রেহানা বিনতে আলী: সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারলে তার পুরোপুরি মজা থাকে না। তাই প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি পাঠকদের কাছে যে, সঠিক সময়ে লেখাটি দিতে পারিনি, যে প্রয়োজন ছিল রমযানের পরপর। আসলে ইচ্ছা ছিল রমযানের পরপরই পাঠকদেরকে লেখাটি উপহার দিব। কিন্তু ব্যস্ততা আর বাস্তবতায় হয়ে ওঠেনি, যদিও শুরু করেছি রমযান থাকতেই আর শেষ করলাম প্রায এক মাস পরে। যাই হোক মানব জীবনকে পুত-পবিত্র এবং সুন্দরতম করে গড়ে তোলার একটি অত্যন্ত কার্যকরী পন্থা হলো রমযানের রোজা। আবার রোজা হচ্ছে কু-প্রবৃত্তিকে দমন করে সৎ ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণের নাম, রোজার সংযম ও তাক্ওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণে মানব সত্তায় যে পবিত্রতা ও আত্মশুদ্ধির ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়, সে অনুযায়ী অবশিষ্ট এগারো মাস ও পূর্ণময় জীবন যাপন করে মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সচেষ্ট থাকবে, এটাই সিয়ামের উদ্দেশ্য। ইতিমধ্যে আমরা একমাস সিয়া, সাধনা শেষ করে সেই উদ্দেশ্যের দিকেই এগুচ্ছি, এখন সমগ্র মুসলিম উম্মাহর করণীয় হচ্ছে- ঐ এক মাসের ট্রেনিং, শিক্ষা, আমলগুলো বাকি এগারো মাস তথা সারা বছর জারি বা চলমান রাখা, তবেই হয়তো খাঁটি মুমিন-মুসলমান হতে পারবো ইনশাআল্লাহ। যেমন:
ফরয ইবাদতের গুরুত্ব: আল্লাহ্ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে।” এই নির্দেশের কারণে সারা বিশ্বের মুসলমান একসাথে রোজা রাখা শুরু এবং একসাথেই শেষ করে। অর্থাৎ আল্লাহ্র নির্দেশ, এটি ফরয পালন করতেই হবে, নতুনা গুণাহ্গার হতে হবে। ঠিক তেমনি কোরআনে আল্লাহ্র আরও অসংখ্য নির্দেশের কথা এসেছে যেমন নামায, পর্দা, হজ্ব, যাকাত, সুদ-ঘুষ, হালাল-হারাম, দ্বীন-প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি এগুলোও আমাদের অবশ্যই পালনীয় কাজ, আর তাই এগুলোও আমাদেরকে নিষ্ঠার সহিত পালন করতে হবে। কারণ ইসলামে বা কোরআনের কিছু অংশ মানবো আর কিছু অংশ মানবো না সেটি কিন্তু ঈমানদারের কাজ নয়, ঈমানদার হতে হলে অবশ্যই কোরআনের সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে।
তাক্ওয়া অর্জন করা: এর পরেই আল্লাহ্ বলেন, “এ থেকে আশা করা যায় তোমাদের মধ্যে তাক্ওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হয়ে যাবে।” এই তাক্ওয়ার সহজ অর্থ হলো- অন্তরে আল্লাহ্র ভয় জাগ্রত রাখা। অর্থাৎ একজন রোজাদার পানাহার ত্যাগসহ যাবতীয় পাপ কাজ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য তাক্ওয়া হাসিলের চেষ্টা করে। তার মানে এই তাকওয়া আমাদের সারা বছর থাকা প্রয়োজন, তাই এই তাক্ওয়াকে জীবন্ত রেখে সারাটি বছর আল্লাহ্র সন্তুষ্টির কাতারে থাকার জন্য সমস্ত পাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখা এবং তাক্ওয়াবান হিসেবেই টিকে থাকা, তাক্ওয়া প্রতিষ্ঠা করা।
সময়মতো নামায আদায়: “নামায কায়েম করো, নিঃসন্দেহে নামায অশ্লীল ও খারাপ কাজ হতে বিরত রাখে।” (আনকাবুত-৪৫) রমযান মাসে মুসলমানদের মধ্যে নামায পড়ার একটা আন্তরিকতা ও প্রতিযোগিতা কাজ করে, তারই ফলশ্রুতিতে মসজিদগুলো নামাযের সময় জমজমাট থাকে এবং নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধ বণিতা সবার মাঝে এই নামায-রোজার একটা পবিত্র ভাব ফুটে ওঠে, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই পরিবেশটা রোজার শেষে তেমনটি থাকে না, অথচ রোজার মাসে নামাযের যে গুরুত্ব বা না পড়লে যে শাস্তি রোজার পরেও ঠিক সেই গুরুত্ব ও শাস্তি। তাই আমাদের নামাযের মাধ্যমে দৈনিক সতের ফরয আদায় এটি মাথায় রেখে সারা বছর শরীর, মন ও পরিবেশ নামায উপযোগী রাখতে হবে।
কোরআন-হাদীস অধ্যয়ন: রমযানে অধিক নেকের আশায় অনেকে কোরআন অধ্যয়ন ও খতম করে থাকে, যদিও তারা অনেকে সারা বছর কোরআন পড়ে না, অথচ “হাদীসে এসেছে আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির ইবাদতে সন্তুষ্ট হন, যে কিনা নিয়মিত ভালো কাজ তথা ইবাদত করে।” অর্থাৎ আজকে একটা ভালো কাজ করলাম কালকে ছেড়ে দিলাম এ রকম ভালো কাজ আল্লাহ্ পছন্দ করেন না, আর আমরা জানি কোরআন হচ্ছে মানব জাতির সংবিধান যেটাকে বলা হয়ে থাকে “পরিপূর্ণ জীবন বিধান।” সুতরাং সংবিধান বহির্ভূত কাজ কারো জন্যই ভালো নয়। আর কোরআনকে সঠিক ও সহজভাবে বুঝার জন্য হাদীস অধ্যাপয়ন অত্যাবশ্যক এবং রাসূল (সাঃ)কে জানতে হলে, বুঝতে হলেও রাসূলের জীবনকে একমাত্র আদর্শ মানতে হলে হাদীস জানতেই হবে, তাই আমাদের উচিত প্রত্যহ ও সারা বছর কোরআন-হাদীসের চর্চা করা অব্যাহত রাখা, এভাবে রমযানের শিক্ষাকে বলবৎ রাখা।
সংযমী ভাব অব্যাহত রাখা: মূলত কম খাওয়া, কম কথা বলা সব সময় এর জন্যই ভালো, রমযানে রোজাদারেরা কম খায়, কম কথা বলে, কম ঘুমায় থাকে আমরা সংযম বলে থাকি। এরই ওছিলায় রোযাদারেরা ঝগড়া-ফাসাদ, গিবত-চোগলখুরি, পরনিন্দা প্রভৃতি কাজগুলো কম করে থাকে। যার কারণে গুণাহ কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু তার মানে এ নয় যে, এক মাস সংযম করবো আর বাকি এগারো মাস যা ইচ্ছে তাই করবো, এ তো মুর্খতা বটে! অথচ আমাদের এক মাসকে যেভাবে গুরুত্ব দেই আবার এই এগারো মাসকেও ঠিক সেইভাবেই গুরুত্ব দেয়া উচিত, কারণ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন টানা একমাস রোজার বিধান করেছেন এই জন্যই যে, ভালো কাজে অভ্যস্থ হওয়া ও খারাপ কাজ থেকে স্থায়ীভাবে ফিরে আসা আর এভাবেই রমযানের ট্রেনিংকে কাজে লাগাতে হবে, সর্বোপরি আমাদেরকে ইবাদতের উদ্দেশ্যে বিশ্রাম ত্যাগ করতে হবে এবং সংযমী ভাব সর্বাবস্থায় সব সময বজায় রাখতে হবে।
দান-সদকা ও খাবার বিতরণ: রমযানে নফলের সওয়াব ফরযের সমান ও ফরযের সওয়াব সত্তর থেকে সাতশ’ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। তাই রোযাদারেরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকে সাধ্যমত দান-সদকা ও খাবার বিতরণ করার জন্য এর মাধ্যমে অসহায়-দরিদ্ররা উপকৃত হয় ও তাদের হক আদায় হয়। কিন্তু এ সওয়াব ও হক আদায় বছরের বাকী সময়টাও করা উচিত এটি আমাদের মাথায় রাখা উচিত। কারণ একজন ক্ষুধার্ত ও বস্ত্রহীন মানুষের খাবার ও বস্ত্র সারা বছরই প্রয়োজন। রোযার দিকে তাকাতে তাকাতে সে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাই সকলের উচিত দানের হাত ও অন্তর পুরো বছরের জন্য প্রসারিত রাখা।
পোশাক-পরিচ্ছদ ও শালীনতা: বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ, এই দৃষ্টিভঙ্গি মাথায় রেখে হয়তো এদেশে রমযানের সময় কিছু কিছু মুসলমান শালীন হয়ে যান, যেটি আমাদের মিডিয়াতেও দেখা যায়। পথে-ঘাটে, বাজারে, প্রতিষ্ঠানে সবখানে এর কিছু প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা কি শুধু রমযানের মুসলমান? নাকি সারাবছর বা সমগ্র জীবনের জন্য মুসলমান, আশা করি পাঠকরাই বুঝে নিবেন, অথচ মুসলিম নর-নারীর উচিত সর্বদা শরীয়তের সীমা বজায় রেখে চলা, তবেই না আমরা খাঁটি মুসলমান হতে পারবো, এখানে বাহ্যিক পোশাকের পাশাপাশি আমরা অন্তরের পর্দা ও চোখের পর্দাও যোগ করবো, কারণ বাহ্যিক পোশাকের মাধ্যমে পুরোপুরি মুসলমান হওয়া যায় না, যদি অন্তর ও দৃষ্টিপরিশুদ্ধ না থাকে, তাই সব মিলিয়েই আমাদের মুসলমান তথা মুমিন হওয়া উচিত।
নফল ইবাদত: অধিক সওয়াবের আশায় রমযানে রোজাদারেরা অতিরিক্ত ইবাদত বা নফল ইবাদত বাড়িয়ে দেয়। যেটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার, যেমন কোরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুত পড়া, তাসবিহ্, ইসতেগফার ও অন্যান্য নফল নামায প্রভৃতি। কিন্তু সেটি অব্যাহত না রাখলে প্রশংসার স্থানে সমালোচনা সৃষ্টি হয়ে যায়। তাই আমাদের মাথায় রাখতে হবে নফল সব সময় ফরযের ঘাটতি পূরণ করে, এই জন্য সবসময় রমযানের মতো নফল ইবাদতে মনোযোগ দিতে হবে, আর এতে করে ইবাদতের প্রতি মন-মানসিকতা ঠিক থাকে এবং প্রাণবন্ত থাকে, আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, রমজানে কোরআন বুঝা, ইসলামী গান শোনা, ওয়াজ শোনা, আলোচনা শোনার মাধ্যমে যে সওয়াব হাসিল করা হয় সেটিও অন্য সময়ে অব্যাহত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
মিডিয়ার ভূমিকা: মিডিয়ার ভূমিকা, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না, পবিত্র মাসে মিডিয়াগুলো অনেকটা পবিত্র হয়ে যায়, যা অন্যান্য সময় সাধারণত থাকে না, তাই মিডিয়া কমকর্তা ও কলা-কশুলিদের নিকট বিশেষ অনুরোধ যে, আপনাদের মাধ্যমে দর্শক উপকৃত হয়, জ্ঞান অর্জন হয়, কল্যাণ হয়, এমন ভূমিকা আপনারা ধারাবাহিক রাখেন এবং যারা এতে সামান্য পরিমাণও প্রভাব ঘটাতে পারবেন তাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে, আপনার সামান্য প্রভাবেও যদি এতটুকু উপকৃত হয় হাজার দর্শক শ্রোতা দয়া করে আপনি সেই প্রভাবটুকু কাজে লাগান।
নিয়মানুবর্তিতা: রমযানুল মোবারকে যে রকম নিয়মানুবর্তিতা দেয়া যায়, সর্বক্ষেত্রে, রমযান ছাড়া অন্য সময় সেটি খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না, যেমন উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘুম, ব্যক্তিগত কাজ, পড়াশুনা, ইবাদত-বন্দেগী ইত্যাদি। এ সব কিছুই ব্যক্তি তার ইচ্ছামতো নিয়ম ঠিক রেখে করে কিন্তু অন্য সময় অর্থাৎ রমযান শেষ হয়ে গেলে আর সেই নিয়মের তোয়াক্কা অনেকাংশেই থাকে না, যা কাক্সিক্ষত নয়-কোন রোজাদারের জন্য তথা মুসলমানের জন্য। তাই সময়ের পরিবর্তনের সাথে ভালো কাজের পরিবর্তন না করে ইবাদত জারি রাখা।
আসুন আমরা রমযানের পবিত্রতা ধরে রাখি সারাটি বছরজুড়ে এবং রহমের অমিয় সুধায় প্রত্যেকে নিজেকে সিক্ত করার প্রয়াস অটুট রাখি স্ব-স্ব প্রচেষ্টায়। আর রমযানের করণীয়গুলো রমযানের পরবর্তীতেও অব্যাহত রাখার ভূমিকায় সকলে একনিষ্ঠ হই। আল্লাহ্ সহায় হোন। (আমীন)
এটাও পড়তে পারেন
তারাবীহ’র নামায ২০ রাকাত (১ম পর্ব)
মুফতী মাসুম বিন্নুরী:: (প্রথম পর্ব) ‘তারাবীহ’ শব্দটি আরবী শব্দ। এটা تَرْوِيْحَةٌ (তারবীহাতুন) এর বহুবচন। এর ...