অধ্যক্ষ মো. শাহ আলম (এম.পি) : প্রাগৈতিহাসিক তথা প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষা মানব জীবনের বেঁচে থাকা, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নের নিয়ামক তথা মানব সম্পদ সৃষ্টির অন্যতম অনুসঙ্গ হলেও, পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলো তথা ২০১১ সনের বাংলাদেশে এখনো চলছে টোল, মঠ, কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক মধ্যযুগীয় অনাধুনিক আধ্মাতিক শিক্ষাধারা। এ শিক্ষাধারায় প্রকটভাবে লক্ষণীয় আদর্শিক দৈন্যতা ও কাংখিত গোল সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা। যে ধারা মূলত একুশ শতকের প্রগতিশীল ধারার বিপরীত এক পারলৌকিক ধারায় আমাদের ধরে রাখছে অনুন্নয়নের এক অনুন্নয়ন চক্রে। এ ধারারই এক শিক্ষা ব্যবস্থার নাম হচ্ছে ‘কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক’ শিক্ষা। যেখানে একুশ শতকের বিশ্ব অন্যান্য শিক্ষার মত ধর্মভিত্তিক শিক্ষায়ও এনেছে ব্যাপক আধুনিকায়ন তথা বিজ্ঞান মনস্কতা, সেখানে আমাদের ধর্মভিত্তিক শিক্ষাধারা আমাদের সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছে কোথায়! এ শিক্ষাধারার গভীরে প্রবেশের আগে এক নজরে দেখা যাক এদেশের কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক শিক্ষার ‘এটুজেড’।
এদেশে ১৯০১ শতকের দিকে এ ধারা শুরু হয় মূলত বৃটিশ শাসনামলে বৃটিশদের আনুকূল্যে, যারা নিজেরা প্রগতিশীল শিক্ষার পক্ষে থাকলেও, এ জাতিকে কওমি মাদরাসা কেন্দ্রিক, টোল-মঠ কেন্দ্রিক, তাবলীগ জামাত কেন্দ্রিক পারলৌকিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখে একটি ‘চক্রে’ আবর্তন করাতে চেয়েছিল যুগ যুগ ধরে। যার ফলশ্র“তি এখনো বয়ে চলছে এ দেশের সহজ সরল ধর্মপ্রাণ লক্ষ মানুষ। দেশ বঞ্চিত হচ্ছে তার সন্তানদের প্রযুক্তি ও উন্নয়ন নির্ভর সেবা থেকে।
বর্তমানে এদেশে কমপক্ষে ৫০০০ কওমি মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে নানাবিধ যাকাত, ফিতরা, চাঁদা, অনুদান ইত্যাদির মাধ্যমে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রধান পাঠ্যক্রম হিসেবে ইসলাম ধর্মের পবিত্র কোরআন, হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, আরবী কালাম, আরবী সাহিত্য, উর্দু ও ফার্সী ভাষার বিভিন্ন কিতাব অন্তর্ভুক্ত। কোন কোন কওমী মাদ্রাসায় অল্প-বিস্তর বাংলা, ইংরেজী, গণিত ইত্যাদি ‘অপ্রধান বিষয়’ হিসেবে পড়ানো হয়। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্যে সরকারী কোন সংস্থা, সংগঠন, বোর্ড বা কার্যক্রম নেই। সরকারী কোন অনুদানও গ্রহণ করেনা বর্ণিত মাদ্রাসাগুলো নিজেদের ‘স্বাধীন সত্তা’ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই ধরণের কওমী মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় কমপক্ষে ১৯টি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ‘শিক্ষা বোর্ডে’র মাধ্যমে। এর মধ্যে কোন কোন ‘বোর্ড’ জোটভুক্ত, আবার কোনটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়। বর্তমানে সারাদেশে গড়ে ওঠা কওমী মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা বোর্ডগুলো হচ্ছে যথাক্রমে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, এদারায়ে তালিমিয়া দীনি বোর্ড, তালীমী বোর্ড মাদারিসে কওমিয়া আরাবিয়া বাংলাদেশ, আজাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম সিলেট বিভাগ, তানযীমুল মাদারিসিল কওমিয়া, কুমিল্লা তানযীমুল মাদারিস, দক্ষিণ ঢাকা এদারা, কওমী মাদরাসা ঐক্য পরিষদ, তানযীমুল মাদারিস, বেফাকুল মাদারিস কওমিয়া, আজাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ, দ্বীনী শিক্ষা বোর্ড, আঞ্জুমানে ইত্তিহাদিল মাদারিস, তানজিমুল মাদারিস, ইলহাকুল মাদারিস, ভোলা জেলা তানযীমুল মাদারিস, উলামা বাজার মাদরাসা ফেনী, রাজশাহী বিভাগ তানজিমুল মাদারিস। ১৯টি স্বতন্ত্র বোর্ড দেখেই বোঝা যায় ধর্মকেন্দ্রিক এ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও অনৈক্য কত প্রকট!
এ সমস্ত মাদ্রাসা গুলো মূলত প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও পরবর্তী পর্যায়ের যার সংখ্যা এদেশে কমপক্ষে ৫২৫০টি, যার তথ্যচিত্র নিম্নরূপ – তাকমীল বা কামিল স্তরের ৪০০টি, ফযীলত বা ফাজিল স্তরের কমপক্ষে ১৯৩টি, সানাবিয়া উলইয়া বা আলিম স্তরের ২৮৩টি, মুতাওওয়াসসিতাহ বা নিম্নমাধ্যমিক স্তরের ১৫৩০টি, হিফযুল কোরান ২০৯২টি। বর্ণিত মোট ৫২৫০টি মাদ্রাসায় তাকমীল বা কামিল পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৬০০০, ফযীলত বা ফাজিল স্তরে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমপক্ষে ৮৩০০০, সানাবিয়া উলইয়া বা আলিম স্তরে ৯২০০০, মুতাওওয়াসসিতাহ বা নিম্নমাধ্যমিক স্তরে ১২০,০০০, ইবতিদাইয়াহ স্তরে কমপক্ষে ৫৭৭,০০০ এবং হিফযুল কোরান বা সর্বনিম্ন স্তরে ৪,৭০,০০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এ সকল মাদ্রাসায় মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ, যা অনেক দেশের জনসংখ্যার সমান। প্রায় সকলেই বাংলাভাষী শিক্ষার্থীরা এ সকল মাদ্রাসার ‘স্টেক-হোল্ডার’ হলেও শ্রেণী বিভাজন ও স্তর বিভাজন সবই আরবী কেন্দ্রিক। যেমন প্রাইমারী স্তরের শ্রেণীগুলো হচ্ছে, আছ ছয়ফুল আউয়াল. আছ ছয়ফুস সানী, আছ ছয়ফুস সালিস, আছ ছয়ফুর রাবি, আছ ছয়ফুল খামিছ ইত্যাদি। মাধ্যমিক স্তরের শ্রেণী বিন্যাস হচ্ছে আছ ছয়ফুস সাদিস বা জমায়াতে মিযান, আছ ছয়ফুস সাবি (নাহবে মীর), আছ ছয়ফুস সাদিন (হিদাতুন নাহবে), আছ ছয়ফুস তাসি (জমায়াতে কাফিনা), আছ ছয়ফুল আশির (শরহে জামি), শরহে বেকায়া, হিদায়া আউয়ালাইন, মারহালাতুল ফজিলাত, (সালিম/মিশকাত), মারহালাতুত তাকমীল ও দাওরায়ে হাদিস। শিক্ষক কর্মচারীদের পদবিন্যাস এ রকম মুহতামিম, নায়েবে মুহতামিম, নাজেমে তালিমাত, শাইখুল হাদিস, মুহাদ্দিস, মুফতী, হাফেজ, কারী ইত্যাদি। উত্তীর্ণের গ্রেডেশন হচ্ছে যথাক্রমে মাকবুল, জায়্যিদ, জায়্যিদ জিদ্দান এবং মুমতাজ।
এগুলো পরিচালনার জন্যে আবার আছে ইহতিমাম বিভাগ, মজলিসে ইলমী তথা তালিম ও তাবরিয়াত বিভাগ, কুতুবখানা বিভাগ, ইফতা বিভাগ, দাওয়া ও ইরশাদ বিভাগ, তাফনীফ ও তাকরীর বিভাগ, দারুল ইকামাহ বিভাগ, মাতবাখ বিভাগ ইত্যাদি। এ ছাড়া আর্থিক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে যাকাত, ফিতরা, মান্নত, সাদকা, দান, মাসিক চাঁদা, বাৎসরিক চাঁদা, সদস্য চাঁদা, মওসুমী ফসলের আয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশভিত্তিক চাঁদা সংগ্রহ, সরকারী অনুদান, কোরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি ইত্যাদি নানাবিধ আয় উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
ধর্মতত্ত্বে অধ্যয়নের জন্যে আজকের খ্রীস্ট সমাজে প্রথমে একজন শিক্ষার্থীকে সাধারণ শিক্ষা মানে ভাষা, গণিত, ইতিহাস, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, সাংবাদিকতা, উন্নয়ন, চিকিৎসা, প্রকৌশল, দর্শন, মনোবিদ্যা কিংবা আধুনিক জ্ঞানশাস্ত্রের যে কোন এক বা একাধিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের শিক্ষা অর্জন তথা স্নাতকোত্তর, এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের পর তাকে নির্বাচন করা হয় ধর্মতত্ত্ব তথা ঞযবড়ষড়মু অধ্যয়ন করার জন্যে। ঞযবড়ষড়মু বিষয়টি পড়তে গিয়ে কেউ অধ্যয়ন করে থাকে খ্রীস্ট ধর্ম, কেউ একেশ্বরবাদী অন্যান্য ধর্ম (যেমন ইহুদী বা ইসলাম), কেউবা বহুদেবতাবাদী ধর্ম কিংবা তুলনামূলত ধর্মতত্ত্ব। নাস্তিক্যবাদ সম্পর্কেও পাঠ্যক্রম নির্ধারিত থাকে ঞযবড়ষড়মু-তে। কমপক্ষে ৩-৪ বছরের এ পাঠ্যধারা সমাপ্তির পর প্রকৃতপক্ষেই একজন থিউলজিস্ট বুঝতে পারে নিজ ধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের পার্থক্য। নিজ ও অপর ধর্মকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বিজ্ঞানভিত্তিক যোগ্যতা অর্জন করে সে নিজে। আধুনিক ইহুদী, বৌদ্ধ, শিন্টো ধর্মের শিক্ষাও অনেকটা বর্ণিত রূপে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়া হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু আমাদের এদেশে উপর্যুক্ত অধিকাংশ কওমী মাদ্রাসায় আধুনিক জীবন সম্পৃক্ত শিক্ষা পদ্ধতি ও উপকরণ ব্যবহারের বদলে প্রাচীন পদ্ধতির মুখস্ত ও লেকচার নির্ভর শুদই নিজ ধর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে যে মানব সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে, তা ‘না ঘরকা না ঘাটকা’। এখানের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের পত্রিকা-জার্নাল পাঠ, রেডিও-টিভি দেখা, ইন্টারনেট জগতের বাইরে রেখে, বিতর্ক-কো-কারিকুলার কার্যাবলীতে অংশ নিতে নিরুৎসাহিত করে মূলত এদের অনেককেই অনাধুনিক এক অন্ধকার সমাজের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। বর্ণিত শিক্ষা সম্পন্নের পর অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসা পাস শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক আধুনিক বিশ্বে টিকতে পারছে না আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর অন্যান্য প্রতিযোগিদের সামনে। সমদক্ষতা অর্জনে তারা অদক্ষ থাকাতে, পিছিয়ে পড়ছে সমাজ, রাষ্ট্র তথা গ্লোবাল বিশ্বে। আবার মৌলিক গবেষণামূলক ধর্মীয় জ্ঞান প্রচলিত অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসাগুলোতে অনুপস্থিত থাকাতে, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও গবেষণামূলক কোন নতুন জ্ঞান বের হচ্ছেনা বর্ণিত শিক্ষায় শিক্ষিত অধিকাংশ ব্যক্তিদের মগজের ভেতর থেকে। যে কারণে আধুনিক শিক্ষায় স্নাত একজন খ্রীস্টান ‘যাজক’ কিংবা ইহুদী ‘রাব্বী’ যেখাবে তাদের ধর্মীয় যুক্তি নির্ভর ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারছে, সেভাবে পারছে না কওমী মাদ্রাসা থেকে ডিগ্রীধারী মুফতি কিংবা অধিকাংশ শায়খুল হাদিসগণ। এমনকি এ ধারায় শিক্ষা সমাপ্তকারীগণ নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্যে বিজাতীয় লোকজন ছাড়াও, স্বজাতির কাছেও নানাভাবে নিগৃহীত হতে হচ্ছে কওমী কেন্দ্রিক শিক্ষা সম্পন্নকারী ব্যক্তিদের।
এ থেকে উত্তরণ দরকার দেশ, জাতি ও নিজ ধর্মকে রক্ষার জন্যেই। আর তার জন্যে প্রয়োজন কওমী মাদ্রাসার আধুনিকায়ন। আধুনিকায়নে প্রথম দরকার মাদ্রাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে এর পাঠ্যধারা নির্ধারণ, শিক্ষার গুণগত মান ও শিক্ষার্থীদের জীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করণ। তাহলে হয়তো এক সময় কওমি মাদ্রাসাগুলো ঘুরে দাড়াবে, জেগে উঠবে এর সনাতন ধারার শিক্ষার্থীরা, টিকবে দেশে এবং বিদেশেও, যারা মূলত এদেশেরই সন্তান এবং আমাদের অব্যবহৃত সম্পদ।
লেখক : সংসদ সদস্য, পিরোজপুর-২
সূত্র : নিউজবাংলা.কম