জুনাইদ কিয়ামপুরী ::
ফেইসবুকীয় পাবলিক লাইক আমাদের এতো উম্মাদ বানিয়েছে যে, খেই হারিয়ে ফেলেছি। ধুয়া তুলসি পাতা সেজে স্টেটাস উগড়ে দিচ্ছি, অতি পরহেজগারিতা দেখাতে স্বীকৃতিটাকেই কদর্য এবং অশুভ ভাবছি।বলছি স্বীকৃতি একটা গজব। অথচ এই স্বীকৃতি নিয়ে কথা চলছে বহু আগ থেকেই। শায়খুল হাদিস আজিজুল হক রহ, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ, এর মতো জ্ঞানপ্রবর ব্যক্তিবর্গ এই স্বীকৃতির জন্যে আন্দোলন করেছেন। রাজপথে মিটিং মিছিল করেছেন।তারা কি এই তথাকথিত ‘গজব’ চিনেন নি বুঝেন নি? তারা কি উত্তর প্রজন্মকে একটি গজব আর কদর্য বিষয় উপহার দেয়ার জন্যেই এত ত্যাগ আর সংগ্রাম করেছিলেন!? আমাদের চিন্তার অধঃপাত দেখে ভাবতে অবাক লাগে!
মনে রাখতে হবে, জাতীয় এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে উভয় পক্ষেই মান্যবর হজরাত উলামায়ে কেরাম রয়েছেন। আমার বোধগম্য না হলে কোনো পক্ষকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
শুধু যে স্বীকৃতিকে ঘিরে কাঁদা ছুড়াছুঁড়ি হচ্ছে এমন নয়।অতীতে বহু ঠুনকো বিষয় নিয়েও আমরা অনভিপ্রেত কথাবার্তা বলেছি। স্বীকৃতি না হয়ে যদি অন্য কোনো বিষয় হতো, সেটা নিয়েও আমরা এভাবেই কাঁদা ছুড়াছুঁড়ি করতাম। বিভক্ত হতাম।জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের একজন খতিব প্রস্তাবেও আমরা একমত হতে পারি নি। প্রত্যেকেই যার যার পছন্দসই ব্যক্তি ও দলের কথা মাথায় রেখে কথা বলেন, ভিন্ন মত পথের ব্যক্তিকে থোড়াই কেয়ার করেন। প্রয়োজনে আক্রোশাত্মক ভাব নিয়ে কটাক্ষ করতেও দ্বিধা করেন না। দোষটা স্বীকৃতির নয়, আমাদের কুৎসিত মানসিকতার।
আমাদের দায়িত্ব ও পরিমণ্ডল বুঝা দরকার। যে কোনো উদ্ভুত সমস্যার নিরসন সম্ভব হয় দুটো উপায়ে, একটি হচ্ছে সমাধান। অপরটি হচ্ছে যথাযথ সহায়তা প্রদান ও পরামর্শ প্রদান।সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে বড়দের কাজ। সেই সমাধানে সহায়তা করা কিংবা সুন্দর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ছোটদের কাজ।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা আমাদের কাজের পরিধি ছাড়িয়ে বড়দের কাজ নিয়ে টানাটানি করছি। নিজেদের মতো করে ফয়সালা এবং সমাধান দিচ্ছি। এর বিপরীতে ঠিক উল্টো সমাধান দিচ্ছে আমার মতো আরেকজন ।ফলে সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হচ্ছে না। উল্টো পানি আরো ঘোলাটে হচ্ছে। এভাবেই মত আর প্রত্যাভিমতের দ্বন্ধে জড়িয়ে আছি আমরা।এটি কাম্য নয়,এই দ্বন্দ্ব সংঘাত বন্ধ হোক।
আমি বিশ্বাস করি! শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফি হাফিজাহুল্লাহ আল্লাহর নৈকট্যশীল নুসরাতপ্রাপ্ত বান্দা। তাঁর ধ্যান ও মনন স্বচ্ছ। বৃদ্ধ হলেও তাঁর ফারাসাত বা দিব্যদৃষ্টি এখনো লুপ্ত হয় নি।ইনশাআল্লাহ এই নুরানি বক্ষ থেকে কল্যাণকর সমাধান বেরিয়ে আসবেই।
মূলত স্বীকৃতি নিয়ে কারো বিরোধ আছে বলে আমার জানা নেই।বিরোধটা হচ্ছে এই স্বীকৃতির মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসা সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে কী-না? একপক্ষ মনে করেন চলে যাবে।আরেক পক্ষ মনে করেন চলে যাবে না।ভাবনার দিক থেকে কোন পক্ষ সঠিক অবস্থানে! তা নিরুপণের দায়িত্ব আমাদের নয়। এর সমাধান করবেন তারা, যারা তাদের মতোই বড়।আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, এই সংকট নিরসনে সম্ভব হলে তাদের কে সুন্দর পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা। অন্যথায় মৌনতা অবলম্বন করে তাদের জন্যে দুয়া করতে থাকা।অভিযোগের আঙ্গুল তুলে তাঁদেরকে হেনস্থা করা নয়।
কওমির জন্য সরকারি নিয়ন্ত্রণ যে ক্ষতিকারক এ-কথা অস্বীকার করবে কে?
যদ্দুর জানি, এব্যাপারে কারো এখতেলাফ নেই। যদি কারো দ্বিমত থাকে, বুঝতে হবে, হয় সে কওমির বে-আক্কেল দুস্ত! না হয় সে বাহ্য কওমি হলেও আদতে ও আসলিয়তে অন্যদের প্রোডাক্ট।
আমাদের সনদের সিলসিলা যুক্ত রয়েছে মহান আল্লাহ এবং রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে।
কোন সরকার করবে স্বীকার বলো কি দরকার? আমরা তো সেদিনই স্বীকৃত হয়েছি, যেদিন আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেছেন : يرفع الله اللذين آمنوا منكم واللذين أوتوا العلم درجات অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম দেওয়া হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। কারো কাছ থেকে স্বীকৃতি আনার দরকার নেই আমাদের। এই ইচ্ছেও নেই।তবে আমরা যেহেতু মুসলমান আবার এই দেশের নাগরিক। সেহেতু ইসলামি হোক কিংবা জাগতিক,যে কোনো ধরণের শিক্ষা গ্রহণ করি না কেন! যোগ্যতা থাকলে দেশের যে কোনো ভার্সিটিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাওয়া আমাদের নাগরিক অধিকার।আমরা আমাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত।
আন্তর্জাতিক সাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি দশ জন ব্যক্তির জন্যে একজন ডাক্তার আবশ্যক।সুস্থ নিরাপদ জীবন-যাপনের জন্যে যেমন শারীরিক সুস্থতার দরকার, তেমনি দরকার আত্মিক সুস্থতারও। দেহের সুস্থতার জন্যে প্রতি দশজনে যদি একজন চিকিৎসক আবশ্যক হয় তবে আত্মা ও হৃদয়ের সুস্থতার জন্যে প্রতি দশজনে একজন রুহানি চিকিৎসক তথা আলিম ও মুফতির প্রয়োজন কেন আবশ্যিক হবে না? তাই সরকার মহুদয়ের জন্যে বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত ছিল এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কওমি মাদ্রাসাকে তাঁর অবস্থানে রেখে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়া উচিত।তাহলেই সমস্যার সমাধান সহজেই হয়ে যাবে। দেশও অনেক এগিয়ে যাবে।যেভাবে এগিয়ে গেছে মাহাথির মুহাম্মদের দেশ আধুনিক মালয়েশিয়া।
লেখক : গ্রন্থকার ও প্রাবন্ধিক