মুফতি মুহাম্মাদ মুহিউদ্দীন কাসেমী:
২০১১ সনে জামিয়া রাহমানিয়ায় বেফাকের নেগরান ছিলাম। সহকারী নেগরান। নেগরানে আলা ছিলেন মাও. আবদুল গাফফার সাহেব। কিশোরগঞ্জে বাড়ি। বর্তমানে জামালুল কুরআন মাদরাসার মুহাদ্দিস। একসময় ময়মনসিংহের জামিয়া ইসলামিয়ায় নাজেমে তালিমাত ছিলেন; তখন মুহতামিম ছিলেন মাও. মরহুম শরফুদ্দীন এবং বিখ্যাত লেখক মাও. যাইনুল আবিদীন সাহেব তখন তরুণ উস্তাদ।
মাও. আবদুল গাফফার সাহেব বিয়ে করেছেন আমাদের গফরগাঁওয়ে।
মোট এগারজন নেগরান ছিলাম। রাহমানিয়ার নাজেমে তালিমাত মুফতি আশরাফুজ্জান সাহেব স্থানীয় নেগরান ছিলেন। বেশ আন্তরিকতার পরিচয়ে দেন।
নেগরানদের নির্দেশিকা সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র আছে। নেগরানে আলা বললেন, আমরা এগুলো পড়ে শুনব। হালকায়ে তালিমের মতো। আমাকে পড়তে বললেন। আমি পড়তে শুরু করে পুরাই থ! হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। প্রতিটি লাইনে লাইনে ভুল। একটি শিক্ষাবোর্ডের কাগজপত্র এমন হতে পারে! হুজুরকে সবিনয়ে আরজ করলাম। বললেন, পরে দেখব; এখন পড়েন।
পরের দিন আমাকে বললেন, ভুলগুলো আমাকে দেখান। লাল কালি দিয়ে রঞ্জিত করে দিলাম। উনিও আশ্চর্যান্বিত হলেন। পরে বললেন, আমি বেফাকের মহাসচিবকে বলব। উনি বেফাকের নিরীক্ষা কমিটির সদস্যও বটে এবং মহাসচিবের কাছের লোক। আজও ঠিক হয়েছে কি না, জানি না।
৭/৮ মাস পর আমাকে হঠাৎ একদিন ফোন দিলেন মাও. আবদুল গাফফার সাহেব। বেফাকে কাজ করার কথা বললেন। আমি সম্মত হলাম। একদিন আমাকে নিয়ে মহাসচিবের কাছে গেলেন। ওই মজলিসে মাও. আহসান হাবীবও ছিলেন। যিনি ফিদায়ে মিল্লাত মাও. আসআদ মাদানি রহ. এর খলিফা। মজলিসে অনেক কথা হয়। একপর্যায়ে বেফাকের বাংলা বইগুলোর করুণদশার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। হাতেনাতে দেখিয়ে দিলাম। এও বললাম, আপনার রুমের সামনে কার্যালয় বানানটিও ভুল!
হেসে বললেন, মাওলানা! শুনেন, বেফাকের প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে একজন নেগরান এল ময়মনসিংহ থেকে। তখন অফিস ফরিদাবাদ মাদরাসায়। তাকে দস্তখত করতে বললাম। উনি বললেন, আমি তো বাংলায় দস্তখত করতে পারি না!
এমন অবস্থা হতে বেফাকই উত্তরণ ঘটিয়েছে। আপনি যে বাংলা পারেন, এর অবদান কার? বেফাকের। আমি অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করলাম। আরও বললাম, বেফাককে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার পেছনে আপনার ত্যাগ ও অবদান অনস্বীকার্য। তবে আরও এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
পরে ওই কাজ করতে আমি সম্মত হইনি। ফুলটাইম থাকতে হবে। আমি ভেবেছিলাম, উনি কাজ দিবেন, কাজ করে জমা দেব।
.
কওমি মাদরাসাসমূহের সবচেয়ে বৃহৎ বোর্ড হচ্ছে বেফাক। বেফাকের সকল অবদান স্বীকার করেও বলতে পারি, বেফাক আরও গতিশীল, প্রাণবন্ত ও যুগোপযোগী হওয়া সময়ের দাবি। বছরে একবার পরীক্ষা নেওয়াই কোনো শিক্ষাবোর্ডর কাজ হতে পারে না। নামে মাত্র কয়েকটি বাংলা বই ছাপিয়েছে। বইগুলোর করুণ অবস্থা দেখলে কান্না আসে!!
অথচ আমি সাহস ও গর্বের সাথে বলতে পারি, আজকের বাংলাদেশে ইসলামী লেখকদের সিংহভাগ কওমি মাদরাসার সন্তান। বাংলাসাহিত্যে তাদের যোগ্যতা ঈর্ষণীয়। তাঁরা কেন উপেক্ষিত?
তদ্রূপ সিলেবাস নিয়েও ব্যাপক গবেষণা দরকার। পরিবর্তনের ছোঁয়া যে একবারে লাগেনি, তা না। অনেক পরিবর্তন ও সংস্কার হয়েছে; আরও দরকার।
বিক্ষিপ্ত কওমি মাদরাসাগুলোকে এক সিলেবাস ও একক কারিকুলামের অধীনে নিয়ে আসা জরুরি। উচ্চ শিক্ষার স্বার্থে বিদেশে যাওয়ার শিক্ষাচুক্তি, শিক্ষকদের কল্যাণে অবদান রাখা– ইত্যাদি বিষয়ে বেফাকের ভূমিকা রাখা দরকার।
স্বীকৃতির আবশ্যকতা সম্পর্কে মতৈক্য আছে বলেই আমার মনে হয়। স্বীকৃতি আদায়ের পদ্ধতি, স্বীকৃতিদাতার চেহারার রঙ এবং স্বীকৃতি আদায়ের কৃতিত্ব ও নেতৃত্ব নিয়ে মতানৈক্য হতে পারে। স্বীকৃতি হচ্ছে হচ্ছে করেও হচ্ছে না। স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক আওয়াজ উত্তোলনকারী আমাদের উস্তাদ হযরত শায়খুল হাদিস রহ. এর ইন্তেকাল হয়ে গেলেও আজও আমরা স্বীকৃতির মুখ দেখতে পারি নি।
কমাশিসার কাছে আমার আশা
কওমি মাদরাসার সন্তানরাই মাদরাসার স্বার্থ নিয়ে ভাবেন, চিন্তা করেন। কমাশিসার লোকজনও কওমির সন্তান। তারা কওমি মাদরাসার উন্নয়ন এবং সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামীকরণের দাবি উঠিয়েছে। কোনো বিষয়ে আলাপ-আলোচনা-পর্যালোচনা হলে বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করা যায়। লাভ-ক্ষতি জানা সহজ হয়।
কমাশিসার বিভিন্ন প্রকাশনা দেখেছি। দাবিগুলো যৌক্তিক ও সময়োপযোগী মনে হয়েছে। এগুলো শুধু তাদের দাবি নয়; প্রত্যেকটি কওমি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মনের কথা, হৃদয়ের ব্যথা।
তবে অনলাইনে কমাশিসার অনেক লেখা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তাদের কিছু মন্তব্য আমার ভালো লাগেনি। দাওয়াত ও ইসলাহের ভাষা আরও মার্জিত ও শালীন হওয়া আবশ্যক। এসব বিবেচনা করে কমাশিসার প্রতি আমার কয়েকটি আশা :
০১. বিতর্কের সামান্য সম্ভাবনা রাখে এমন কোনো লেখা পোর্টালে দিবেন না।
০২. কোনো মুুরুব্বি বা কারো নাম নিয়ে সমালোচনা করবেন না।
০৩. ভাষা আরও মার্জিত হওয়া কাম্য।
০৪. খতিব তাজুল ইসলাম সাহেব সহ আমরা দেশের উল্লেখযোগ্য কেউ না; তবে উনার শ্বশুর বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম প্রিন্সিপাল মাও. হাবীবুর রহমান দা.বা.। কমাশিসায় তাঁর মতো জাতীয় আলেম ও চিন্তকদের সামনে রাখুন। তখন কেউ বিতর্কের সাহসও পাবে না।
০৫. ২০০৫ সনে পল্টন ময়দানে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্র কনভেনশন হয়। ছাত্রদের নামে হলেও তৎকালীন ছাত্র মজলিস ও রাহমানিয়ার ছাত্রদের অবদান ছিল বেশি। ওইসব ছাত্রনেতাদের কমাশিসায় ভিড়ানোর চেষ্টা করুন।
০৬. তরুণ আলেমদের বৃহৎ একটি অংশ স্বীকৃতি ও সংস্কারের পক্ষে। প্রত্যেক জেলায় তরুণ আলেমদের পাশাপাশি প্রবীণদেরও যুক্ত করার চেষ্টা করুন। বিশেষত এমন আলেমদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করুন, যাদের ডাকে হাজারো আলেম-ওলামা সাড়া দিবে। যেমন মাও. মামুনুল হক সাহেব।
০৭. আপনাদের দাবিগুলো সুন্দরভাবে পেশ করুন। কেউ না মানলে তার বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা বা খারাপ মন্তব্য করা হতে বিরত থাকুন।
০৮. ঢাকা অথবা ঢাকার আশপাশে বিশাল একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করুন নমুনাস্বরূপ। এটি একটি নমুনা হবে। আপনাদের দাবির নমুনা। সফলতা আসলে আপনাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
—-
দালালির লকব দেওয়া আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে নিরপেক্ষ থাকা সত্যিই কঠিন। আমরা যারা ইসলামের কথা বলি, আমরাও কুরআন-সুন্নাহর মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করছি না। বেফাক মানববন্ধন করে কোটি টাকা পেল, এটা কি আমি নিজে দেখেছি? কোনো প্রমাণ আছে? প্রমাণ ছাড়া এমন কথা বলা জায়েয?
অতি আবেগী কেউ কেউ বলে বসল, কমাশিসা টাকা খেয়ে এসব করছে!
টাকা কার কাছ থেকে খেল? টাকা লেনদেনের মুহূর্তে কি আপনি হাজির ছিলেন? কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী কেউ সাক্ষ্য দিয়েছে? কমাশিসার লোকজন নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে কাজ করছেন। কাজটি আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হলেও কি এরকম অপবাদ দিতে পারি???
হাজীক্যাম্পের সন্নিকটে হলিক্রিসেন্ট হোটেলে কমাশিসার একটি সেমিনারে কয়েকশ টাকা ভাড়া বাবদ খরচ করে অংশগ্রহণ করেছিলাম। দু পয়সাও তো পাইনি!
ভাই, আসুন ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধা করতে শিখি। ইমাম আবু হানিফা রহ. বিচারকের পদ ফিরিয়ে দেওয়ায় জেলে পর্যন্ত গেছেন। অথচ তাঁর শাগরিদ ইমাম আবু ইউসুফ বিচারকের পদে আসীন হলেন। বিচারকের পদে আসীন হয়ে ইমাম আবু ইউসফ কি স্বীয় উস্তাদকে বেকুব ভেবেছেন?
কওমি মাদরাসা ইসলাম রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। একে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।
স্বীকৃতি একজন নাগরিকের অধিকার। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হক।
হুকুক দিয়ে নেহী যাতে, লিয়ে যাতে হয়।
কেউ বাড়িতে এসে হক দিয়ে যায় না, হক আদায় করতে হয়।