কবি মুহিব খান:
বাংলাদেশের হাক্কানি ওলামা-মাশায়েখ, ইসলামি দল, সংগঠন ও সহিহ দীনি তরিকাসমূহের মধ্যে একটি বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও চিন্তা আমি অনেক আগে থেকেই লালন করে এসেছি। যারা সচেতন; তারা আমার আরও ১২/১৩ বছর আগের কবিতা, সংগীত ও লেখালেখিতে এর প্রমাণ খুজে পাবেন। কিছুদিন আগেও অামি এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা উঠিয়েছিলাম। কারণ আমার ভেতর থেকে আমি এর প্রবল তাগিদ ও পেরেশানি অনুভব করি।
ঐক্যের প্রসঙ্গ এলেই যেন একধরণের হতাশা ও নেতিবাচক ভাবাবেগে আমরা ভেসে যাই। কিছু অতি কমন (common) গা-সারা মন্তব্যে আমরা দায় এড়িয়ে যাই। আগেভাগেই পরস্পর নিন্দা দোষারোপ ও কাদা ছুড়াছুড়ি শুরু করে দিই। সম্ভাবনার চিন্তা ছুড়ে ফেলে কেবল সন্দেহের ধুম্রজাল খুজে বেড়াই। কার সঙ্গে কেন ঐক্য সম্ভব নয়; তাই শুধু আলোচনায় আনি।
কিন্তু এ বিষয়ে আমি আমার বিস্তৃত চিন্তার নির্যাস থেকে স্পষ্টই বলতে চাই-‘বাস্তবে যতো জটিল-কঠিনই হোক, অতীতের যতো করুণ অভিজ্ঞতাই থাকুক- কোনো না কোনোভাবে বা যেভাবে সম্ভব হতে পারে সেভাবে, অথবা এ প্রায়-অসম্ভব বিষয়টিকে সম্ভব করার জন্য প্রয়োজনীয় বুদ্ধি-পন্থা এমনকি কৌশলগত চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে হলেও আমরা যদি এধরণের একটি ঐক্য সময় থাকতে গড়ে নিতে ব্যর্থ হই; তবে অতি নিকট ভবিষ্যতে আমরা কেউই অফসোস করার নিস্তারটুকুও পাবো না। আমাদের এই ভয়াবহ দু:সময়টি আমাদের একেবারেই নিকটে এসে পড়েছে। আমি আবারও বলছি- আমাদের এই ভয়াবহ দু:সময়টি আমাদের একেবারেই নিকটে এসে পড়েছে। আমি আরও একবার বলে রাখছি- আমাদের এই ভয়াবহ দু:সময়টি আমাদের একেবারেই নিকটে এসে পড়েছে।’
আর তো কিছুদিন মাত্র! বাংলাদেশে ধর্মীয় বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অাইন করে চিরতরে নিষিদ্ধ করে ফেলার ভেতরগত প্রক্রিয়া থেমে নেই। হঠাত একসময় পত্র-পত্রিকা টকশোতে একযোগে বিষয়টি জাতির সামনে নিয়ে আসা হবে। জায়গায় জায়গায় নানান বিরিয়ানি মঞ্চ বসানো হবে। লম্বা লম্বা মানববন্ধন সাজানো হবে। সবাই একসুরে এককথা বলতে বলতে সাধারণ মানুষকেও বিভ্রান্ত করে ফেলবে। তখন টিভি রিপোর্টারদের মাইকের সামনে রাস্তা-ঘাটের সাধারণ যদু-মধু লাউ-কদু টাইপের লোকজনও ঘটনার আগ-পিছ না বুঝেই বিপুল উতসাহ ও পাণ্ডিত্য নিয়ে লেকচার দিতে শুরু করবে-‘আমরা রাজনীতিতে ধর্ম দেখতে চাই না, ধর্ম পবিত্র জিনিস, শান্তির জিনিস; ধর্ম থাকব মসজিদে মন্দিরে আর অন্তরে; রাজনীতিতে কোনো ধর্ম-টর্মের জায়গা নাই। যারা এইসব করে- তাগো আমরা পছন্দ করি না। তারা দেশের শত্রু, মানবতার শত্রু, আমরা তাগো বিচার চাই।’ এই সেই, হেন-তেন।
দুষ্ট মিডিয়াগুলো একবার হুজুগ উঠিয়ে দিলে সাধারণ মানুষেরা তো বটেই; অনেক দীনদার পরহেযগার মানুষও আর বুঝতে চাইবে না- কোনটা ধর্মীয় রাজনীতি আর কোনটা ধর্মের নামে রাজনীতি। কোনটা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আর কোনটা ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি। কেউ একবারও চিন্তা করে দেখবে না- রাজনৈতিক স্বার্থে নির্বাচনের আগে ধর্মকে ওয়ান-টাইম ব্যবহার করে জনগণকে বোকা বানায় আসলে কারা, আলেমরা না জালেমরা। তখন কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন আমীর চেয়ারম্যান আহবায়ক সভাপতি নেতা শায়খ পীর মুর্শিদ কারও কিচ্ছু করার উপায় থাকবে না। এই ষড়যন্ত্র উন্মোচনের কোনো পথই আর খোলা রাখা হবে না। বিপদ কাউকে ধরবে আর কাউকে ছাড়বে বলে আমার মনে হয় না। আর এর পরের আঘাতটি আসবে সরাসরি ধর্মীয় শিক্ষা তথা দীনি চেতনার সূতিকাগার মাদরাসাগুলোর উপরে। এদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের অবস্থা দিন দিন হয়ে উঠবে বিপন্ন ও সংকটময়।
সুতরাং কবে কী হয়নি, কার কারণে হয়নি, কে কী পারেনি, কেন পারেনি, এসব চিন্তা বাদ দিয়ে ভাবা দরকার- এখন আমরা কী করতে পারি, কীভাবে কী করা যায়। হতে পারে সেটি ‘পূর্ণ ঐক্যমত’-এর ভিত্তিতে বা ‘ইত্তিহাদ মাআ’ল ইখতিলাফ’-এর ভিত্তিতে বা অন্তত: ‘আল আকসারু হুকমুল কুল’-এর ভিত্তিতে বা আরও অন্য কোনো সম্ভাব্য উপায়ে। যেভাবেই হোক হতে হবে।
যদি কেউ অধিক আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন আর মনে করেন- ঐক্যের কী দরকার, আমরা তো বেশ ভালই আছি; তাহলে বিরাট ভুল হবে। এখন যারা নগদ আদর পাচ্ছেন বা ভবিষ্যতে পাওয়ার আশায় এখন গুনে গুনে কষ্টের দিন পার করছেন- সময় হারিয়ে তাদের সবারই ভুল ভাঙ্গবে। কারণ- ঘরজামাইয়ের আদর বেশিদিন স্থায়ি হয় না। কুরবানির আগে আমরাও গরুকে আদর করে করেই দড়ি প্যাচাই। এতে আনন্দে গদগদ হওয়ার কিছু নেই।
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, আমার শ্রদ্ধাভাজন প্রাণাধিক প্রিয় মরহুম আব্বা – উপমহাদেশের বরেণ্য আলেমেদীন, বেফাকের প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব (৩ বার) ও ভাইস চেয়ারম্যান, জামিয়া আরাবিয়া ফরিদাবাদ ও মাদরাসা দারুল ঊলূম মিরপুর-৬ এর সাবেক মুহতামিম, জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ এর (প্রায়) আজীবন নায়েবে মুহতামিম, জামিয়া মিল্লিয়া ও জামিয়া ফারুকিয়ার প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় শরীয়া কাউন্সিলের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক গভরনিং বডি-র সদস্য, স্বাধীনতাপূর্ব ইসলামি রাজনীতি তথা আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র, সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য, প্রবীণতম আলেম রাজনীতিক, সুবক্তা ও শিক্ষাবিদ, খতিবে মিল্লাত হযরতুল আল্লাম মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ. (এ পোস্টে হযরতের একটি ফাইল ফটো সংযুক্ত করা হয়েছে) সারাজীবন বাংলাদেশের ইসলামি শক্তির ঐক্যের প্রত্যাশী ছিলেন এবং এ বিষয়ে নানা সময়ে নানাভাবে সক্রিয় ছিলেন।
খেলাফত আন্দোলনের সূচনাকালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ: থেকে নিয়ে আল্লামা খতীব উবায়দুল হক রহ:, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ:, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ:, মরহুম পীর সাহেব চরমোনাই হুজুর রহ:, মুফতি আমিনী রহ:-সহ সারাদেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সমাদৃত অনেক ওলামা-মাশায়েখ ও ইসলামি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে উপযুর্পরি অলোচনা ও মধ্যস্থতায় সচেষ্ট ছিলেন। শেষের দিকে তার এ চিন্তা ও চেষ্টার কিছু বাস্তব কর্মততপরতায় এই আমিও তার একজন ক্ষুদ্র সহযোগী কর্মী হতে পেরেছিলাম।
সর্বশেষ ২০০৩-৪ সনে এ ধরণের একটি বৃহত ইসলামি ঐক্যের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ও প্রস্তাবনা ভিত্তিক প্রয়াসও আরম্ভ করেছিলেন তিনি। তখনও নৈরাশ্য ও জটিলতার অন্ত ছিলো না বটে। তবুও তিনি আশাবাদী ও সচেষ্ট ছিলেন। তার সেই অধীর অবেগ ও পেরেশানি তখন খুব কাছ থেকে অনুভব করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। কিন্তু কাজটি ভালোভাবে গুছিয়ে নেয়ার আগেই ২০০৮ এর পবিত্র মি’রাজের রাতে তিনি তার প্রিয় মাওলার সান্নিধ্যে চলে যান। আল্লাহ তার নেক নিয়ত ও প্রচেষ্টার উত্তম প্রতিদান দিন। (এ প্রজন্মের অনেক তরুণ ও নবীন আলেম তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত নন। এ বিষয়ে বিস্তারিত অন্য কোনোসময় লিখবো- ইনশাআল্লাহ।)
হযরতের সেই অসমাপ্ত কাজ, সবোর্পরি এ দেশের লক্ষ আলেম ইমাম ও তৌহিদি জনতার প্রাণের আকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার প্রত্যাশায় আমি (অতি-সামান্যজন) দীর্ঘ সময়ের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও বিনিদ্র গবেষণায় ঐক্য বাস্তবায়নের সম্ভাব্য কিছু কৌশলগত রূপরেখা বা ফর্মুলা উদ্ভাবনের চেষ্টা করেছি- যার কোনো না কোনো একটির অথবা সমন্বিত সংস্করণের কার্যকারিতার আশা সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমি এ উদ্যোগের নামকরণ করেছি- ‘বৃহত্তর ইসলামি ঐক্য প্রচেষ্টা’ (effort for greater Islamic alliance) । এ বিষয়ে দেশের কিছু নির্ভরযোগ্য ওলামা-অাইম্মা ও চিন্তাশীল দীনি ব্যাক্তিবর্গের সঙ্গে প্রাথমিক সমন্বয় শেষে যথাসময়ে এর পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল বিবৃত হবে এবং কাজ শুরু হবে- ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য যে, আমার ‘ন্যাশনাল মুভমেন্ট’- গোটা দেশ-জাতির ন্যয়সংগত স্বার্থ-সুরক্ষার জাতীয় আন্দোলন। এর চিন্তা ও পরিধি ব্যপক এবং ভিন্ন। এটি জাতীয় পরিসরে তার নিজস্ব গতিতে চলবে।
অন্যদিকে সুনির্দিষ্টভাবে শুধুমাত্র এদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের সমূহ কল্যাণার্থে সরাসরি ইসলামি রাজনীতির ক্ষেত্রটিতে আমার অবস্থান একেবারেই পরিস্কার। এ ক্ষেত্রে আমি আমার ব্যক্তিগত দলনিরপেক্ষ অবস্থান এবং সবার সঙ্গে অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও দীনি সুসম্পর্ক শুরু থেকেই অক্ষুণ্ণ রেখেছি- একটি বহুল আকাঙ্খিত বৃহত্তর ইসলামি ঐক্যের প্রত্যাশায় এবং নিরপেক্ষ গ্রহনযোগ্য অবস্থান থেকে এ কাজটি এগিয়ে নিতে পারার সুবিধার্থে।
আরও পরিস্কার করে বলছি- ইসলাম ও মুসলমানদের দীনি স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে বিচ্ছিন্ন কোনো ইসলামি দল বা সংগঠনের শীর্ষ নেতা-কর্মী বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল হয়ে পারস্পরিক তর্ক-দ্বন্দ্ব ও কাদাছুড়াছড়ির অংশিদার হওয়ার চেয়ে- কাঙ্খিত ঐক্যবদ্ধ ইসলামি শক্তির একজন সাধারণ কর্মী বা পিয়ন/দারোয়ান হতেও আমি অধিক স্বাচ্ছন্দ বোধ করবো।
আমি জানি, আমার মতোই এরকম চিন্তা ও অবস্থানের অসংখ্য আলেম ও ইসলামি জনতা এ দেশে রয়েছেন। এমনকি ‘ভাত নাই তো- মুড়ি খাই’ বা ‘নাই কাজ তো- খই ভাজ’ হিসাবে অনেক দলীয় কর্মী-সমর্থকও এমন আছেন- যারা কেবল নিরুপায় হয়ে এক জায়গায় লেগে আছেন; কিন্তু মনে স্বস্তি পাচ্ছেন না, কাজে তৃপ্তিও পাচ্ছেন না। তারাও একটি বৃহত ঐক্যৈর প্রত্যাশী। সুযোগ হলে তারাও এ ধরণের মহত চেষ্টায় অংশ নেবেন। অাল্লাহ যদি আমাদেরকে চূড়ান্ত ধ্বংস ও লাঞ্ছনার হাত থেকে মুক্তির ফায়সালা করে থাকেন; তাহলে সফলতা আসতেও পারে।
আপাতত আমি সারাদেশের এবং বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার (বৃহত্তর ইসলামি ঐক্য-প্রত্যাশী) সকল সম্মানিত খতিব ইমাম ও মুহতামিমবৃন্দকে বাংলাদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের সম্মানজনক নিরাপদ ভবিষ্যত নিশ্চিতকরণের স্বার্থে ঐক্য-প্রচেষ্টার এক বৃহত ও মহত কাজে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে রাখছি।
আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। ‘বৃহত্তর ইসলামি ঐক্য প্রচেষ্টা’র পথ-পরিক্রমা সহজ ও সুগম করে দিন। আমীন।