সালমান তারেক শাকিল ও চৌধুরী আকবর হোসেন : কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির প্রশ্নে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক)। সরকারের গঠিত ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন’-এর সুপারিশের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আপত্তি জানিয়ে তা বাতিল চাইবে বেফাক। পাশাপাশি নতুন ও সংক্ষিপ্ত নীতিসমৃদ্ধ প্রস্তাব তুলে ধরবে কওমি মাদ্রাসার সবচেয়ে বড় এই বোর্ডটি। আগামী ৩ অক্টোবর সোমবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিতব্য সব বোর্ডের সম্মিলিত সভায় এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে এ মাসেই সরকারের কাছে প্রতিনিধি দল পাঠানো হবে। বেফাকের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল একাধিক আলেমের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানা গেছে।
এ ব্যাপারে বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি শায়খুল হাদিস আল্লামা আশরাফ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আগামী সপ্তাহে সাব-কমিটির বৈঠক হবে। আগামী সোমবার আঞ্চলিক বোর্ডগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এরপর এ মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করব। তাকে লিখিত আকারে আমাদের সুপারিশ দেব।’’
বেফাকের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মাহফুযূল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসা স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান। বিগত কমিশনের সুপারিশ নিয়েই আমাদের আপত্তি আছে। এই আপত্তিগুলো আমরা বের করেছি। আমরা সবগুলো বোর্ড একসঙ্গে বসে ঠিক করেছি, কিভাবে স্বীকৃতি আনব।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বীকৃতির বিরুদ্ধে নই আমরা। কিন্তু মাদ্রাসার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ঠিক রেখে সরকার যদি সনদের স্বীকৃতি দেয়, তাহলে গ্রহণযোগ্য হবে। এক্ষেত্রে সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাব তুলে ধরব। সব বোর্ড একসঙ্গে প্রস্তাব দিলে সরকার অগ্রাহ্য করতে পারবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার এই প্রিন্সিপাল।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে সরকারের কাছে প্রদেয় শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি আছে বেফাকের। এর মধ্যে ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠাকল্পে প্রণীত আইনের খসড়ার বিরোধিতা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আপত্তি যে বিষয়ে, সেটি হচ্ছে, ‘কর্তৃপক্ষ গঠন’ ধারার ২ উপধারার ‘সরকার কর্তৃক নিয়োগ্যকৃত সদস্য এক জন যুগ্ম-সচিব ও তদূর্ধ পদমর্যাদার’। চেয়ারম্যান নিয়োগ ও সদস্যদের নিয়োগ, পদত্যাগ, অব্যাহতি ইত্যাদি: প্যারার ধারা ১-এর ‘কওমি ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত ও ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ শীর্ষ পর্যায়ের আলেম চেয়ারম্যান এবং ধারা ৫-এর-খ- এ উল্লিখিত সদস্য সরকার কর্তৃক নিয়োগ হইবেন।’
মাওলানা মাহফুযূল হক মনে করেন, ‘সরকার কাউকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া এবং সরকারের প্রতিনিধি থাকা মানেই হচ্ছে প্রতিষ্ঠান সরকারের চাহিদা মোতাবেক চলবে। এটা হতে দেওয়া যাবে না। সরকারের পছন্দমতো চেয়ারম্যান নিয়োগ মানেই, তিনি যা চাইবেন; তা। ফলে, এতে কওমি মাদ্রাসার বিনষ্ট হবে। এছাড়া যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার যিনি থাকবেন, তিনিও তো সরকারের।’
যদিও কমিশনের সদস্য সচিব গহরডাঙ্গা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা রুহুল আমিন মনে করেন, ‘সরকারের স্বীকৃতি লাভ করতে হলে দেশের আইন-কানুনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে। আমরা চেয়েছি কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বীকৃতি আদায় করতে। এখন বেফাকের মনের ভেতরে কী আছে, তা তো বলতে পারব না। তবে তারা যদি ভালো স্টাডি করে দেখেন, তাহলে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে তো কিছু ছাড় দিতেই হবে।’
বেফাক সূত্রে জানা গেছে, সোমবার আঞ্চলিক বোর্ডগুলোর বৈঠক ডাকা হয়েছে হাটহাজারী মাদ্রাসায়। ওই বৈঠকেই আল্লামা শফীর উপস্থিতিতে স্বীকৃতির প্রশ্নে কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে আপত্তি জানানোসহ সরকারের কাছে প্রস্তাব দিতে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ঠিক করা হবে। বেফাকের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আঞ্চলিক বোর্ডগুলোকে ঐকমত্যে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। গত মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করেছেন বেফাকের কয়েকজন কর্মকর্তা। গতকাল শনিবার রাজধানীর বারিধারা মাদ্রাসায় বেফাকপন্থীর একটি বৈঠকও হয়েছে। এই সব বৈঠকের চেষ্টাই হচ্ছে কমিশনের প্রতিবেদন বাতিল করে বেফাকের মাধ্যমে সনদের স্বীকৃতি আনার নতুন প্রস্তাব পাস করানো।
যদিও মাওলানা মাহফুযূল হক বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি সব বোর্ডকে এক সিদ্ধান্তে নিয়ে আসতে। এখানে রাজনৈতিক কোনও অভিসন্ধি নেই।’
গত বৃহস্পতিবার হাটহাজারী মাদ্রাসায় কমিশনের প্রতিবেতনের বিষয়ে আপত্তি ওঠে। এরপর আল্লামা আশরাফ আলীকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কমিশনের সুপারিশ, এর ‘ত্রুটি-বিচ্যুতি’ নিয়ে লিখিত প্রস্তাবনা দেবে।
বৃহস্পতিবার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শফীর নির্দেশে গঠিত সাব-কমিটির প্রধান আশরাফ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের লোক চেয়ারম্যান, আমাদের লোক সচিব, আমরা পরীক্ষা নেব, এসব ঠিক রেখে স্বীকৃতি দিলে নেব। আমি স্বীকৃতির জন্যই কাজ করছি। একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আমরা লিখিত আকারে আমাদের প্রস্তাবনা দেব।
বেফাকের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, স্বীকৃতির জন্য ভিন্ন কমিশন, ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনও কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন মনে করা হচ্ছে না। এমনকি সিলেবাস প্রণয়নের প্রয়োজন নেই বলেও মনে করে বেফাক। এক্ষেত্রে সূত্রের যুক্তি, মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে দারুল উলুম দেওবন্দসহ লালবাগ মাদ্রাসা, কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়া ও হাটহাজারী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস পাস করে আলিয়া মাদ্রাসা, সরকারি মসজিদ ও ঈদগাহে ইমামতি করার সুযোগ ছিল। বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব উবায়দুল হকও দারুল উলুম দেওবন্দের সনদ দিয়ে সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন। যদিও ১৯৭৬ সালের জিয়াউর রহমান সরকারের সময়ে মাওলানা আবদুল মান্নান মন্ত্রী হওয়ার পর এই সুযোগটি নষ্ট হয়। এজন্য আলেমদের অনেকে তাকে দায়ী করেন।
মাওলানা মাহফুযূল হক জানান, ‘কোনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। সবগুলো বোর্ড মিলে একটি কমিটি করবে। এই কমিটির উদ্যোগ সনদ দেওয়া হবে। সরকার শুধু এই সনদকে স্বীকৃতি দেবে। সনদকে কেন্দ্র করে তো কওমি মাদ্রাসার ভবিষ্যৎ বিনষ্ট হতে পারে না।’
জানা গেছে, আঞ্চলিক বোর্ডগুলোর সমন্বয়ে বেফাকের নেতৃত্বে একটি কমিটি হবে, সেই কমিটির অধীনেই সনদের স্বীকৃতি দিতে সরকারকে আহ্বান জানানো হবে। এই কমিটির প্রধান হিসেবে মাওলানা আশরাফ আলী, জুনায়েদ বাবুনগরী, আবদুল হালিম বোখারী, সুলতান জওক নদভীসহ সিনিয়র আলেমদের কথা ভাবা হচ্ছে। তবে বেফাক মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার, সহ-সভাপতি নূর হোসাইন কাসেমীর সম্ভাবনা নেই বলে বেফাকের দায়িত্বশীল সূত্র দাবি করে। এর মধ্যে দীর্ঘদিন বেফাকের মহাসচিব পদে দায়িত্ব পালন এবং ২০ দলীয় জোটের শরিক জমিয়তের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করায় নূর হোসাইন কাসেমী বাদ পড়েছেন বলে বেফাকের অন্তত তিনজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান।
মাওলানা মাহফুযূল হক বলেন, ‘এগুলো নিয়ে ভাবা হয়নি। সোমবার সব বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে, কী হবে। আলোচনার মাধ্যমেই সব চূড়ান্ত হবে। আমাদের চেষ্টা সবাইকে এক করা। একটি অভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া।’
এর আগে গত মাসের মাঝামাঝি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মেজরিটি এক হয়ে আসলেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে। আমি আশাবাদী, এবার তারা মেজরিটি এক হবেন এবং এ বছরের মধ্যেই স্বীকৃতির বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।’
কওমি সনদের স্বীকৃতির লক্ষ্যে সরকারের গঠিত বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন ২০১৩ সালেই সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিসভায় ওঠার দিনেই আল্লামা শফী লাখ-লাখ লাশ পড়ার হুমকি দিলে তা অধিকতর যাচাইয়ের জন্য ফেরত পাঠানো হয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি দিতে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করতে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটিতে শোলাকিয়ার খতিব ও ইকরা বাংলাদেশের পরিচালক মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদকে আহ্বায়ক ও গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মহাপরিচালক এবং মুফতি রুহুল আমিনকে সদস্যসচিব করা হয়েছে।
সূত্র : বাংলাট্রিবিউন