এস. এম. রায়হান : এই ধরণের লেখার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ক্ষতি ছাড়া ব্যক্তিগত কোনোই লাভ যে হবে না, এটা জেনেবুঝেও একটা দায়িত্ববোধ থেকে লিখতে হচ্ছে। এই লেখায় কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে। তবে প্রশ্নপর্বে যাওয়ার আগে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করার পেছনের কারণগুলো বলে রাখা ভালো। প্রচার করা হচ্ছে এই বলে যে, কওমী মাদ্রাসা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়, সঠিক মানুষ গড়ার কারখানা, জান্নাতের বাগিচা, ইত্যাদি। অন্যদিকে সরকারী (নন্-কওমী) প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে ডাক্তার হতে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত মেডিসিন দিয়ে সুস্থ মানুষদের বড় বড় রোগে আক্রান্ত করা হয়। রানা প্লাজার মতো হাজার হাজার বিল্ডিং-এর প্রকৌশলী হয়। ঐশী, তসলিমা ও লাকী হয়। ইত্যাদি। কওমী মাদ্রাসার সার্টিফিকেট স্বয়ং আল্লাহ মূল্যায়ন করেন। যার মূল্যের বিনিময় সারা দুনিয়া এবং তদমধ্যস্থিত সকল ধনভাণ্ডার তুচ্ছ ব্যাপার। তাই সরকারী বা পশ্চিমা শিক্ষার (?) চিন্তা না করে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার মূল্যায়ন করুন। ইত্যাদি। একটি নমুনা হিসেবে এই পেজের পোস্টগুলো দেখা যেতে পারে। ফেসবুক জুড়ে কওমীপন্থীদের এই ধরণের পেজ প্রচুর আছে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, কওমীপন্থীরা আলিয়া মাদ্রাসাকেও সমর্থন করে না। তারা বরং আলিয়া মাদ্রাসার বিরুদ্ধেও একই ধরণের প্রপাগ্যাণ্ডা ছড়ায়। এখানে একটি নমুনা আছে। অর্থাৎ তাদের দাবি অনুযায়ী একমাত্র কওমী মাদ্রাসাই সঠিক মানুষ (আদর্শবান মুসলমান) গড়ার কারখানা। শুধু তা-ই নয়, তাদের দাবি অনুযায়ী কওমীপন্থী ছাড়া বাকি সকলেই বাতিলপন্থী বা মুরতাদ।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সরকারী-বেসরকারী (নন্-কওমী) প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, গবেষক, আইনজ্ঞ, ইত্যাদি হয়েও কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন দেওয়ার মতো অনেকেই আছেন। আর রাজনৈতিক দলগুলো তো ভোটের লোভে না-দেখার না-শোনার ভান করে বালির মধ্যে মাথা গুঁজে আছে। কিছুদিন ধরে কওমীপন্থীদের কথাবার্তা নিজ চোখে দেখে আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে: মুসলিমদের মধ্যে নীরবে-নিভৃতে আরেকটি আইসিস সৃষ্টির পথ সুগম হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে আইসিস-এর মতো তাদের হাতেও অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদেরকে ভিন্নপন্থী মুসলিম নিধনে ব্যবহার করা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিশেষ গুরুত্বসহকারে লক্ষ্যণীয়-
যাহোক, কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের দাবিগুলোর উপর ভিত্তি করে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নিচে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো।
প্রথমত- নিজেরা কওমী মাদ্রাসাতে না পড়ে এবং সন্তানদেরকেও কওমী মাদ্রাসাতে ভর্তি করে না দিয়ে যারা কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন দেয় তাদের উদ্দেশ্যটা সর্বাগ্রে জানা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত- বলা হচ্ছে কওমী মাদ্রাসায় সঠিক মানুষ (আদর্শবান মুসলমান) তৈরী করা হয়। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যারা এই ধরণের দাবি করছে তারাই আবার উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচুর মিথ্যাচার করে। ভিন্নপন্থীদের বিরুদ্ধে গীবত গায় (তাদের কাছে নিজপন্থী ছাড়া বাকি সকলেই বাতিলপন্থী বা মুরতাদ)। ভিন্নপন্থী স্কলারদের বিরুদ্ধে ডাহা মিথ্যা অভিযোগ করে, তাদের নাম বিকৃতি করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও গালিগালাজ করে। এই ধরণের পোস্টে শত শত লাইক-শেয়ার-সমর্থন পড়ে। তাদের কাউকেই এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না। অথচ কোরআনে মিথ্যাচারের জন্য কঠোর শাস্তির কথা লিখা আছে। আর মিথ্যা গীবতকারীদের সম্পর্কে ইসলামে কী বলা আছে, সেটা তো তাদেরই ভালো জানার কথা। কাজেই তাদের দাবির সাথে হিসাব মিলেনা!
– কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা নন্-কওমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে বিষোদগার করছে। লেখার শুরুর দিকে কিছু উল্লেখ করা হয়েছে। তার মানে কি তারা রোগ-আপদে ডাক্তারের কাছে যায় না! প্রকৌশলীদের তৈরী করা বাড়িতে থাকে না! বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার করা কোনো কিছু ব্যবহার করে না! তারা কিন্তু কম্পুটার, সেলফোন, ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে এইসব কথাবার্তা বলছে! এইটা তো দিনে-দুপুরে আত্মপ্রতারণা।
– কওমী মাদ্রাসাতে যদি আসল ইসলাম শিক্ষা দেওয়া হয় তাহলে তারা ‘মুসলমান’, ‘মোছলমান’, ‘নামাজ’, ‘রোজা’, ইত্যাদি টার্মগুলো ব্যবহার করে কেন। কোরআন-হাদিসে তো এই টার্মগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই!
– কওমী মাদ্রাসার সার্টিফিকেট স্বয়ং আল্লাহ মূল্যায়ন করেন এবং সেই সার্টিফিকেটের মূল্যের কাছে সারা দুনিয়া এবং তদমধ্যস্থিত সকল ধনভাণ্ডার তুচ্ছ – এগুলো তারা জেনেছে কী করে! এই ধরণের কোনো কথা কোরআন বা হাদিসে লিখা আছে কি?
তৃতীয়ত- বলা হচ্ছে কওমী মাদ্রাসা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা সবাই জানি ইসলামের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী লেখালেখি হয়েছে (হচ্ছে, এবং হবে) ইংরেজীতে। কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা সেই ইংরেজী লেখাগুলো পড়ে বুঝবে কী করে, আর জবাবই বা দেবে কী করে! তারা কিন্তু বাংলা ভাষাটাও ঠিকমতো শিখে না।
– বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। অভিজিৎ রায়ের মতো অনেকেই বিজ্ঞান দিয়ে কোরআনকে বিভিন্নভাবে অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। এমনকি বিজ্ঞানের নামে স্রষ্টাকেও ‘নাই’ করে দেওয়া হয়েছে। সেই লেখাগুলো পড়ে মুসলিম পরিবারের তরুণরা নাস্তিক হচ্ছে। কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা সেই লেখাগুলোর কোনো জবাব দিয়েছে কি-না, কিংবা দিতে পারবে কি-না।
– বিবর্তনবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানের নামে বিবর্তনবাদ দিয়ে ইসলামের সৃষ্টিতত্ত্বকে ‘ভুল-মিথ্যা-অসার’ দাবি করে প্রচারণা চালাচ্ছে। সেই লেখাগুলো পড়েও অনেকে নাস্তিক হয়েছে। কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা বিবর্তনবাদীদের এই ধরণের অপপ্রচারণার কোনো জবাব দিয়েছে কি-না, কিংবা দিতে পারবে কি-না।
চতুর্থত- বিগত চৌদ্দশ’ বছরের ইতিহাসে কওমী মাদ্রাসা বলে কিছু না থাকলে এই পৃথিবীর বুক থেকে ইসলাম ‘নাই’ হয়ে যেত কি? কিংবা, আগামীকাল থেকে সারা বিশ্বের কোথাও কওমী মাদ্রাসা বলে যদি কিছু না থাকে সেক্ষেত্রেও কি এই পৃথিবীর বুক থেকে ইসলাম ‘নাই’ হয়ে যাবে? অর্থাৎ, কওমী মাদ্রাসা = ইসলাম? তাছাড়া রাসূল (সাঃ)-এঁর সময় কওমী মাদ্রাসা বলে কিছু ছিল কি?
– ধরা যাক, বিগত চৌদ্দশ’ বছরে এই পৃথিবীর বুকে কওমী মাদ্রাসা ছাড়া অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। সেক্ষেত্রে পৃথিবীটার অবস্থা কেমন হতো! আবার ধরা যাক, আগামীকাল থেকে সারা বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কওমী মাদ্রাসায় রূপান্তর করা হলো। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে পৃথিবীটার অবস্থা কেমন হতে পারে?
পঞ্চমত- একটি মাল্টিডিসিপ্লিন্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে পাঁচ হাজার ছাত্র পাশ করে বের হলে তাদের মধ্যে কিছু ডাক্তার, কিছু ইঞ্জিনিয়ার, কিছু আইনজ্ঞ, কিছু অর্থনীতিবিদ, কিছু রাজনীতিবিদ, কিছু সমাজবিজ্ঞানী, কিছু পদার্থবিদ, কিছু রসায়নবিদ, কিছু গণিতজ্ঞ, কিছু প্রযুক্তিবিদ, কিছু গবেষক, ইত্যাদি, ইত্যাদি-সহ কিছু ইসলামিক বিশেষজ্ঞও তৈরী হয়। তাদের সকলেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখে। অন্যদিকে একটি কওমী মাদ্রাসা থেকে বছরে পাঁচ হাজার ছাত্র পাশ করে বের হলে তাদের সকলেই মূলত আরবী ও ইসলাম বিষয়ে জানে – যা কওমী মাদ্রাসাতে না পড়েও জানা সম্ভব, অনেকেই জানছে। বরঞ্চ কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা ইসলাম (বিশেষ করে কোরআন) সম্পর্কে কতটুকু জানতে পারে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বেশ কিছুদিন ধরে তাদের লেখালেখি দেখে সন্দেহটা আরো ঘণীভূত হচ্ছে। তারা মূলত আরবী জানার অহংবোধ দেখায়, যদিও আরবীটাও কতটুকু শিখে কে জানে! তারা তো আর আরবীভাষীদের চেয়ে ভালো আরবী জানতে পারবে না। তাহলে লাভটা কী হলো, আর অহংবোধেরই বা কী আছে। অধিকন্তু, কোরআনে কিছু আয়াত আছে যেগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়। কিছু আয়াতের ব্যাখার জন্য গণিতের জ্ঞানও দরকার হয় (যেমন: পারিবারিক আইন)। এমনকি কিছু আয়াতে প্রকৃতিজগত নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করার কথাও বলা হয়েছে। কওমী মাদ্রাসাতে প্রকৃতিজগত নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করার মতো কোনো ব্যবস্থা আছে কি? কাজেই যেকারো বুঝার কথা যে, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা এমনকি ইসলামকে ব্যাখ্যা করার জন্যও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়! তাহলে এই ধরণের অত্যন্ত সংকীর্ণ গণ্ডির শিক্ষাব্যবস্থা মুসলিম জাতিকে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে দেবে না কি?
নোট: এই পোস্ট’টা দেওয়া হয়েছে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। এখানে অন্যান্য পন্থীদের আলুপোড়া খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
সূত্র : সদালাপ