সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ:
শুধু স্বীকৃতি নয়, বেঁচে থাকার জন্য সত্যিকারের স্বকীয়তাই চাই…
এক.
কওমী মাদরাসা শিক্ষা স্বীকৃতির পাশাপাশি স্বকীয়তার খুব আওয়াজ উঠেছে।
স্বকীয়তাটা আসলে কি? এটা আগে বুঝতে হবে। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, তায়াল্লুকমায়াল্লা, (আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি) সুন্নতের এহতেমাম, এলমি এস্তে’দাদ (যোগ্যতা), ঈমানের গভীরতা, একীনের মজবুতি, আখলাকের বুলন্দি, মোয়ামালাতে পাকিজেগি (পবিতত্রা), মোয়াশারাতে উন্নতি।
স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, সাহাবাদের মতো এয়াকীন, আকাবিরদের মতো তাকওয়া, নবীদের মতো উম্মাহর দরদ, স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় পুর্বসূরী আসলাফদের মতো আপোসহীনতা, সততা, ন্যায়, নীতি, আমানত, পদের নির্মোহতা, ক্ষমতার প্রতি অনীহা, চেয়ারের লোভহীনতা, মখলুকের একীন থেকে বেপরোয়া। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়,
“তোরা চাসনি কিছু পরের কাছে খোদার মদদ ছাড়া/পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।
স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, কওমী মাদরাসার একেকজন ছাত্র শায়খুল হিন্দের মতো বিপ্লবী হওয়া, কাসেম নানুতবীর মতো তাকওয়া ওয়ালা হওয়া, রশিদ আহমদ গাঙ্গোহীর মতো মুখলেস হওয়া, হুসাইন আহমদ মদনীর মতো আল্লাহ ওয়ালা রাজনৈতিক হওয়া, আবুল কালাম আযাদের মতো যুগ সচেতন হওয়া, হাকীমুল উম্মত থানভীর মতো বিদগ্ধ লেখক ও বুর্যুর্গ হওয়া, হযরতজী ইলিয়াস এর মতো দরদী দা’য়ী হওয়া, শায়খুল হাদীস জাকারিয়ার মতো গভীর এলেমের অধিকারী হওয়া। আলী মিয়া নদভীর মতো আরবী পন্ডিত ও জ্ঞান তাপস হওয়া। মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফের মতো মেজাজে সাহাওয়ালী আলেম হওয়া। জিয়াউল হক ফারুকীর মতো মুজাহিদ হওয়া।শাহ আতাউল্লাহ বোখারির মতো জিন্দাদিল মর্দে মুমিন হওয়া। তাহলে আমি এই চেতনার সাথে সম্পূর্ণ একমত।
স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, শেষ রাতের রোনাজারী, কান্নাকাটি, কিয়ামুল লাইলের পাবন্দি, তাহাজ্জুদের এহতেমাম, আল্লাহর কাছ থেকে চোখের পানি ফেলে সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা তৈরি করা। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় এশরাকের নামাজ পড়ে সারা দিনের রিজিকের ফায়সালা করানো। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় সালাতুত চাশত পড়ে নিজের জরুরত আল্লাহর অসীম খাজানা থেকে পুরা করে নেয়ার যোগ্যতা সৃষ্টি করা। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় সেই হাদীসের উপর এয়াকীনের সাথে উস্তাদ ও ত্বালাবাদের এয়াকীন ও আমলের মশক, যে সুরায়ে ওয়াকেয়া পড়ে নিজের অভাবকে দূর করা, সুরায়ে ইয়াসিন পরে দরিদ্রতাকে জয় করা।
আমরা যদি আমাদের এলেমের গভীরতা, ঈমানী মেহনত, আমলের পাবন্দি, তাকওয়ার প্রজ্জলতা, সুন্নতের পুর্ণাঙ্গ অনুসরণ আর তায়াল্লুক মায়াল্লার স্বকীয়তাকে ধরে রাখতে পারতাম তাহলে অন্তত দুনিয়ার কোন শক্তির কাছে মাথা নত করতে হতো না। কারো কাছে হাত পাততে হতো না। কোন জালেমের ভয়ে তটস্থ থাকতে হতো না। বড় বড় খুনী, সুদখোর আর গনতন্ত্রের টাকার কুমির পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মাদরাসার সভাপতি, সেক্রেটারী বানাতে হত না। তাদের জ্বি জ্বি করে চলতে হতো না। সাত পাঁচ মিলিয়ে চলতে হতো না। হায় আমাদের না আছে স্বকীয়তা, না আছে স্বীকৃতি।
আমরা সেই স্বকীয়তাই চাই। আমাদের পূর্বের সেই সোনালী দিনে ফিরে যেতে চাই। যে স্বপ্ন ছিল আমাদের আকাবিরদের চোখের তারায়।
দুই.
আজ তাকওয়াহীন, এলেমহীন, সুন্নত, শরীয়ত আর পর্দার মতো মৌলিক শরীয়া নির্দেশ থেকে অধিকাংশ আলেমের নগ্ন বিমূখতা। কওমী মাদরাসার ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার স্বকীয়তার দাবী উঠুক। এসব ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে কওমী আঙ্গিনাকে বাঁচানোর জন্য তাকওয়া হাসিলের আন্দোলন গড়ে তুলুন। স্বকীয়তা রক্ষার উপরোক্ত দাবীকে জোরালো করুন।
স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় মানুষের কাছে হাত না পাতা। ভিক্ষার ঝুলি আর চাঁদার রশিদ নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে না যাওয়া। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় ছোট্ট সোনামনিদের বডিং এর চালের মুট্টি তোলার জন্য বাড়ি বাড়ি বস্তা হাতে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য না পাঠানো। তাহলে সেই স্বকীয়তা ধরে রাখা সময়ের অপরিহার্য দাবী।
যে ছেলেটা বছরের পর বছর লিল্লাহ বডিং এ সদকা জাকাত ফিতরা আর গরীবের হক মেরে খাচ্ছে সেই ছেলেটার বাবা বছরের পর বছর অন্যকে জাকাত সদকা ফিতরা দিচ্ছে। অপর আরেকটি সন্তানকে লাখ টাকা খরছ করে কলেজ ভার্সিটিতে পড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা মাদরাসা পড়ুয়া ছেলেটিকে নষ্ট করে জাকাতখোর আর ভিক্ষুকে পররিণত করছি স্বকীয়তার মুলা ঝুলিয়ে, কওমী আর আকাবিরদের দোহাই দিয়ে।
স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, সভার নামে, ওয়াজ মাহফিলের নাম করে উম্মাহর হেদায়তের ফিকিরের বদলে কেবল চাঁদা কালেকশন আর চুক্তিভিত্তিক দৈনিক লক্ষ টাকা আয়ের ব্যবস্থা (যা দেশের রাষ্টপতি আর প্রধানমন্ত্রীর বেতন থেকে বহুগুন বেশি) । স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, মাদরাসা আর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে একটি বোর্ডের নামে বাণিজ্যকরণ আর পরিবার তন্ত্র প্রতিষ্ঠা।। তিন চারটি মাদরাসার একসাথে মুহতামিমের পদ আগলে রাখা। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় বড় বড় বিল্ডিং প্রজেক্ট বাস্তবায়নে ঘনঘন বিদেশ সফর। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় নিজের ছেলে সন্তান, মেয়ের জামাই, ভাই ভাতিজার কর্ম সংস্থান। অযোগ্যদের আস্তানা আত্বীয়দের লম্বা বেতন ভাতার আয়োজন। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় আজীবন পদ পদবী আঁকড়ে থাকা। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় অল্প টাকা বেতনে অনভিজ্ঞ উস্তাদ নিয়োগ। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, হাজারো ছাত্রদের এলেম আমলের বিপর্যয় তৈরি করা। শতকরা দশজন ছাত্র আরবী এবারত পড়তে না পারা। কোরআনের তরজমা বুঝতে না পারা। আরবী উর্দুতে কথোকপন করতে না পারা। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় হাদীস বুঝার যোগ্যতা তৈরি না হওয়া। ভাল করে বাংলা পড়তে লিখতে না পারা। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় সীরাত চর্চার প্রতি অনাগ্রহ। স্বকীয়তার অর্থ যদি ফেকাহের উপর অধিকংশ ছাত্রকে অযোগ্য করে গড়ে তুলা।
স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, মাদরাসার চার দেয়ালের ভেতর ছাত্র শিক্ষকদের বোবা কান্না আর দীর্ঘশ্বাসকে আরো প্রলম্বিত করা। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় মতের উল্টো হলে বহিষ্কারের হুলিখেলা। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় একদিনের নোটিশে বছরের মধ্যখানে শিক্ষক বদলের নষ্টামি। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, প্রতি বছর ছাত্রদের মাদরাসা বদলের পরিবেশ তৈরি করা। নিজেদের আখের ঘোচানো। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয় স্বামী স্ত্রী মিলে চার রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে মহীলা মাদরাসা খোলার প্রক্রিয়াকে আরো তরান্বিত করা। চার পাঁচটি রুম নিয়ে একেকটি জামেয়া খুলে বসা। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, ব্যাংকে কোটি টাকা জমা রেখে আবার কমিশনে চাঁদা কালেকশনের দালাল নিয়োগ করা। স্বকীয়তার অর্থ যদি হয়, কোরবানীর চামড়া টানাটানি নিয়ে মাদরাসা মাদরাসায় যুদ্ধে অবর্তির্ণ হওয়া। গরীব প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন খোঁজ না নেয়া। বড় বড় মাদরাসাগুলোর বিল্ডিং আর জৌলুসের প্রতিযোগিতা। ছাত্রদের জীবনের মূল্য না দিয়ে, একাডেমিক উন্নতির বদলে মোহতামিমের কোটিপতি হওয়ার প্রতিযোগিতা। দেওবন্দিয়তের চেতনার দোহাই দিয়ে নিজের চেতনা প্রতিষ্ঠার বাণিজ্যের স্বকীয়তা আর কতদিন?
আমি এই স্বকীয়তা নামক ভন্ডামির পক্ষে নই।
আমরা নকশে সাহাবা আর আকাবিরদের স্বকীয়তাতেও নেই আবার আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসার স্বীকৃতিতেও নেই। অযোগ্য আমলহীন একদল আলেম তৈরির ঠিকাদারী নিয়ে নিজ দেশে পরবাসি হয়ে বসে আছি।
সত্যিকারের স্বকীয়তাও চাই না আবার স্বীকৃতিও চাই না। কেন? কাদের স্বার্থে আমরা হাজারো সন্তানের দুনিয়া ও আখেরাতকে বরবাদ করছি? সেই হিসাব অবশ্যই একদিন পাই পাই করে দিতে হবে মহান আল্লাহ তায়ালার আদালতের এজলাসে একদিন।