আবদুল কাদির বাঘা : এ দেশে রয়েছে কমবেশ ২৫ হাজারেরও বেশি কওমি মাদরাসা। এগুলো থেকে প্রতিবছর হাজার হাজারশিক্ষার্থী লেখাপড়া সমাপ্ত করছে। তারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে-কানাচে। যে যেখানে যেভাবে সুবিধা পাচ্ছে—চাকুরি নিচ্ছে। হাজার দেড়েক কিংবা সামান্য বেশি বেতন পায় ওরা। এগুলো দিয়ে একজন মানুষের পকেটখরচও চলে না। পরনির্ভর হয়ে থাকতেই হয়। অন্যত্র চাকুরিও নিতে পারে না। কারণ আজকাল একজন সুইপারের পদে চাকুরি নিতে হলেও শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি দেখাতে হয়। কওমি মাদরাসায় দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর পড়ে এই অষ্টম শ্রেণির সুইপারের ‘যোগ্যতা’ও অর্জন করা যায় না। আমরা আজ উচ্চশিক্ষার জন্য বহির্বিশ্বে যেতে পারছি না। দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ডিপার্টমেন্টে চাকুরি নিতে পারছি না।
আমাদের সার্টিফিকেট যতক্ষণ না সরকারিভাবে মূল্যায়ন করা হবে, ততক্ষণ আমরা মূর্খদের কাতারেই গণ্য হব এবং হচ্ছি। আমরা যতই আমাদেরকে শিক্ষিত বলি না কেন— আমরা মূর্খদের কাতারেই গণ্য হবো।
আমাদের পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে এই অধিকার অনেক আগ থেকেই আছে। কওমি মাদরাসায় যারা লেখাপড়া করে তারা যেকোনো ডিপার্টমেন্টে চাকুরি নিতে পারে। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। উচ্চশিক্ষার জন্য যেকোনো দেশে যেতে পারে। তাদেরকে কেউ মূর্খ বলে না। কেউ তাদের যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু আমাদের দেশ বিরল। এখানে আমাদের সেই অধিকারটুকু নেই।আমরা সেই অধিকার আদায়ের জন্যই বারবার সরকারকে বিরক্ত করছি। নব্বই এর দশক থেকে এর আলোচনা চলছে। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। লেখালেখি করে অনেক পাতা বিনষ্ট হয়েছে। কলমের কালি শেষ হয়েছে। অবশেষে ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বীকৃতির জন্য একটি ট্রাস্কফোর্সও গঠন করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য! সেই ফাইলটি যেভাবে ছিল সেভাবেই পড়ে থাকে। এরপর সরকার পরিবর্তন হল। নতুন সরকার এল। পূর্বঘোষিত স্বীকৃতি বাস্তবায়নের জন্য কত সমাবেশ করা হল। মিছিলে মিছিলে রাজপথ কাঁপানো হল। পুলিশের লাঠিপেটা খেতে হল। ধর্মঘট পালন করা হল। হরতাল ডাকা হল। সাদা পঞ্জাবিওয়ালাদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হল। দাবি আদায় না হলে ‘সরকারপতন’ আন্দোলনের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হল। কিন্তু এগুলো কোনো কাজে এল না। সরকার এদিকে মোটেও কর্ণপাত করল না।
এরপর জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হল। শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার সাধিত হল। এই শিক্ষানীতিতেও চরমভাবে অবমূল্যায়ন করা হল ইসলামি শিক্ষাকে। কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির আলোচনা আসা তো দূরের কথা— মাত্র একটি স্থানে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কওমি মাদরাসার কথা এসেছে। তাও স্বীকৃতির কোনো কথা নয়। কমিশন গঠনের কথা। সেখানে বলা হয়েছে, কওমি মাদরাসার-সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কওমি কমিশন গঠন করা হবে। কমিশনের মাধ্যমে ইসলামশিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষাদান বিষয়ে সুপারিশ তৈরি করে সরকারের বিবেচনার জন্যে উপস্থাপন করা হবে।
অবশেষে তড়িগড়ি করে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করা হল। আল্লামা আহমদ শফিকে প্রধান কমিশনার বানানো হল। অথচ তিনি নিজেও জানেন না যে তাকে ‘প্রধান কমিশনার’ বানানো হয়েছে। পরদিন ১০ এপ্রিল একটি বিবৃতিতে তিনি এই কমিশনকে ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার কথা শুনে অনেক আলেমও এটি প্রত্যাখ্যান করার আহবান জানিয়েছিলেন। মুফতি আমিনি বলেছিলেন, ‘‘কওমি শিক্ষার সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এই সরকারের হাতে নেই; কারণ এখন তাদের পতনের সময়…।’’ সঙ্গত কারণে কমিশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই ছিল স্বাভাবিক।
এবার নতুন করে প্রধানমন্ত্রী উদ্যেগ নিয়েছেন স্বীকৃতির। এর জন্য পাঠ্যক্রম ঠিক করে দিতে আলেম ওলামাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অনেকটা জোর করেই দিতে চাচ্ছেন। তিনি বলেন—”এখন আবার সময় এসেছে, সবাইকে এক হতে হবে। আপনারা যারাই একমত হতে চান, একমত হন, আমরা সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়ন করে দেবো।”উদ্দেশ্য যাই হোক— আমরা তা দেখতে যাবো না। আমাদের স্বীকৃতির দরকার এটিই আমরা বুঝি। এর প্রয়োজন অনুভব করি। পরস্পর মতানৈক্যের কারণে যেন জাতীয় স্বার্থ বিনষ্ট না হয়। কয়েক লক্ষ শিক্ষার্থী যেন বঞ্চিত না থাকে তাদের কাঙ্ক্ষিত অধিকার থেকে। এই আমাদের কামনা।