তত এটা যদি বুঝতাম।
স্বীকৃতি ইস্যুতে কথা পালটা কথা চলে। চলতেই পারে। তাইবলে লাগামহীন হতে হবে? আল্লামা আহমদ শফী তো আহমদ শফীর উচ্চতায় আছেনই। বাকিদের ব্যাপারে কি শব্দচয়নে সতর্ক হওয়ার কোনোই দরকার নাই? অন্যরা আহমদ শফী থেকে যতই ছোট হন, আমাদের থেকে যে শতগুন বড়, এটাও যদি আমরা না বুঝি, তাহলে তো ভালোই!
ছয়
স্বীকৃতি-স্বকীয়তা নিয়ে কথা চালাচালি তো আর কম হল না। এখন আমরা একটা কাজ করতে পারি মনেহয়। আমরা ছোটরা বড়দের উদ্দেশ্যে একটাই আওয়াজ তুলতে পারি-
‘আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা একসাথে বসুন। অতীত ভুলে গিয়ে বর্তমানে বসুন। এটা মেজরিটি-মাইনরিটির ব্যাপার না। এটা কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া না যে, আকসারিয়্যাত ধরতব্যে নিতে হবে। প্রশ্ন এখানে ঐতিহ্যের। প্রশ্ন অস্তিত্বের। আপনারা ভিন্ন ভিন্ন প্লাট ফরম নিয়ে রাজনীতি করুন, কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু শিক্ষানীতির প্রশ্নে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটা অ্যাপ্লাই করবেন না, প্লিজ।
আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে বলুন কী চান আপনারা। কী চাইতে হবে আমাদের। এক লাইনে বললেই হবে। এভাবে-
আমরা স্বীকৃতি চাই
অথবা
স্বীকৃতি চাই না।
খোদার কসম, আপনারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যা বলবেন, আমরা মেনে নেব। আমরা আপনাদেরই তো সন্তান। সন্তান কখনো বাবা-মাকে ছেড়ে যায়? কিন্তু মা-বাবা আলাদা হয়ে গেলে তো সমস্যা!
আর যদি, এভাবেই যদি আপনাদের মধ্যে দুরত্বের দেয়ালের প্রশস্ততা বাড়তে থাকে, তাহলে হয়ত আপনাদের চোখের সামনেই আপনাদের সন্তানগুলো লাইনে-বেলাইনে চলে যেতে থাকবে। সেটা দেখতে কি খুব ভালো লাগবে?