অনলাইন ডেস্ক :: হিটলার! সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিদের মাঝে একজন। যদিও জার্মানদের কাছে এখনও হয়ত বেশ জনপ্রিয় এই মানুষটি। কারণ তিনিই ছিলেন তাদের প্রিয় ফিউরার।
১৯৩৮ সাল চলে তখন। দেশের বেকারত্বের সমস্যা প্রায় মিটিয়ে ফেলেছেন হিটলার। এবার সামরিক শক্তি আর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে নজর দিলেন তিনি। দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে দেশের মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠলেন তিনি।
হিটলারের অভাবনীয় জনপ্রিয়তার কারণে নাৎসিবিরোধী উগ্র গোষ্ঠীগুলোর অবস্থা তখন সঙ্গীন। এমনই অবস্থার মধ্য দিয়ে জার্মানি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে। সে গল্প না হয় আরেকদিন শোনা যাবে। আজ আমরা শুনব দুনিয়ার চোখে ভিলেন, জার্মানদের চোখে তাদের প্রিয় ফিউরার হিটলারকে হত্যার কয়েকটি ব্যররথ চেষ্টার রোমহর্ষক কাহিনী। চলুন তবে শুরু করা যাক।
১৯২১: মিউনিখ বিয়ার হলের দাঙ্গা
হিটলারকে হত্যার ১ম চেষ্টাটি ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ২০ বছর আগের। ১৯২১ সাল। হিটলার তখনও তরুণ। মিউনিখের বিয়ার হলে হিটলার বক্তৃতা রাখলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন নতুন গড়া নাজি পার্টির কয়েকজন সদস্য। এছাড়াও সোস্যাল ডেমোক্রেটিক, কম্যুনিস্ট এবং আরো কিছু রাজনৈতিকভাবে বিরোধী ব্যক্তিরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হিটলারের আগুনের গোলার মতো বক্তৃতা তাদেরকে আঘাত করল। তারা তার এমন সাহসী বক্তৃতায় পাগল প্রায় হয়ে গেল। চেয়ার ছোঁড়াছুড়ি শুরু হয়ে গেল। এরই মাঝে একদল বন্দুকধারী তাদের পিস্তল থেকে মঞ্চের দিকে বেশ কয়েকবার হিটলারের দিকে গুলি চালালো। কিন্তু হিটলারের কোনো রকম ক্ষতি হলো না।
এমন পরিস্থিতির মাঝেই হিটলার আরো ২০ মিনিট তার আগুনঝড়া বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন। তিনি তার বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন যতক্ষণ না পুলিশ এসে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিল।
১৯৩৮: মাউরিস বাভাউডের কাহিনী
তখন ১৯৩৮ এর শেষের দিক। সুইস ধর্মতত্বের মাউরিস বাভাউড নামের এক ছাত্র একটি পিস্তল কিনেন। এই পিস্তলটি সাথে নিয়েই তিনি সারা জার্মানি হিটলারের পিছু নেন। ব্রাভাউড নিশ্চিত ছিলেন যে, ফিউরার হিসেবে জনপ্রিয় হিটলার আসলে ক্যাথলিক চার্চগুলোর জন্য এক হুমকি এবং সে আসলে শয়তানেরই আরেক রুপ। সুতরাং তিনি হিটলারকে হত্যা করাটা ধর্মীয় দিক থেকে গুরুদায়িত্ব হিসেবেই নিয়েছিলেন।
অবশেষে একদিন সুযোগ পেয়ে গেলেন বাভাউড। ৯ নভেম্বর, ১৯৩৮। হিটলার এবং আরো কয়েকজন নাজি নেতা একটি মার্চে অংশ নিলেন। বাভাউড তাদের চলার পথের পাশেই গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে জায়গা নিলেন। তিনি হিটলারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। পিস্তলটি তার পকেটেই ছিল। কিন্তু যখন তিনি পিস্তলটি বের করে গুলি চালাতে যাবেন তখনই জনগণ হিটলারকে দেখে দিশেহারা হয়ে গেল। সবাই তাদের হাত উঁচিয়ে তাকে নাজি স্যালুট জানাল। ফলে বাভাউডের চোখের সামনে দর্শকদের হাত দ্বারা এক পর্দা তৈরি হয়ে গেল। বাভাউড হতাশ হয়ে পড়ল এবং তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো। পরবর্তিতে সে জার্মানি থেকে পালানোর সময় ধরা পড়ে। গেস্টাপো (হিটলারের পুলিশ বাহিনী) তাকে গ্রেফতার করলে তার কাছে ম্যাপ এবং বন্দুক পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদে সে হিটলারকে হত্যাচেষ্টার কথা স্বীকার করে। ১৯৪১ সালে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
১৯৩৯: জর্জ এলসারের বিয়ার হল বোমা হামলা
জর্জ এলসার একজন জার্মান কাঠমিস্ত্রী এবং কম্যুনিস্ট ছিলেন। তিনি ঘোরতর নাজি বিরোধী ছিলেন।
তিনি মনে করতেন হিটলার জার্মানিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে আর অর্থনৈতিক দিক থেকেও পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে। সুতরাং তিনি এর সমাধান খুঁজতে থাকলেন।
১৯৩৯ সাল। বার্গার-ব্রাকেলার, মিউনিখ। এখানেই ৮ নভেম্বর হিটলারের বক্তৃতা দেয়ার কথা। হিটলার এরই মাঝে পোল্যান্ড দখল করে ফেলেছেন। ফলে তার মন মেজাজও বেশ উৎফুল্ল। বক্তৃতাটি তিনি দিবেন বিয়ার হলে। এক সপ্তাহ আগে থেকেই কড়া নজরদারীতে সবকিছু।
এতকিছুর পরেও জর্জ এলসার কিন্তু ঠিকই এই বিয়ার হলে ঢুকে পড়েন। তিনি একই সাথে দক্ষ কাঠমিস্ত্রী এবং ইলেক্ট্রিশিয়ান ছিলেন। কমুন্যিস্ট করায় কয়েক বছর জেলের ভাতও খেয়েছেন।
হিটলারের বক্তৃতা দেয়ার ২ মাস আগে থেকেই এলসার সিকিউরিটিকে ফাঁকি দিয়ে হলের ভেতরে ঢুকে যেত। হিটলার যেখানে বক্তৃতা দেবে সেখানে এক বড় আকারের পিলার ছিল। প্রতি রাতে সে পিলারের গায়ে একটা ছোট্ট খুপরি তৈরি করত। আর তারপর তা ঢেকে দিত।
হিটলারের বক্তৃতা দেয়ার সপ্তাহখানেক আগেই তার খুপরি তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হয়। তারপর সেখানে সে একটি টাইম বোমা রাখে যা ঠিক ১৪৪ ঘন্টা বা, ৬ দিন পর ৯ টা ২০ মিনিটে ফাটবে। আর ৬ দিন পর ৯ টা ১০ মিনিটে সেখানে বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল হিটলারের। হিটলারের বক্তৃতার মাঝ পথেই বোমটির ফাটার কথা ছিল। বোম সেট করেই এলসার খুশি মনে সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা হলেন।
এরপর এল সেই বক্তৃতা দেয়ার দিন। ৯ টা ১০ মিনিটে বক্তৃতা শুরু করবেন হিটলার। কিন্তু তার বক্তৃতা দেয়ার সময় এমন ছিল যে, তার ট্রেনের কারণে পাবলিক ট্রেন সার্ভিসের বিঘ্ন ঘটবে। তাই জনগণের কথা চিন্তা করে তিনি ১ ঘন্টা বক্তৃতার সময় এগিয়ে আনলেন। অনেকেই বলে এ কাজটি তিনি করেছিলেন দ্রুত বার্লিনে ফিরে যাওয়ার জন্য। কারণ কিছু মাস আগেই ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে।
হিটলার ৮ টায় বক্তৃতা শুরু করলেন, আর শেষ করলেন ৯ টা বেজে ৭ মিনিটে। ৯ টা ১২ মিনিটে তিনি ট্রেনের উদ্দেশ্যে ভবনটি ত্যাগ করেন। ৯ টা ১৭ মিনিটে তার ট্রেনটি ছাড়ে। আর তার ৩ মিনিট পরেই বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটে। বোমা হামলায় ৮ জন নিহত আর ৩৬ জন আহত হয়। পরবর্তিতে এলসার গেস্টাপোদের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এভাবেই আবারো অস্বাভাবিকভাবে বেঁচে গেলেন হিটলার।
অনেকেই সন্দেহ করে যে, এই বোমা হামলার ঘটনা সাজানো ছিল ব্রিটেনকে দায়ী করার জন্য। কিন্তু সম্ভবত তা সত্য নয়। অধিকাংশ ইতিহাসবিদরা মনে করেন হিটলার এ হামলা সম্বন্ধে কোনো কিছুই জানতেন না।
হিটলারকে হত্যার আরো অনেক অনেক চেষ্টা হয়েছে। প্রায় ৩০ টিরও বেশি। কোনোটিই কখনও সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত হিটলারকে কেউই হত্যা করতে সক্ষম হয়নি, হিটলার নিজে বাদে। ১৯৪৫ সালে তিনি নিজেই আত্মহত্যা করেন।
হিটলারকে হত্যাচেষ্টার কিছু কাহিনী আজ তো শুনলেন। বাকিগুলো না হয় অন্য কোনো দিন শোনা যাবে। সেই পর্যন্ত ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্রঃ
১। http://www.history.com/
২। http://www.somewhereinblog.net/