বুধবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ৬:২৭
Home / কওমি অঙ্গন / কওমি মাদরাসা : যে কথা যায় না বলা

কওমি মাদরাসা : যে কথা যায় না বলা

1527মনযূরুল হক : আমরা কওমি মাদরাসার সন্তান। জাতির অবহেলিত অহংকার। দুনিয়ার সকল চাওয়া পাওয়া জলাঞ্জলী দিয়ে দীন ইসলাম বাঁচাতে আখরাতের মহড়ায় রাতদিন গুজরান করি আমরা। তাই পত্র-পত্রিকার নিত্য নতুন চমক কিংবা সামাজিক নানা আয়োজন থেকে সদা সর্বদা নিজেদের রাখি সতর্ক হুঁশিয়ার। দূরে থাকি শয়তানি প্রবঞ্চনার গা-ছোঁয়া থেকে একদম একশ’ হাত। অপরূপ পৃথিবীর লোভনীয় রূপরস এবং পার্থিব জাঁকজমকের তুমুল সম্মোহন কভু, কখনো, কোনোকালেও আমাদের হাতছানি দিয়ে কাছে টানতে পারে না, পাশে ডেকে মায়ায় জড়িয়ে বেঁধে রাখতে পারে না কিছুতেই। সুতরাং এই মায়াবী পৃথিবীতে শূন্যতা ছাড়া আর কিচ্ছুটি যদি আমাদের না-ও থাকে, কোনো শুভসন্ধায় শুকতরার ঝলমলানি যদি আমরা না-ও পাই, তবুও কি আক্ষেপের কিছু আছে আমাদের ? থাকতে পারে ? পারে না। পারে না বলেই না-পাওয়ার বেদনা মুখে বুকে সয়ে আখেরাতে এর উত্তম প্রতিদান পাবার আশায় কখনো কলম তুলি না আমরা। ভয় পাই, পাছে কাঙ্ক্ষিত ফসলে ছাই পড়ে যায়।
তাই কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে পারি নি— আমাদের মাদরাসায় এমন একটা ক্যাম্পাস নাই, যে ক্যাম্পাসে অ্যাপ্রন ঝুলিয়ে হাঁটবে আগামি দিনের বর্ণিল স্বপ্নচারী কওমি সন্তানরা। তাতে আফসোসেরও কিছু নেই। কারণ ওসব অ্যাপ্রন বা ইউনিফর্ম মার্কা চাকচিক্য মানায় না মাদরাসায়। তাছাড়া খোলামেলা ক্যাম্পাস থাকলে সেখানে গোলাগুলি মারামারি হবে, প্রতিদিন যাবে খুনের মিছিল; অবশ্য সেখানে আনন্দ র‌্যালি কিংবা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাও কদাচিৎ হয় বটে । তাই একটা অপরাজেয় বাংলা কিংবা টিএসসি চত্বর অথবা উদীচি-রমনা বটমূলের মতো আড্ডা দেওয়ার জায়গাও আমাদের নেই। কী করে থাকবে ? অশ্লীল ঢলাঢলি আর বেপরোয়া নোংরামিতে হরদম মাতাল-উন্মাতাল থাকে বলে ওইসব পল্লী-পাড়ায় বোমাবাজির ফতোয়া দেই নাকি আমরাই ! অবশ্য আমাদের অমন কটা চত্বর থাকলে সেখানটা আরবি নাহু-সরফের সীগা-গর্দান টানাটানি, উসূলে ফিকহের তাকরার অথবা হাদিস-কোরআনের মোযাকারায় গুঞ্জরিত হতে পারতো । যদি আমরা চাইতাম। ঠিক এমনি করে স্মৃতিসৌধ ও শহিদ মিনারের মতো জাতীয় স্থাপনাগুলো আর সবার জন্য উন্মুক্ত হলেও এই আমাদের জন্য থাকে অঘোষিত ‘প্রবশে নিষেধ’। আর চিড়িয়াখানা, জাদুঘর কিংবা জাতীয় উদ্যান বোটানিক্যাল গার্ডেনের কর্তৃপক্ষরাও আমাদের ওপর মহাবিরক্ত। কোনোমতেই তারা মেনে নিতে পারেন না এই টুপি-দাড়িওয়ালা আদম সন্তানগুলোকে।
একুশে বইমেলার মতো কোনো আর্ন্তজাতিক গ্রন্থমেলা, বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় নবীন-প্রবীণ শত সহস্র লেখক-পাঠকের পদচারণায় মুখরিত জ্ঞানভূমি, কখনো কি আমাদের ছিলো ? নাকি হবে কোনদিন ? হবে না। কারণ মেলা-টেলা ইসলামসদ্ধি নয়। অতএব বেশি থেকে বেশি দু’একটা মাকতাব স্টলের অনুপ্রবেশ সেখানে ঘটানো যেতে পারে, ব্যস। যেন অতি বইপ্রেমি হুজুর ছাত্ররা র্বণ লুকিয়ে আড়ং- এর পাঞ্জাবি গায়ে ঝুলিয়ে সবার অলক্ষ্যে ঢুকে তৃষ্ণা মেটাতে পারে।
ইসলামসদ্ধি নয়, তাই কোনো বিজ্ঞান উৎসব অথবা কোনো কম্পিউটার মেলায় অংশগ্রহণের সাহস তো ভালো, প্রয়োজনটুকুও অনুভব করি না আমরা। সোজা হিসাব, এসব আমাদের নয়, আমাদের জন্যও নয়। এইগুলি সব দুনিয়া দুনিয়া, মিথ্যা মায়া-ছায়া। দুনিয়ার মায়ায় জড়াতে নেই, ছায়াও মাড়াতে নেই। দুনিয়াদারদের কারবারে মাথা ঘামালে ইবাদাতে মনোযোগ নষ্ট হবে, খোদার নিবিড় সান্নিধ্য অর্জনে বিঘ্ন ঘটবে। মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন (!) একজন উস্তাদ বড় আফসোস করে একবার বলেছিলেন— হায়, র্দীঘ দশ বারটি বছর ধরে যেই দাড়ি-টুপি-জুব্বাবিহীন মানুষের দান খয়রাত খেয়ে খেয়ে ইলম শিখি, আলেম হই, পাস-ফারেগের পর তাদেরকেই ‘দুনিয়াদার’ বলে ভ্রুকুটি করি, আর আমরা সাজি পাক্কা দীনদার-সমঝদার।
তাই সন্দেহ জাগে, কোনো ‘ক্লোজআপ ওয়ান’ অথবা ‘গণিত শেখো’ টাইপের প্রতিযোগিতা-অনুষ্ঠান কোনোদিনও কি গড়তে পারবো আমরা? কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে কি আমাদের ঘরানার হুজুররা ধরা দিবেন একটা গতিশীল ‘পাঠচক্রে’ অথবা একটা সৃজনশীল গল্পের আসরে ? এখনও কবিতা, হ্যাঁ, শুধুই বাংলা কবিতা এই কওমি সমাজে অনাহুত, ঘরছাড়া, নীড়হারা বেগানা পাখির মতন। কোনো নৈশকালীন কবিতা উৎসবের নান্দনিকতায় বিমুগ্ধ হবো না আমরা কোনোদিন। কারণ— ‘আশশুয়ারাউ য়াত্তাবিউহুমুল গঊন’।
মিডিয়ার একটা খোলা আকাশ, যে আকাশের সবটুকু নীলিমা হবে আমাদের, রাতের সবক’টা তারা, গোঁধুলির লাল লাল আবির, এমনকি বাদলদিনের ভাঙাচোরা মেঘ— সব, একদম সবটুকু হবে আমাদের; এমনটা কখনোই কি হতে পারে না ? একেবারেই কি হওয়া যায় না ? ইলমের পরশ আর নববী রোশনি মেখে যে আকাশকে আপন হাতে আমরা সাজাবো, রাঙাবো ! কোনোদিনও কি হবে না ?
আমরা জানি, আমাদের মাদরাসা, এটা কোনো সাধারণ বিদ্যালয় নয়। এখানে বিশ্বস্রষ্টা কর্তৃক অবতীর্ণ জ্ঞানের চর্চা হয়। তাই অন্যসব বিদ্যালয়ের মতো একটা বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠান কল্পনাই করা যায় না এখানে। কোনো দৌড়-সাঁতারের অবকাশ নেই এই ইলমের দরবারে। কোনো স্বাধীনতা দিবস অথবা কোন বিজয় দিবসে দেশপ্রেমের পতাকা ওড়ে না এই স্বীকৃতিহীন পরাধীন অঞ্চলে। রপ্ত করা হয় না মার্চপাস্ট অথবা কুচকাওয়াজ ঢংয়ের কোনো সৈনিকি কৌশল।
আমাদের সর্তীথ-সহপাঠীরা রাজপথে ব্যানার টাঙানো শিক্ষাসফরের গাড়িঘোড়া দেখেই শুধু পরান জুড়ায়। সুর্দীঘ একযুগের ইলমি সফরে মাদরাসা আমাদেরকে কোনো সুদূর জঙ্গলে বনভোজনে পাঠিয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিতে চায় না কোনোভাবেই। কারণ ‘আদ্দুনয়া সিজনুল মু’মিনি…’।
তবে ইসলাম যেহেতু বিনোদনকে কুল্লে হারাম বলে নি, তাই হয়তোবা কোথাও কোথাও সপ্তাহ বা মাস শেষে গুটানো হয় ক্লাসের তেপায়া-টেবিল। দুলে ওঠে বিরস ম্লান জলসার পর্দা। ঘণ্টা দুয়েক অবোধ চাতকের ন্যায় মুখ গুঁজে বসে থাকতে হয় আমাদের কিছু লৌকিক হামদ-না’ত অথবা চিরায়ত ওয়াজ-বয়ানের নরম পালকে।
কথা আরও আছে।— ভারতর্বষের স্বাধীনতা আন্দোলনে ওলামায়ে কেরামের বীরত্বর্পূণ ইতিহাস আমরা জানি বেশ ভালো করেই। আমাদেরকে সেটা জানতে হয়, জানানো হয়, শোনানো হয়, পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়। কিন্তু এই বাংলাদেশের ইতিহাস, আমাদের জন্মভূমির জন্মকথা— শেরে বাংলার লাহোর প্রস্তাব থেকে শুরু করে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, ছয়দফা দাবি, বঙ্গভঙ্গের গণ্ডগোল, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনী প্রহসন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরর্বতী বংলাদেশ গড়ার দেদীপ্য কাহিনী কতটুকু আমরা জানি এবং কতটুকুই বা আমাদের জানানো হয়। আমাদের পাঠ্য তালিকায় একটা বই অথবা ন্যুনতম একটা প্রবন্ধ কি থাকা উচিৎ ছিলো না এই ইতিহাসের আশ্রয় নিয়ে ? জানি না।
এই যে এত নেই নেই, এরপরেও সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে কোনো আবেদন-আবদারও কিন্তু আমাদের নেই। কারণ, এই সমাজ ও রাষ্ট্রটাকে কোনোদিন আমরা বুঝি আপন ভাবতে পারি নি। তাছাড়া যার তার কাছে যত্রতত্র আবেদন করার অভ্যাস নেই মোটেও আমাদের। আমাদের সব আবদার-আবেদন কেবল রমজানের জাকাত-ফেতরা আর কোরবানির গরুর চামড়াকে ঘিরে। তাই বুঝি আমাদের ছাত্ররাও ‘বোর্ডিং-এ ফ্রিখানা জারি’ আর রোগ-বিমারে ‘ছুটি মঞ্জুরের আবেদন’ ছাড়া আর কোনো আবেদনপত্র লিখতে জানে না। জানানো হয়ও না ।
নিরুপম ঋতু বৈচিত্রের দেশে বড়ো হয়ে উঠি বটে আমরা, কিন্তু গ্রীষ্মের আমপাকা দুপুর, ভাদ্রের বিলভরা শাপলা সোহাগ, শরতের কেশর দোলানো কাশফুল, শীতের খেজুর রসে ভেজানো পিঠাপুলি আর বসন্তের চৈতালি হাওয়া অথবা মুকুল ছড়ানো আম্র-শাখের ছায়ায় প্রাণ জুড়ানোর আনন্দ অনাদরেই চলে যায় গোমড়া মুখে আমাদের পাশ কাটিয়ে। হোস্টলে জীবনের র্দীঘসূত্রতা পেরিয়ে মায়ের স্নেহ-মমতায় জড়ানোর সময় হয় না এতটুকু। সমাজের তৃতীয়শ্রেণী কিংবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে হোক অথবা সুদ-ঘুষের অর্থনীতিকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে হোক হেলায় হেলায় টুকটাক ব্যবসা, ছোটখাটো ইসলামি এনজিও, না হলে আবারও চলে যাই মসজিদ-মাদরাসার অবারিত চার দেয়ালে। এরপর না পাওয়ার বেদনা ঘোচাতে কখনো যদি সত্যিই এই জগতকে কিছু দিতে ভেতরে একটা জাগ্রত মানুষ অথবা কোনো ঘোরভাঙা প্রেরণা জেগে ওঠে, তাহলে ছুটে যাই ইসলামি রাজনীতির শতধাচ্ছিন্ন নাতিশীতোষ্ণ ময়দানে। আর তা-ও না হলে হয়তো দু’চার লাইন লিখি এবং অবশেষে দু’একটা বই পুস্তক সাজিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
এইতো আছে আমাদের। এভাবেই পুণ্যের বিরাট জ্বালা নিয়ে কদম কদম আখেরাতের পানে ধেয়ে চলছি আমরা, আমাদের কওমি সন্তানরা। কোনোদিন কাগজ কলমে হিসাব কষা হয় নি— এই করে করে আসলে কী পেলাম আমরা, আর কীইবা পেলো এই অভাগা জাতিটা। দিনদিন কাঁঠালের কোষের মতো যেভাবে সমাজ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছি আমরা, তাতে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদেরকে উপজাতীয় আদিবাসী কিংবা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মতো বিশ্বের সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে— এমন আশঙ্কা কিন্তু একেবারেই অমূলক নয়।
মার্চ ২০০৪ । প্রায় একযুগ আগের এই লেখাটা পড়লেই বোঝা যায়, অবস্থা কতটুকু বদলেছে..
22-08-2016 তারিখে প্রদত্ত লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে ।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে জরুরী কিছু কথা!

কমাশিসা ডেস্ক: শুক্রবার ২৫সেপ্টেম্বার ২০২০. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনি যখন কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির ...