রওশন জমির : সরকার পরিচালিত ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ শিক্ষা-ব্যবস্থা এবং ধর্মাশ্রিত মাদরাসা-শিক্ষার বাইরেও বাংলাদেশে দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান। একটি হল বিত্তবানের ইংলিশ মিডিয়াম, অপরটি হল তুলনামূলক বিত্তহীন-নিম্নবিত্ত বা কদাচিৎ মধ্যবিত্তের পরকালনির্ভর কওমি মাদরাসা।
সুদীর্ঘকাল তথা মুসলিম শাসনামলে এ মাদরাসা-শিক্ষাই মুসলিম সমাজের একমাত্র শিক্ষার বাহন ও মাধ্যম ছিল। তখন শিক্ষিত বলতে শুধু এ ধারা থেকে পাঠ-নেওয়া মানুষদেরই বোঝানো হত। যদিও কারো কারো মতে, তখনকার ধর্মভিত্তিক সিলেবাসে জাগতিক ও প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা এখন নেই।
ব্রিটিশ শাসনের সময় নানা অবহেলা-অবিশ্বাস আর কূটচালের কারণে উপমহাদেশে মাদরাসা-শিক্ষা নতুন মাত্রা লাভ করে। ব্রিটিশ-বিতাড়নের পরও এ মাদরাসার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে গতিলাভ করে। এর পরিচালনা, অর্থায়ন ও চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন এলেও যেহেতু শুরু থেকেই তা জনতার অনুদান নির্ভর, তাই এর নাম কওমি তথা জাতীয় মাদরাসা বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান; আর এ জন্যই একে সব সময় স্বকীয়তা বজায় রেখে চলতে হয়। কোনো শাসক বা গোষ্ঠীর সরল রেখায় একে লীন হলে চলে না।
পুঁজিবাদের করাল গ্রাসে এখন মানুষ বিনে পয়সায় হাসে না, কাঁদেও না। কিন্তু কওমি মাদরাসায় এখনো কোনো শিক্ষা-বিনিময় নেওয়া হয় না। তাই একান্ত গরিব মানুষজন সহজেই এর দ্বারস্থ হতে পারে। এর শিক্ষা-উপকরণ বিনা মূল্যে বা সুলভ মূল্যে প্রদান করা হয় বিধায় বিত্তহীন বা স্বল্পবিত্তের লোকজনও এতে স্বস্তি পান। অবশ্য ইদানিং কোনো কোনো ছাত্রের নিকট থেকে, পিতার উপার্জন অনুসারে, সুনির্দিষ্ট পরিমাণে ফি নেওয়া হয়। তা আবার প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত কম। যাই হোক, সন্তানকে ধার্মিক হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই, কারো কারো মতে, ন্যূনতম শিক্ষিত বানানোর উদ্দেশ্যে এখানে পাঠানো হয়।
কওমি মাদরাসার সিলেবাস একান্ত ধর্মনির্ভর বিষয়-আশয়। জগৎ-বিষয় সম্পর্কে যে-কোনো রকমের ধারনা ও শিক্ষা তাদেরকে প্রায়োগিক জীবন থেকেই অর্জন করতে হয়। এ জন্যই উচ্চাভিলষী কল্পনা তাদেরকে কখনো তাড়া করে না, গ্রাস করার তো প্রশ্নই আসে না। তারা যে কোনো জায়গায় যে কোনো অবস্থাতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। এ বিষয়ে তাদের ধৈর্য-ক্ষমতা ও উপযোগিতা অসাধারণ।
কওমি ব্যবস্থার পাঠ-পরিক্রমা যেহেতু একান্ত ধর্মসংশ্লিষ্ট, তাই ধর্মনির্দেশিত এবং সাক্ষাৎ উস্তাদের মুখ থেকে শোনা ও ব্যাখ্যাগত বিষয়ের প্রতি তাদের দারুণ আস্থা। এ আস্থা-সূত্রেই তাদের জীবন পরিচালিত হয়। উস্তাদের নিকট থেকে যে মূল্যবোধ ও শিক্ষা তারা অর্জন করেন, ধারন করেন, তা আমৃত্যু চর্চা করার চেষ্টা করেন। যদি কখনো বিচ্যুতি ঘটে এবং কেউ তা ধরিয়ে দিলে, অন্য ধারায় শিক্ষিত মানুষজনের মতো গোঁ ধরে বসে থাকেন না বা নিজের পক্ষে অপযুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন না। বরং বিনীতভাবে তা স্বীকার করেন এবং নিজেকে শুধরে নেন।
যেহেতু তাদের জীবন কষ্টে-সৃষ্টে অতিবাহিত হয়, তাই পরবর্তী জীবনকেও বিত্তহীনভাবে কাটিয়ে দেবার এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি থাকে। যদি বাংলাদেশের সকল ধরনের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পড়–য়াদের মন-মানসিকতাই তাদের মতো স্বল্পতুষ্ট হত, তাহলে দেশে অন্য রকম স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি হত। বটে, কওমি মাদরাসায়ও বৈষয়িক উন্নতির পক্ষে। কিন্তু বিলাসী ভোগের পক্ষে নয়, তারা বরং ত্যাগেরই পক্ষে।
সব চেয়ে বড় কথা হল সারা পৃথিবীতে এখন চলছে পুঁজিবাদের সংক্রমণ। সদর থেকে অন্দর- এ সংক্রমণ কোথায় নেই? কিন্তু এই দরিদ্র মানুষগুলো অভাব-অনটনের যন্ত্রণা সহ্য করেও ধর্মনির্দেশিত ‘জুহদ’ ও ‘তাকওয়া’ তথা খোদা-ভীতি ও আত্মত্যাগের পথই অনুসরণ করে চলেন। পুঁজি এখানে এখনো দাঁত-নখ বসাতে পারে নি। তবে এর প্রভাব নানাভাবে ঢুকার পথ খুঁজছে।
দেশের মফস্বল বা তৃণমূল পর্যায়ে মসজিদ মাদরাসায় কওমির ছেলেরাই ধর্মের সেবায় অধিক নিয়োজিত। সাধারণ জনতার ওপর তাদের ব্যাপক প্রভাব। তাদের পেশি শক্তি নেই বটে, কিন্তু আত্মার জোর অনেক। আর এ জন্যই সাধারণ জনতার কাছে তাদের আসন পাকাপোক্ত।
অন্যান্য ধারায় শিক্ষিত মানুষজনের অনুসারী সবাই শহুরে এবং সংখ্যায় কম। গ্রামে তাদের অনুসারী নেই বললেই চলে। অথচ কওমি মাদরাসায় শিক্ষিত লোকদের অনুসারী যেমন গ্রামে আছে, তেমনই শহরেও আছে। আর শত টানাপোড়েনেও ওরাই যেহেতু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে, নানা আনুষ্ঠানিকতায় নেতৃত্ব দেয়, তাই তাদের অনুসারী কমবে না।
এ সমস্ত কারণেই কওমি মাদরাসা-ব্যবস্থা অপার সম্ভাবনার আধার। এরা সংগঠিত হয়ে যে কোনো দিকে ঝুঁকে পড়লে, ধাবিত হলে টাল সামলানো কঠিন হবে। কিন্তু একান্ত ধর্মের বাইরে তারা মনোযোগ নিবদ্ধ করে না। কারণ, ধর্মের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে তাদের আগ্রহ নেই। সে শিক্ষাটাও তাদের দেওয়া হয় না। উপরন্তু জনতার অনুদান নির্ভর প্রতিষ্ঠানে জনতার বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি প্রবল। তাই এরা নির্জঞ্ঝাট জীবনযাপন করতে অধিক আগ্রহী।
সকল কওমি মাদরসা-ই আবাসিক। এর অধকাংশ শিক্ষকও আবাসিক। ছাত্রদের চব্বিশ ঘণ্টার একটা সুনির্ধারিত রুটিন থাকে, এই রুটিনমাফিক সবাইকে চলতে হয়। যদি এর শিক্ষকগণ এই চব্বিশ ঘণ্টার রুটিনকে জগতের চাহিদা ও ধর্মীয় নির্দেশনা অনুসারে আরো বিন্যস্ত ও বিস্তৃত করেন, ছাত্রদের দক্ষতা-যোগ্যতা যে কোনো চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ ধর্মের মূল শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জাগতিক চাহিদার বিষয়গুলো রপ্ত করার এখানে যে অবারিত সুযোগ রয়েছে, তা অন্য কোথাও নেই। কিন্তু একে ব্যবহারের করার মানসিকতা তৈরি হলেই সুফল ফলবে।
আবার যেহেতু আবাসিক, তাই ছাত্রদেরকে অভিন্ন মানসিকতায় গড়ে তোলার ব্যাপারে সফল হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। কওমি মাদরাসার ছেলেদের ধর্মীয় দরদের ব্যাপারে কারোই কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হল, তাদের মানসিক চাহিদা পূরণের বা দাবি পূরণের যে উপায় বা প্রক্রিয়া, তা যুগসংশ্লিষ্ট নয়। তাই বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে যুগচাহিদার বিষয়েও সচেতন করতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
ইসলাম ধর্ম বা কওমি ঘরানার শ্রেষ্ঠত্ব কিন্তু মৌখিক উচ্চারণের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। কথা দিয়ে মানুষের বা কোনো সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় না, তা হয় প্রায়োগিক জীবনে আচরণের নিরিখে। নিজের মতামত ও ব্যাখ্যা অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার মাঝে শক্তির প্রকাশ ঘটতে পারে, শ্রেষ্ঠত্বের নয়। আবার ইসলাম ধর্ম কিন্তু অপরাপর সকল ধর্মের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না। বরং সবগুলোর অস্তিত্ব ও অধিকারকে স্বীকার করে। সুতরাং গোলকায়িত বিশ্বে শুধু নিজের স্পর্ধাধর্মী উপস্থিতিই শেষ কথা নয়, পরমত ও পরধর্ম-সহিষ্ণুতাও একটি বড় শর্ত। এ সব বিষয়-আশয় নিয়ে কওমি মাদরাসা যদি সামনে এগিয়ে যায়, তার সামনে কোনো বাধা তৈরি হওয়ার কথা নয়।