বুধবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ৬:৩১
Home / ঘর-সংসার / যে দোয়া কখনো বৃথা যায়না – ওমরায় পাওয়া ‘জামাই-বউ’

যে দোয়া কখনো বৃথা যায়না – ওমরায় পাওয়া ‘জামাই-বউ’

শাইখ আতিকুল্লাহ আতিক:
dua-in-the-kabaমা মারা গেছেন যখন আমি চৌদ্দ বছরের কিশোরী। আমার ছোট আরও তিনটা ভাই আছে। আব্বু আবার বিয়ে করলেন। নতুন মাকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতলেন। ছোটদের দেখবালের দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই আমার কাঁধে বর্তালো। আব্বু মাসিক খরচাটা দিতেন। খোঁজ-খবর রাখতেন। সবকিছু সামলে আমিও লেখাপড়া চালিয়ে গেলাম। ভাইদের লেখাপড়াও চলতে লাগলো। এই করতে করতে মাঝে মধ্যে কয়েকটা বছর ড্রপও দিতে হয়েছে। কায়রো ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করে, যখন বের হলাম, মনে হলো অনেক দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিয়ে এলাম। সবাই আনন্দে হাসছিল। আমার কেন যেন ক্লান্তি লাগছিল।
.
ভাইদের বিয়ে, নিজের চাকুরির কারণে কখন যে বিয়ের আসল বয়েস পার হয়ে এসেছি, টের পাইনি। প্রস্তাব যে একদম আসে নি, এমন নয়। কিন্তু পছন্দসই না হওয়াতে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এখন দেখা দিল আরেক সমস্যা, বয়েস বেশি। চৌত্রিশ। ভাইয়েরা চেষ্টা করেও সম্বন্ধ আনতে পারছে না। তাদের মনে বিরাট কষ্ট, তাদের জন্যে জীবনের সোনালী দিনগুলো ব্যয় করে, এখন আমার জীবনটা তামাটে হয়ে আছে।
.
আব্বুর সাথে অনিয়মিত হলেও যোগাযোগ ছিল। নতুন সংসার নিয়ে তিনি খুব বেশি ব্যস্ত থাকতেন। তবুও ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু করেছেন, তাও অনেক। তার অর্থিক সহযোগিতা না পেলে, আমাদের কে কোথায় থাকতো! নতুন মায়ের চোখ বাঁচিয়ে যা করেছেন, তাই ঢের!
.
এতদিন হলো, নতুন মা কখনো আমাদের প্রতি কোনও আগ্রহ দেখাননি। গত কয়েকদিন ধরে তাকে দেখলাম আমাদের প্রতি সদয় দৃষ্টি দিচ্ছেন। ব্যাপারটা আমাদের বেশ ভাবিয়ে তুললো। ব্যাপারটা খোলাসা হলো কয়েকদিন পর, আব্বু এক ছুটির দিনে, একটা প্রস্তাব নিয়ে এলেন। তিনি সরাসরি দেননি। আমার একমাত্র খালাকে দিয়ে পেড়েছেন।
.
আমার ছোট মায়ের এক নিকটাত্মীয়। খুবই গরীব। লেখাপড়া ও দেখতে শুনতে মোটামুটি গোছের। ছেলেটার একটা অবলম্বন দরকার। ছোটমার কেন যেন মনে হলো, সেটা আমিই হতে পারি। প্রস্তাব শুনে ভাইয়েরা এককথায় নাকচ করে দিলো। আমি অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম, আর দেরী করা ঠিক হবে না। কেউ তো রাজি হচ্ছে, একজন রাজি হয়েছে, এটাই বা মন্দ কী! সম্মতি দিয়ে দিলাম। ভাইয়েরা গোমড়ামুখে বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করলো। বিয়ের আর একদিন বাকী। বিনামেঘে বজ্রপাত! হবু বরের পিতা বাগড়া দিলেন। তিনি বললেন:
-পাত্রী তো বুড়ি, একে বিয়ে করলে, আমার ছেলে সন্তানের মুখ দেখবে না। আমিও নাতিপুতি পাবো না! এ বিয়ে হতেই পারে না!
.
শুধু আমি নই, আমার আব্বু পর্যন্ত ভেঙে পড়লেন। আর বুঝি মেয়েটার বিয়ে হবে না! সবই নিয়তি! মুখ বুজে মেনে নিলাম। স্কুলেও জানাজানি হয়েছিল। মুখ দেখাবার জো রইল না। পাড়ায় বের হওয়াই মরণসম হয়ে গিয়েছিল। ঢি ঢি পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবুও দিন গড়াতে লাগলো। স্কুলে পড়াই। ঘরে এসে ভাগিনা-ভাগ্নিদের সাথে সময় কাটে। ব্যক্তিগত পড়াশোনাও কিছুটা হয়। ধকল কাটিয়ে উঠলাম।
.
আমার ছোট ভাইটা বেশ ধার্মিক হয়েছে। তার বউটাও মাশাল্লাহ ধার্মিক। কুরআনে হাফেযা। তার উৎসাহেই আমি হিফয শুরু করলাম। দশ পারা হয়েছে। ভাইটার খুব ইচ্ছা, ওমরা করতে যাবে। স্কুলের সহকর্মী বললো, তুমিও ভাইয়ের সাথে ওমরা করে আসতে পারো। তোমার একান্ত কিছু বলার থাকলে, দু‘আ কবুলের জায়গাগুলোতে আল্লাহর কাছে বলতে পারো। তিনি তো সব জায়গার কথাই শোনেন, তবে একেবারে বায়তুল্লাহতে গিয়ে বললে নিশ্চয়ই আরো বেশি করে শুনবেন!ইসলামে নারী
.
তার কথাটা আমার মনে ধরলো। রাতেই ছোট ভাইকে বললাম:
-আমিও তোর সাথে ওমরায় যেতে চাই!
সে শুনে আকাশের চাঁদ পেলো যেনো। এমনিতে ভাইয়েরা আমার জন্যে কিছু করার জন্যে মুখিয়ে থাকে। তাদের মনের গহীনে বোধহয় চাপা একটা অপরাধবোধও কাজ করে, আমি তাদের জন্যেই আইবুড়ি হয়ে আছি। আমি অনেকবার তাদেরকে বলেছি, বিয়েশাদি আল্লাহর কাছে। তাকদীরের মুয়ামালা। বান্দার কোনও হাত নেই।
.
শুনেছি বায়তুল্লাহকে প্রথম দেখায় যে দু‘আ করা হয়, আল্লাহ অবশ্যই তা হুবহু কবুল করেন। আমি আগেই ঠিক করেছি, কী দু‘আ করবো। আল্লাহ আমাকে দু‘আটা করার তাওফীক দিলেন। বলতে লজ্জা নেই আমি তাকে বলেছি:
-আল্লাহ গো! আমার একটা ভালো বিয়ের ব্যবস্থা করে দিন। যার সাথে আমি দ্বীন ও দুনিয়ার খিদমত করতে পারি। আমার জীবনটাকে আপনার কাজে ব্যয় করতে পারি! আমাকে অনেকগুলো নেকসন্তানের মা হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন! বয়েস বেশি হয়েছে তো কী, আপনি তো সবই পারেন!
.
যত জায়গায় দু‘আ কবুল হয়, সবখানে অসংখ্যবার একই দু‘আ করে গেলাম। নবিজীর রওযার পাশে, রিয়াযুল জান্নাহতেও একটা দু‘আই বারবার করলাম। সবার জন্যে তো দু‘আ করেছি-ই!
.
ওমরা শেষে ফিরতি ফ্লাইটে উঠলাম। বিমানের যাত্রীদের বেশির ভাগই মিসরী। আমাদের সিটটা তিনজনবিশিষ্ট। আমি জানালার পাশে। ছোটভাই আরেক পাশে। মধ্যখানে অন্য কেউ । একদম লাগোয়া সিটটা পাওয়া যায়নি। আমরা ঠিক করেছি, বলেকয়ে দু’ভাইবোন পাশাপাশি বসবো।
.
প্রায় শেষ সময়ে তৃতীয় যাত্রী এলেন। ভাই তাকে অনুরোধ করতেই তিনি সানন্দে রাজী হয়ে গেলেন। কায়রো বিমান বন্দরে নেমে দেখি পরিবারের সবাই দলবেঁধে আমাদের নিতে এসেছে। এমনকি সম্পূর্ণ চমকে দিয়ে আব্বুও এসেছেন। কী যে ভালো লাগলো! আব্বুর প্রতি ছিঁটেফোটা যা কষ্ট ছিল, নিমেষেই দূর হয়ে গেলো।
.
গাড়িতে উঠতে যাবো, পেছন থেকে জোরে কেউ একজন আমার নাম ধরে জোরে ডেকে উঠলো। চেয়ে দেখি আমার অত্যন্ত প্রিয় বান্ধবী রুকাইয়া। স্বামীও সাথে আছে:
-হাদিয়া! তুই যে আসবি, সেটা জানা ছিল না। যাক দেখা হয়ে গেলো।
-তোর কেন বিমানবন্দরে কেন এসেছিস!
-ওর এক বন্ধুও ওমরা করে আজ আসবে। তাকে এস্তেকবাল করতে আসা। লোকটা থাকে বেলজিয়ামে। মিসর ছেড়েছে সেই কবে। উঠবে আমাদের বাসাতেই!
-ও আচ্ছা!
.
বিদায় নিয়ে পা বাড়াতে গিয়েই দেখি, আমাদের পাশের সিটে বসা ব্যক্তিটাই, রুকাইয়ার কাঙ্খিত ব্যক্তি! লোকটাও কিছুটা অবাক হলো।
.
ভীষন ক্লান্তিতে একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আগামীকাল থেকেই স্কুলে যাওয়া শুরু করবো। কতোদিন আমার প্রিয় ছাত্রীদেরকে দেখি না। তাদের কথা সব সময়ই মনে পড়েছে। আকাশ-পাতাল ভাবছি, এমন সময় মোবাইল বেজে উঠলো। আরে রুকাইয়া!
-এত রাতে?
-রাত আর কোথায়! সবে তো দশটা!
-রাত তোদের কাছে মধুর হতে পারে! আমাদের মতো একার কাছে রাতগুলো তো কোনও বার্তা নিয়ে আসে না!
-যদি বার্তার ব্যবস্থা করি?
-হেঁয়ালি ছেড়ে আসল কথা বল! কেন ফোন করেছিস?
-আগে বল, আমাকে কী দিবি?
-কেন?
-একটা সুসংবাদ আছে!
-বলে ফেল না, কেন মুলো ঝুলোচ্ছিস!
-গতকাল যে ভদ্রলোককে দেখলি, তাকে তোর কেমন লেগেছে?
-তাকে আর কেমন লাগবে? আমি অত ভালো করে তাকাইনি! কেন?
-আছে আছে! উনি তো কাল বিমান বন্দরে গাড়িতে উঠেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন তোর সম্পর্কে। অবশ্য বিমানেই নাকি তোদের সম্পর্কে তোর ভাই থেকে অনেক কিছু জেনে নিয়েছিলেন। তোর সম্পর্কেও কিছুটা জেনেছেন।
-এম্মা! এতকিছু হয়ে গেলো আর আমি কিচ্ছুটি টের পেলাম না!
-তুই ভোঁস ভোঁস করে ঘুমিয়েছিস! টের পাবি কী করে? আচ্ছা শোন হাদিয়া! আমি সবকিছু খুলে বলেছি তাকে। উনি এক কথায় রাজি!
-রাজি মানে?
-বিয়ে করতে রাজি! উনি মিসরে এসেছেনও বিয়ে করতে। বয়েসে তোর চেয়ে বছর দুয়েকের বড়ো হবেন। জানি তুই কী ভাবছিস! এতদিন বিয়ে থা করেননি কেন? বলছি রে বলছি!
লোকটাও তোর মতো জন্ম এতীম। ছোটবেলায় বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়েছে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ এতদূর এসেছে। ফোনে এত লম্বা ইতিহাস বলা যাবে না। তুই বিয়ের পর শুনে নিস! তবে হাঁ, কষ্ট করে মানুষ হয়েছিল তো, তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, জীবনে বিয়ে করবে না। চাকরি-বাকরি করে যা আয়-রোজগার হবে গরীব শিশুদের পেছনে ব্যয় করবে। এসব নিয়েই এতদিন ছিল। লম্বা একটা ছুটি পেয়ে ভাবলো দেশ থেকে একটু ঘুরে যাবে। যাওয়ার পথে ওমরাটাও সেরে ফেলবে।
আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানিস! ওমরার সময়, একদিন তাওয়াফ করতে করতে, তার চোখে পড়লো এক মিসরী পরিবারের ওপর! প্রায় একগন্ডা ছেলেমেয়ে। বিশাল পরিবার একসাথে তাওয়াফ করছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর ছোটাছুটি দেখে, তার মনে হলো ইশ! আমারও যদি এতগুলো সন্তান থাকতো! সাথে সাথেই এতদিনের সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো। বিয়ে করতে হবে। বিয়ে করতে হবে।
হাদিয়া! তুই অমত করিসনে সই!
-বা রে! যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই! আচ্ছা মানুষটার কাছে একটা কথা জেনে নিতে পারবি?
-একটা কেন, একশটা পারবো!
-একটু জিজ্ঞেস করিস তো, তার তাওয়াফের সময়টা কখন ছিল?
-একটু লাইনে থাক, এক্ষুণি জানাচ্ছি।
.
-হ্যালো! লাইনে আছিস!
-আছি!
-তারিখটা ছিল গত সোমবারের আগের সোমবার! আসরের আগে!
-আল্লাহু আকবর!
-কী হলো?
-আমি তখন বায়তুল্লাহকে প্রথম দেখার দু‘আ করছিলাম!
.
বিয়ে হলো গেলো। দু’জন মিলে ঠিক করলো, একটা বছর যে যার চাকুরিতে থেকে যাবে। পরে দেখা যাবে কে কার কাছে যাবে। তবে হুসনি মুবারকের যদি পতন হয়ে যায়, আর ইসলামী কোনও দল ক্ষমতায় আসে, তাহলে মিসরেই থাকা হবে। অন্যথায় দু’জনেরই ইচ্ছে, বেলজিয়াম!
.
বিয়ের পর প্রথম দুটো মাস বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যেই কেটেছে। মনে বেশ ভয় ভয় করছিল হাদিয়ার। আল্লাহ একটা দু‘আ তো অক্ষরে অক্ষরে কবুল করেছেন। বাকিটাও কি করবেন না! এদিকে স্বামীর ছুটিও দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল।
.
দু’জনে মিলে ঠিক করলো, ডাক্তারের কাছে যাবে। অভিজ্ঞ এক মহিলা ডাক্তারের কাছে গেলো। তিনি দেখেই বলে দিলেন:
-আপনি তো সন্তান-সম্ভবা!
দু’জনের চোখেই তখন আনন্দাশ্রু চিকচিক করছে। ছুটি শেষ হলে স্বামী চলে গেলো। বললো খুব তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে আবার ফিরবে। তার অনেক ছুটি পাওনা আছে।
.
হাদিয়ার মনে সারাক্ষণই নানা চিন্তা ঘুরপাক খায়। আল্লাহ শেষ পর্যন্ত সব ভালোয় ভালোয় হবে তো! ছয় মাসের পর দেখা গেলো শরীরটা অসম্ভব ভারী হয়ে গেছে। ডাক্তার বললেন সব ঠিক আছে।
.
নির্দিষ্ট দিনে ক্লিনিকে ভর্তি হলো। যথা সময়ে ভালোয় ভালোয় সব মিটে গেলো। অসম্ভব ব্যাথায় শেষের দিকে হাদিয়া অজ্ঞানের মতো হয়ে গিয়েছিল। হুঁশ ফিরতেই কর্তব্যরত নার্স দৌড়ে কাছে এলো। হাদিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নার্সের দিকে তাকালো, যেন জানতে চাইলো কাউকে দেখছি না কেন? আমার সন্তান কোথায়? নার্স হেঁয়ালি করে বললো:
-আপনি কী আশা করেন? ছেলে না মেয়ে?
-আমার বিশেষ কিছু চাওয়ার নেই। আল্লাহ যা দিবেন, তাতেই আমি খুশি। বাকিরা কোথায়?
-এই তো এখুনি এসে যাবে। কী নাম ঠিক করেছেন?
-ওর ইচ্ছে হাসান বা ফাতিমা!
-যদি বলি দুটো ঠিক আছে, তবে আরেকটা নাম লাগবে?
নার্সের কথা শেষ না হতেই পাশের কেবিন থেকে একসাথে তিন ভ্রাতৃবধু প্রবেশ করলো। তিনজনের হাতেই তিনটা ‘পুতুল’। ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদছে!!!
(শাহ আহমাদ’র পোস্ট অবলম্বনে)

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...