খতিব তাজুল ইসলাম:
আলেম হাফেজ ইমাম খতিব ও ইসলামের মুবাল্লিগ বানানোর জন্য এই সমস্ত দ্বীনী মাদরাসা। এই কথাটির মাঝে সামান্যতম কোন সন্দেহ যে করবে তার আক্বলে সলীম আছে কিনা প্রশ্ন জাগার যথেষ্ট কারণ আছে। হ্যাঁ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর জন্য স্কুল কলেজ আছে। যার ডাক্তার হওয়ার শখ সে সেখানে যাক। আলেম হতে হলে মাদারাসায় আসুক। সরল এই কথাটায় কোন বিভক্তি বা ধুম্রজাল আছে বলে আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না। তাহলে আমরা কি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, স্কুলগুলো চলুক তাদের মতো করে, মাদরাসা চলুক নিজেদের মতো করে। মাদরাসার ফারেগীনগণ থাকবে তাদের কর্মক্ষেত্রে, ওরা থাকবে ওদের কর্মস্থলে। কবর জিয়ারত বিয়ে পড়াতে নামাজের ইমামতি তাবীজ কবজ দোয়া দুরুদের সময় পড়বে হুজুরের ডাক। আর বাকী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হুজুরগণ তাদের ডাকবেন। সমস্যা আর থাকলো কই?
দেশ রুল করবে তারা, হুজুরগণ শাসিত হবেন। হুজুরদের তনখা আসবে তাদের পকেট থেকে আর তাদের তনখা আসবে রাষ্ট্রের খাজানা থেকে। সে হিসাবে কোন সমস্যাই রইলো না! তাহলে আমাদের প্রবলেম কোথায়? হুজুর আর মিস্টারের মাঝে এতো বৈপরিত্য কেন? স্কুলের সিলেবাস হিন্দু না মুসলমান আছে তাতে কী আসে যায়? এই হলো আমাদের চলমান অধিকাংশ কওমি প্রজন্মদের কিছু চিন্তার পরিসর।
আসলে এভাবেই কিন্তু সমীকরণ মিলে যাচ্ছে। হুজুরদের মেধা যোগ্যতা বুদ্ধিমত্তায় নয়, তাদের সংখ্যাগত আধিক্যে মিস্টাররা শংকিত। তাই জংগী মৌলবাদি বলে কোণ্ঠাসা করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। আর হুজুরগণ নাকে খত দিয়ে জংগী বিরোধী ফতোয়া মানব বন্ধন করে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে প্রাণান্তর। যদিও জংগীগুলো জীবনে মসজিদ মাদরাসার ধারে কাছে যায়নি। তারা জানে এভাবে হাজার বছর গেলেও হুজুররা ক্ষমতার বারান্দায় উঠতে পারবেন না। তারপরও মিছিল মিটিং রাস্তার চিল্লাচিল্লি কিছুটা হলেও বিগ্ন সৃষ্টি করবে সন্দেহ নেই।
তথাপি আমারা আধ্যাত্মিক মমতায় অলিক এক স্বপ্নে বিভোর। কাজ করা আমার কাজ খেলাফত কায়েম করা কোরআনের সমাজ কায়েম হওয়া আল্লাহর কাজ, তিনি চাইলে খোদার রাজ অটো কায়েম হবে। তিনি চাননি বলেই হচ্ছে না। তাতে আমাদের কোন দায় নেই, দোষ নেই, অপরাধ নেই! এজন্য আমরা দেখেছি শাপলার হত্যাযজ্ঞের পর আমীরে হেফাজত দোয়া দিবস পালন করেছেন। কারণ সকল ফরীয়াদ আল্লাহর দরবারে পৌছিয়ে দেয়া হয়েছে। যা করার তিনি করবেন। যাকে ধরার তিনি ধরবেন। আমাদের করার কিছু নেই। কত সুন্দর সমাধান? সহজ সরল সমীকরণ! সুবহানাল্লাহ!
ব্যাপারটা যদি তাই হতো, তাহলে রাহমাতুল্লিল আলামীন কেন বদর ওহুদ খন্দকে জীবনের ঝুকি নিতে গেলেন? তায়েফে কেন রক্ত ঝরাতে গেলেন? কেন তিনি নিজে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করলেন? খোলাফায়ে রাশেদীনরা কেন তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনাকে ইবাদত হিসাবে গন্য করলেন? তাঁরাতো চাইলে সবকিছু আল্লাহর হাতে সমজিয়ে দিয়ে দোয়াতেই মশগুল থাকতে পারতেন? ইসলাম তাঁরা কম বুঝেছেন আমরা খুব বেশি বুঝে ফেলেছি মনে হয়? হায় আফসোস!
এবার আসি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কাহিনীতে
আচ্ছা আপনাদের কারো জানা থাকলে আমাকে সন্ধান দেয়ার অনুরোধ থাকলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান বা প্রাইমারি ও হাই স্কুলের। যে শুধু ডাক্তার বানায়। অন্য আরেকটি প্রাইমরী ও হাই স্কুলের যারা কেবল ইঞ্জিনিয়ার বানায়। অন্য আরেকটি প্রাইমারী ও হাই স্কুলের যারা শুধু বিচারক বানায়! পারবেন?
পারবেন না। বোকার মতো কিছু একটা বলে ফেললাম কাজে লাগুক কিংবা না। দুনিয়ার কোথাও প্রাইমারী ও হাইস্কুল থেকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার প্রকৌশলি বের হয়ে আসে না। আসার প্রশ্নই না। যাকে বলে প্রবেশিকা বা সাধারণ জ্ঞানের স্তর। বাংলাদেশে দশম’র পর আর উন্নত বিশ্বে ক্লাস এইট থেকে শিক্ষক অভিভাবকগণ শিক্ষার্থী কী হবে, তাকে একটু ধারনা দিতে থাকেন। এসএসসির পর এইচএসসি থেকে শুরু হয় কে কোথায় যাবে, কে কী হবে? এই সামান্য কথাটা প্রথম আমাদের ঘিলুতে ঢুকানো দরকার।
ইউরোপ-আমেরিকার কওমি মাদরাসগুলো একটা মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। দশম বা মেট্ট্রিক পর্যন্ত চলে সমান্তরাল কম্বাইন্ড সিলেবাস, স্কুল মাদরাসা একসাথে। ১০ম’র পর আলিমি ক্লাস চলে মাদরাসাগুলোতে। কোথাও ৪ বছর কোথাও ৬বছর ব্যাপী। তাতে শিক্ষার্থীরা উভয় শিক্ষার ফায়দা একসাথে পেতে সক্ষম হয়। কেউ কেউ দিনে পড়ে কলেজে রাতে পড়ে আলিমি কোর্স। অধিকাংশরা প্রথম আলিমি কোর্স আগে সম্পন্ন করে। তাদের সুরত এবং সীরত বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানের কওমি মাদরাসা থেকে কোন অংশে কম নয় বরং উন্নত।
আসল কথা হলো মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমনই এক আয়োজন ছিলো যেখানে প্রবেশিকা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সাধারণ জ্ঞানে পারদর্শি হওয়ার পাশাপাশি দ্বীনী জ্ঞানেও তারা অভিজ্ঞ হয়ে উঠতো। তিউনিসিয়ার জামেয়া আল-করউইনের কথা বলুন কিংবা সুদানের জামেয়া আজ-জাইতুনা অথবা মিশরের পুরাতন জামেয়া আল-আজহার। একই প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া করে আলেম হয়েছেন হাফিজ হয়েছেন মুফতি মুহাদ্দিস সবই হয়েছেন। তার পাশাপাশি বিজ্ঞানীও হয়েছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো কুফরের ষড়যন্ত্রে জাতীয় শিক্ষা থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করা হয়েছে। আর মাদরাসা শিক্ষাকে করা হয়েছে শুধু নামাজ রোজার তা’লিম হিসাবে। অতএব সেইদিন ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের কৌশলি হতে হবে। গড়ে উঠা অসামঞ্জস্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সময় নিবে তবে থাকতে হবে কঠোর পরিশ্রমি ও সংগ্রামি হয়ে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা বলবো নিজস্ব পরিমণ্ডলে শিক্ষার্থীদের জন্য জিসিএসি বা ১০ম বা মেট্রিকের আয়োজন ভালভাবে করুন।প্রয়োজনে সরকার ফান্ড প্রদান করুক, যাতে স্কুল সিলেবাসের শিক্ষকদের বেতন নিয়ে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়তে না হয়। কওমির সিলেবাস চলবে কওমির মতো করে। ১০ম’র পর কওমিতে হবে আলিমি কোর্স। যেভাবে এখন চলছে তারচেয়ে ভাল করে চলুক। স্বীকৃত মেট্রিকের পড়া শেষে পরবর্তি আলিমি শিক্ষার জন্য স্বীকৃতির খুব একটা প্রয়োজন নেই। এমন হলে কেমন হবে, উলামায়ে কেরাম একটু ভেবে দেখবেন।
এটাই হলো মাদরাসাকে স্কুল করার কাহিনী। এখানে কোন কিছুরই পরিবর্তন আসছে না। বরং মেধার বিকাশ ঘটবে, শিক্ষা শেষে আলেমগণ বৃহত্তর পরিসরে দ্বীনী খেদমতের বিরাট সুযোগ পাবেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সহিহ সমঝ দান করুন। আমিন।