উত্তর প্রদানে ড. আবুল কালাম আজাদ ::
প্রশ্নঃ এক শায়খের আলোচনায় শুনলাম যে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ‘মাওলানা’ ভাবা যাবে না, ও বলা যাবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ‘মাওলানা’ ডাকলে বা বললে শিরক হয়ে যাবে। অথচ পাক ভারত উপমহাদেশের উপমহাদেশের আলেমরা নিজেদেরকে ‘মাওলানা’ বলেন। এমনকি উনাদেরকে ‘মাওলানা’ না বললে আপমানিত বোধও করতে পারেন। আশাকরি, আপনার কাছে একটা সুন্দর ব্যাখ্যা পাবো।
উত্তরঃ
আপনাকে অনেক শুকরিয়া এই প্রশ্নটার জন্যে। আমার মনে হয়ে এই ধরণের একটা প্রশ্নের উত্তর আগে দিয়েছিলাম।
যেহেতু, উপমহাদেশের উলামায়ে কেরাম এই শব্দটা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করছেন তাই এইটা একটা শিরকের কাজ বলার আগে আমাদের অনেক কিছু বুঝতে হবে ও বিবেচনা করতে হবে। আমি মোটামুটি সংক্ষেপে আলোচনা করে শেষের দিকে আমার মতামত বলব, ইনশাআল্লাহ।
আরবি তে ‘মাওলানা’ একটা যৌগিক শব্দ; মানে দুইটা শব্দের যুক্তকরণে এটা করা হয়েছে। ‘মাওলা’ + না, মানে হলো আমাদের মাওলা। এখন আমাদেরকে বুঝতে হবে মাওলা শব্দের অর্থ কি এবং আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলুল্লাহ (স) বা সাহাবায়ে কেরাম এই মাওলা শব্দ কোথায় কোথায় কি কি অর্থে ব্যবহার করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে প্রায় ৪ টি অর্থে ‘মাওলা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।
১- আল্লাহ আমাদের বলতে বলেছেন যে ‘হুয়া মাওলানা’ (তিনি আমাদের মাওলা) (সূরা বাক্বারাহঃ ২৮৬, ও সূরা তওবাঃ ৫১)। এই মাওলার মানে হলো তিনি আমাদের অভিভাবক, যার ওপর নির্ভর করা যায়।
এই অর্থে আল্লাহ ছাড়া কাউকে মাওলা বা মাওলানা বলা যাবে না।
২- জাহান্নাম কেও ‘মাওলা’ বলা হয়েছে (সূরা হাদীদঃ ১৫)। এই মাওলার অর্থ হলো ঠিকানা। এই অর্থে স্থান বিশেষে ‘মাওলা’ বা মাওলানা বলা যাবে।
৩- মাওলা মানে বন্ধু। সূরা মুহাম্মাদের ১১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- যারা ইমান এনেছেন আল্লাহ তাদের মাওলা, কিন্তু কাফিরদের কোন ‘মাওলা’ নেই।
এই অর্থে যে কাউকেই ‘মাওলা’ বলা যাবে।
৪- সূরা তাহরীমের ৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন তারা যদি তার (নবীর) বিরুদ্ধে এক অপরকে সাহায্য করে তাহলে আল্লাহই তার মাওলা, আর জিব্রাঈল ও ভালো মুমিনেরা। তাফসীরে জালালাইনে বলা হয়েছে যে- এখানে আল্লাহ, জিব্রাঈল ও মুমিনদেরকেও নবীর ‘মাওলা’ বলা হয়েছে।
এবার আসুন আমরা হাদীসের কিছু বিবরণ নিয়ে আসি।
সুনানে আবু দাঊদে (হাদীস নং ২৯০০) একটা সহীহ সনদে পাওয়া যায় যে উত্তরিধার সম্পত্তির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- যার কোন ‘মাওলা’ নেই, আমি তার ‘মাওলা’। এখানে সম্পত্তির অভিভাবক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি যার শুধু মামা আছেন, হাদীসে তাকেও ‘মাওলা’ বলা হয়েছে।
মাজমা’ আয-যাওয়ায়েদে (৯/১০৬) একটা সহীহ হাদীসে পাওয়া যায়- একবার ‘রাহবা’ এলাকাতে একদল প্রতিনিধি আলী (রা) এর সাথে সাক্ষাৎ করেন, যাদের মধ্যে আবু আইঊব আনসারী (রা)ও ছিলেন। তারা আলী (রা) কে সালাম দিয়ে বললেন ‘আসসালামু আলায়কুম ইয়া মাওলানা’। তখন আলী (রা) বললেন- আমি তোমাদের ‘মাওলা’ হলাম কি করে- হে আরব সমাজ? তখন তারা বললেন- গাদীর খুমদের দিন আমরা রাসূলুল্লাহ (স) কে বলতে শুনেছি যে- আমি যার ‘মাওলা’ ইনি (আলী) ও তার মাওলা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (স) নিজেও নিজকে ‘মাওলা’ বলেছেন।
যেমনঃ
(1) আল কোর’আনের সুরা নাহলের 76 নং আয়াতে মনিব অর্থে বলা হয়েছে “هو كل على مولاه” (সে তার মনিবের উপর বোঝা।)
(2) রাসুলুল্লাহ (ﷺ) যায়েদ ইবনে হারিসাকে বলেন- “أتت إخوانا ومولانا” অর্থাৎ তুমি আমাদের ভাই এবং মাওলানা তথা বন্ধু। (বুখারি শরিফ 1/528)
(3) অন্যত্র নাবিয়ুল কারিম গোলামদেরকে শিখিয়েছেন, তারা যেন তাদের মনিবকে বলে- “سيدي و مولاي” (সায়্যিদি ওয়া মাওলায়ি) অর্থাৎ আমার নেতা এবং মনিব। (বুখারি শরিফ 1/346)
(4) “اللهم صلي على سيدنا ومولانا محمد”
(আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সায়্যিদিনা ওয়া মাওলানা মুহাম্মাদ) এই দুরুদে তো রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কে মাওলানা বলাই আছে।
(5) ইমাম হাসান রা: কে মানুষ শ্রদ্ধা করে মাওলানা হাসান বসরি বলে ডাকতো। তাহযিবুত তাহযিব 2/263, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া 9/266
এ ছাড়া আরবিতে মুক্ত করে দেওয়া দাসদেরকেও ‘মাওলা’ বলা হত। যেমন ‘নাফে’ মাওলা ইবনে উমার’।
এতগুলো প্রমাণ নিয়ে আসার পর আমরা বলতে পারি- যারা উলামা বা শায়খদেরকে ‘মাওলানা’ বলাকে শিরক বলেছেন তারা ‘মাওলা’ শব্দের একটা অর্থই নিয়েছেন। ‘মাওলা’ শব্দ যে আল্লাহ ছাড়া নবী (স), সাহাবী, মুক্তকরা দাস, জিব্রাঈল, ভালো মুমিন ও জাহান্নামের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে যে কথা তারা ভুলে গিয়েছেন। যেখানে কোরআনে ও হাদীসে ‘মাওলা’ শব্দের ব্যাপক অর্থ আছে বা ব্যবহার করা হয়েছে আমরা সেখানে তা সংকোচন করব কেন?
আর আমাদের উপমহাদেশে ‘মাওলানা’ একটা একাডেমিক উপাধী। যারা মাদ্রাসা শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত তাদেরকে এই উপাধী দেওয়া হয়। এই উপাধী পাওয়ার জন্যে ইসলামী লাইনে প্রায় ১৬ বছর গভীর ও কঠোর পড়াশুনা করা লাগে। এতো বছর পড়াশুনা করার পর যিনি যোগ্যতা অর্জন করেন তার ওপর জ্ঞানের ব্যাপারে নির্ভর করা যায়। তিনি মুমিনদের বন্ধু। তিনি মুমিনদের অভিভাবক।
এই অর্থে শায়খদেরকে বা উলামায়ে কেরামকে ‘মাওলানা’ বলা যাবে। এটা অবশ্যই শিরক হবে না। কারণ যে অর্থে আমরা আল্লাহকে ‘মাওলা’ বলি, সেই অর্থে আমরা শায়খদেরকে ‘মাওলানা’ বলি না। ফলে, এটা নিয়ে আর বিভ্রান্ত হওয়া সুযোগ নেই।