সাঈদ হোসাইন ::
অহীর প্রথম বাণীই হল ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা-আলাক,১) অর্থাৎ হে পুরুষ তুমিও পড়ো, হে নারী তুমিও পড়ো। হাদীছে বলা হয়েছে, ‘ইলম অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয’। (সুনানে ইবনে মাজা,২২৪) মুসলিম বলতে নারী-পুরুষ উভয়ই এর অন্তর্ভুক্ত। এ হদীছ নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। এছাড়া ইলম অন্বেষণের যত ফযীলত হাদীছে বর্ণিত হয়েছে তা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই। ছাহাবা কেরামের যুগে নারীরা উম্মাহাতুল মুমিনীনের মাধ্যমে তো ইলম অর্জন করতেনই, এমনকি মসজিদের দরজায় এসে বেলাল (রাঃ) এর মাধ্যমে প্রশ্নও পাঠাতেন। নবীজী (সাঃ)ও নারীদেরকে নিজ উদ্যোগে একত্র করে উপদেশ ও শিক্ষাদান করেছেন। বুখারী শরীফের ‘ইলম অধ্যায়ে’ ইমাম বুখারী (রহঃ) আলাদা একটি শিরোনাম রেখেছেন ‘নারীদের শিক্ষাদানের জন্যে পৃথক একটি দিন নির্ধারণ করা হবে কি না?’ তাতে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীছ এসেছে। ‘(তিনি বলেন,) নারীরা নবীজীকে (সাঃ) বলল, পুরুষেরা আপনার বিষয়ে আমাদেরকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য আপনার পক্ষ হতে একটি দিন নির্ধারণ করুন। তখন তিনি তদের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করলেন এবং ঐ দিন তদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। অনন্তর তাদেরকে উপদেশ দিলেন এবং আদেশ দিলেন।'(সহীহ বুখার- ইলম অধ্যায়,১০১)
এরূপ অন্য ঘটনায় আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে- তিনি বললেন (নবীজী [সাঃ]), তোমাদের সাথে সাক্ষাতের স্থান হল অমুক স্ত্রীলোকের বাড়ি। অতঃপর তিনি তাদের নিকট গেলেন এবং আলোচনা করলেন। বর্ণিত আছে যে, জনৈকা স্ত্রীলোক নবী (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পুরুষেরা তো আপনার উপদেশ এককভাবে নিয়ে গেল। সুতরাং আমাদের জন্য আপনি একটি দিন নির্ধারণ করে দিন যখন শুধু আমরা আপনার কাছে আসবো। আপনি আমাদের ঐ ইলম থেকে শিক্ষা দান করবেন যা আল্লাহ আপনাকে শিক্ষা দান করেছেন। নবীজী (সাঃ) এ আবেদন গ্রহণ করে বললেন, তোমরা অমুক অমুক দিন একত্র হও। (সহীহ বুখারী, ইলম অধ্যায়) এসব হাদীছ থেকে বুঝা যায় সে যুগে নারীসমাজের মধ্যে ইলমের কী পরিমাণ তলব ছিল।
‘তাকে ইলম শিক্ষা দিল এবং উত্তম শিক্ষা দিল, আর তাকে আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিল এবং উত্তম শিক্ষা দিল।’ (সহীহ বুখারী, ইলম অধ্যায়) এ হাদীছে পুরুষকে তার অধীন নারীকে উত্তম শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, আর এর বিনিময়রূপে জান্নাতের ঘোষণা এসেছে।
‘উম্মুল মুমিনীন আয়েশা বিনতে আবী বকর (রাঃ) নবী (সাঃ)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী। নারীদের মধ্যে শরীয়ত ও ফিকহবিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারিণী। বহু হাদীছ তাঁর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। নারীদের মধ্যে একমাত্র তারই ইজতিহাদের যোগ্যতা ছিল। তাঁর নিকট ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা হত এবং তিনি ফতোয়া প্রদান করতেন। পুরুষ ছাহাবাদের ফতোয়া অনেক সময় তিনি রদ করতেন। আরব জাহিলিয়াতের কবিতা তাঁর মুখস্ত ছিল। বংশবিদ্যায়ও তিনি পারদর্শিনী ছিলেন। শিক্ষায়-দীক্ষায়, জ্ঞানে-গুনে তিনি সর্বযুগের মুসলিম নারীসমাজের আদর্শ। কিন্তু আফসোস, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুসলিমজাতি আজ বলতে গেলে তাঁর আদর্শ প্রায় ভুলে গেছে। তাই মুসলিম নারীসমাজ এখন অশিক্ষা ও মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত।’ [সাধু ভাষা থেকে চলিত ভাষায় রূপান্তরিত] (হাদীছের আলো জীবনের পাথেয়- তরজমাঃ উম্মে আব্দুল্লাহ, পৃষ্ঠা-৩০৩)
নারীসমাজের ইলমচর্চার এ ধারা পরবর্তী যুগেও অব্যাহত ছিল। ‘ইলমী অঙ্গনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন এমন নারীর সংখ্যাও ইতিহাসে কম নয়। হাফেজ ইবনে হাজার (রহঃ) তাঁর ‘আল ইসাবাতু ফি তাময়িজিস সাহাবা’ কিতাবে পনের শত তেতাল্লিশ জন মহিলার জীবনী উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অনেক ফকীহ, মুহাদ্দিস ও সাহিত্যিক। অনুরূপভাবে খতীব বাগদাদী (রহঃ) তাঁর ‘তারীখু বাগদাদ’ কিতাবে, ইমাম নববী (রহঃ) তাঁর ‘তাহজীবুল আসমা-ই ওয়াল লুগাত’ কিতাবে, সাখাবী (রহঃ) তাঁর ‘আদদাউ-উল লামে’ কিতাবে এবং ‘তাবাকাত’ ও ‘তারাজিম’- এর অন্যান্য কিতাবের লেখকবৃন্দ নিজ নিজ কিতাবসমূহে হাদীছ, ফিকাহ, তাফসীর, সাহিত্য ও কাব্যসহ বিভিন্ন অঙ্গনের অনেক মহিলার বিস্তারিত জীবনী উল্লেখ করেছেন। প্রসিদ্ধ আরব লেখক উমর রেজা কাহ্হালা তো ‘আ’লামুন নিসা ফি আলামিল আরব ওয়াল ইসলাম’ [আরব জাহান ও ইসলামী দুনিয়ার বিশিষ্ট মহিলা] নামে বড় বড় পাঁচ খণ্ডের সুবিশাল এক গ্রন্থই রচনা করে ফেলেছেন। আমাদের হযরত হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানভী (রহঃ)ও ‘বেহেশতী জেওর’ কিতাবের অষ্টম খণ্ডে ইতিহাসের আদর্শ একশত নারীর আলোচনা করেছেন। তো নারী হওয়া ইলমী অঙ্গনে বড় হওয়া এবং বড় বড় ইলমী খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার জন্য প্রতিবন্ধক নয়।’ (শিক্ষার্থীদের সফলতার রাজপথ- মাওলানা সফিউল্লাহ ফুআদ, পৃষ্ঠা- ৯২-৯৩)
‘অভিজ্ঞতার আলকে দেখা গেছে যে, কোন সমাজে পুরুষ আলিম থাকলেও তার দ্বারা নারীদের সকল দীনী প্রয়োজনের সমাধান হয় না। প্রথমত পর্দার কারণে -যা অতি গুরুত্বপূর্ণ ফরয- সব নারীর পক্ষে পুরুষ আলিমের নিকট যাওয়া সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে কোন পুরুষের মধ্যস্থতার সাহায্য যে নেবে, কারও কারও পক্ষে তাও সম্ভব হয় না। হয়ত কারও এমন আপন পুরুষ ব্যক্তিও নেই, যার সাহায্যে আলিমের নিকট থেকে সমস্যার সমাধান জেনে নেওয়া যায়। আর কারও যদি থাকেও তবে দেখা যায় যে, খোদ পুরুষেরই দীনের প্রতি কোন গুরুত্ববোধ নেই। এরূপ পুরুষ নারীদের বিষয়াদি নিয়ে কোন আলিমের কাছে সমাধানের জন্য যাবে, তা কতটুকুই বা আশা করা যায়। তাই এরূপ নারীদের বেলায় দীনী বিষয়ে কোন সমস্যার সমাধান জেনে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আর যদি ঘটনাক্রমে কোন নারী কোন আলিমের নিকট যেতে সমর্থ হয়ও অথবা কারও ঘরেই পিতা, ছেলে, ভাই প্রমুখ আলিম থাকে তবু এমন কিছু বিষয় আছে, যা নারীরা অন্য পুরুষের কাছে জিজ্ঞেস করতে লজ্জাবোধ করে। নারীর একান্ত বিষয়াদি অকপটে জিজ্ঞেস করা যায় কেবল স্বামীর কাছে, কিন্তু সবার স্বামী তো আর আলিম থাকে না। তাই নারীদের যাবতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য কেবল একটি পথই খোলা থাকে। আর তা হল মহিলা আলিমা তৈরী করা, যাতে সাধারণ নারীরা তাঁদের যাবতীয় দীনী সমস্যার সমাধান তার নিকট থেকে জেনে নিতে পারে। তাই প্রচলিত নিয়মে কিছু নারীকে দীনী শিক্ষা দেওয়া ওয়াজিব। উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা এটা প্রমাণিত হল যে, পুরুষের ন্যায় নারীদেরও দীনী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া আবশ্যক।’ (বেহেশতী জেওর- অনুবাদঃ মাওলানা আহমদ মায়মূন, পৃষ্ঠা- ৪৯-৫০)