আলম ফজলুর রহমান : এই এপিসোড লেখার আগে একটা কৈফিয়ৎ দিতে চাই। আমি যা লিখছি যা আমি নিজে স্বচক্ষে দেখেছি , জেনেছি এবং উপলব্ধি করেছি। স্বিকার করি আমার জানায় ভুল থাকা অসম্ভব নয় । এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ইন্টারনেটে কিংবা উইকিপিডিয়াতে গিয়ে যা জানা যাবে তার নিরানব্বই ভাগ পাহাড়ী শিক্ষিতদের দ্বারা ভেজাল মিশ্রিত লেখা। অন্য বাঙালী যারা যা লিখেছেন পড়ে মনে হয়েছে তাঁরা রাঙামাটি, খাগড়ছড়ি কিংবা বান্দরবানে গিয়ে হোটেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত আরামদায়ক স্যুটে বসে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের জীবন, জীবিকা , সংষ্কৃতি এবং জীবন যুদ্ধ নিয়ে লিখছেন। এক/ দুই জনকে পয়েছি যাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে জেনে লিখবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাও আপ টু দি মার্ক নয়। অতএব এখনকার প্রজন্ম ইন্টারনেটে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসকে জানার চেষ্টা করলে ভূল ইতিহাস জানবেন বলে আমি দৃঢ় ভাবে মনেকরি। কিন্তু আমি ব্যাথিত হয়েছি এটা জেনে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী আমাদের ভাই ও বোনেরা তাদের নিজেদের সত্যি ইতিহাসকে বিকৃত করে নিজেরাই পথহারা হয়েছেন।
একটি জনগোষ্ঠীর ভালো মন্দ মিলিয়ে ইতিহাসের পরম্পরা তৈরী হয়। ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে নিজের ইতিহাস নিজে বিকৃত করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে যাওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যেমন একটা উদাহরণ দেই। সতেরশত তিহাওর খৃষ্টাব্দের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ হয় ঐসময় মোগল সুবেদারের সাথে মুসলমান নামধারী চাকমা চীফের চুক্তি হয়। এই চুক্তির সূত্র ধরে অনেক সম্মানী চাকমা লেখক বলেছেন ঐসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন ছিলো কারণ চাকমা চীফ স্বাধীন নাহলে মোগল সুবেদারের সাথে কিভাবে চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন? চুক্তিতো দুই স্বাধীন দেশের মধ্যে হয়। একটু গভীর ভাবে লক্ষ করলে প্রতিভাত হবে যে চাকমা চীফ মুসলমান নামধারী হয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করছেন। তার মানে ইতিমধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম মোগল শাসনে এসেছে এবং চাকমা চিফরা মুসলমান নাম ধারন করে মোগল সুবেদারের সাথে চুক্তি করেছেন। এইযে উনিশ শত সাতানব্বই সালে পাহাড়ী জনগনের পক্ষে সন্তু লারমা যে চুক্তি করলেন বাংলাদেশের সরকারের সাথে সেই চুক্তি কি সন্তু লারমা স্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে করেছেন ? নাকি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের মধ্যে থেকে করেছেন? অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের আওতায় থেকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগনের সাথে বাংলাদেশের এই চুক্তি হয়েছে যাতে পাহাড়ী জনগনের পক্ষে সন্তু লারমা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। এমনিই অনেক চুক্তি চাকমা চীফরা মোগল সুবেদারদের এবং ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে করেছেন মোগল এবং ইংরেজ সরকারের সার্বভৌমত্বের অধিনে থেকে। সুলতানী আমল, মোগল আমল, ভারতীয় ব্রিটিশ সরকারের আমল এবং বাংলাদেশে সরকারের আমল সব আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ ছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম কোনোদিনও স্বাধীন ছিলো না। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপরে অনেকেই লেখাপড়া করেছেন।
আমি নিজেও বিভিন্ন লেখকের বই থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জানবার চেষ্টা করেছি। এইসব লেখকের বই এর মধ্যে Eastern Bengal Assam District Gazetteers, Chittagong HillTracts R. H Sneyd Hutchinson এর লেখা বইটি সব চেয়ে অথেন্টিক এবং ঐতিহাসিক ভাবে বস্তুনিষ্ঠ মনে হয়েছে। এই গ্যাজেটিয়ার তিনি রচনা করেন উনিশ শত নয় সালে। এই বই এ দেখা যায় চাকমারা ইতিমধ্যেই বিরাশি বার বিদ্রোহ করেছে মোগল এবং ব্রিটিশ সরকারের আমলে । বাংলাদেশে চাকমাদের এটা তিরাশিতম বিদ্রোহ। এই R.H Sneyd Hutchinson ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের অফিসার ছিলেন। তিনি উনিশ শত নয় সালে যখন Eastern Bengal and Assam District Gazetteers লিখেন তখন তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সব স্হান এবং স্হাপনা পায়ে হেটে সফর করেছিলেন। আমি দীঘিনালাতে ব্যাটালিয়ান কমান্ডার থাকার সময় দীঘিনালায় হাচিনছন ব্রিজ খ্যাত একটি কালভার্ট দেখেছি যা আজো হাচিনছন ব্রিজ নামে সবাই জানে। হাচিনছনের বর্ণনা মতে চাকমারা ছিলো হেড হান্টিং ট্রাইব। কোনো চাকমা যুবক তাঁর প্রেয়সীকে তার বীরত্ব প্রদর্শন করতে নরমূন্ড উপহার দিতো। সম্ভবত: আঠারো শত ষাট সালের দিকে পনের / কুড়ি জনের পুরুষ ও মহিলার একটি ব্রিটিশ পর্যটক দল রাঙামাটি অঞ্চলে ভ্রমনের সময় একদল চাকমা যুবক তাদের বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য এই ব্রিটিশ পর্যটক দলের সবার মাথা কেটে তাদের প্রেয়সীদের উপহার দেয়ার। এটা জানতে পেরে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার গভর্নর জেনারেল চাকমাদের শাস্তি দেবার জন্য চট্রগ্রাম ও কাছাড় থেকে দুই ডিভিশন সৈন্য রাঙামাটি অভিমুকে প্রেরনের নির্দেশ দেন। চট্টগ্রাম ও আসামের কাছাড় থেকে দুই ডিভিশন সৈন্য রাঙ্গামাটিতে এসে দোষী চাকমা যুবকদের শুধু শাস্তিই প্রদান করেনি পাহাড়ে শান্তিশৃংখলা বজায় রাখতে এবং এই ধরনের লোমহর্ষক ঘটনার পুনরাবৃত্তী রোধ কল্পে দুই ব্যটালিয়ান গোর্খা সৈন্য রাঙ্গামাটিতে মোতায়েন করেছিলো। এই গোর্খা সৈনিকদের ঔরসজাত ব্যাক্তিরাই পার্বত্য চট্টগ্রামে গোর্খা উপজাতি নামে খ্যাত। চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটিতে এক ডিভিশন ব্রিটিশ সৈন্য যখন মার্চ করে তখন চট্টগ্রাম – রাঙামাটি রাস্তাটি তৈরী হয়। পথে যে ডাকবাংলো সেটাও তখনা তৈরী য়েছিলো। আজকে আমরা যে পাকা রাস্তা ধরে চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটি যাই এটাই সেই রাস্তা। আমি বরোবুনিয়াতে ব্যাটালিয়ান কমান্ডের দায়িত্বে থাকার সময় আসামের কাছাড় থেকে যেপথ ধরে ব্রিটিশ আর্মি ডিভিশন রাঙ্গামাটিতে এসেছিলো সেই পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম। এই পথের সম্ভাব্য দিকনির্দেশনা বের করতে সমর্থ হলেও এখন ঐ পথের কোনো চিহ্ন বিদ্যমান নাই। পহাড়ী মহিলারা যে কাপড় পরে এটাকে পিনন বলে। এক এক এক নৃ গোষ্ঠীর মহিলাদের পিননের রং আলাদা আলাদা। যেমন চাকমা মহিলারা যে পিনন পরেন তার সম্ভবত : পাড় কালো এবং জমিন লাল রঙের। ত্রিপুরা মহিলারা পরেন সম্ভবতঃ লাল পাড় এবং জমিন সবুজ রঙের। পিননের এই কাপড় উপজাতি মহিলারা নিজে ঘরে তৈরী করে যা ব্যানটেক্সটাইল নামে পরিচিত। মহিলাদের গয়নাও এক এক প্রকারের নৃ গোষ্ঠী ভেদে। পাহাড়ী পুরুষ ও মহিলা একপ্রকারের নিজস্ব তৈরী বাঁশের পাত্রে ধুমপান করে।এদের নিজেদের তৈরী বাদ্যবাদ্য যন্ত্রও আছে। পাহাড়ীরা আমোদপ্রিয় নৃ গোষ্ঠীর মানুষ। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে নানা প্রকারের অনুষ্ঠান পালন করে এবং দলবেঁধে নাচ গান করে। বৌদ্ধ পূর্ণিমায় সম্ভবত এরা বড় পার্বন করে। ফানুষ উড়িয়ে নাচে গানে এই অনুষ্ঠান পালন করে।
তেজেন্দ্রলাল তনচ্যঙ্গা পাড়ার একজন তনচ্যঙ্গাকে ভান্তে করার এক দীর্ঘ অনুষ্ঠানে কৌতুহল বশতঃ আমি উপস্থিত ছিলাম। এই ভান্তে মানে পাহাড়ীদের ক্যেয়াং ঘরে যিনি ঠাকুরের ভুমিকা পালন করেন। ভান্তেরা দিনে সম্ভবতঃ একবার খায় দুপর বেলায়। ভান্তের এই খাবার শ্রমনরা মানে শিশু ধর্ম শিক্ষার্থীরা বাড়ী বাড়ী গিয়ে সংগ্রহ করে । ভান্তে নিজে খাবার জোগাড় বা রান্না করেননা। পাহাড়ীরা যেযার মতো প্রয়োজনে ঘরে রান্না করে খায়। আমাদের মতো একসাথে বসে খাবার সিস্টেম নাই বলে জানি। মজার ব্যপার হলো দুরদুরান্তের পাহাড়ী গ্রামের মানুষ বিকেল চারটার দিকে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এখনকার অবস্থা জানিনা। ঘরে ফ্লোরে ঢালাও বিছানা করে একসাথে ঘুমায়। পাহাড়ীরা জ্যুমে টংঘর তৈরী করে ফসল বুনার পরে তিনমাসের মতো সময় পাহারা দেয় যাতে বৈন্যা বা বনশুকর জ্যুমের ফসল নষ্ট নাকরতে পারে। জ্যুমে ফসল পাহারা তিনমাস এবং ফসল কাটা তিনমাস সাকুল্যে ছয়মাস পাহাড়ীরা জ্যুমে থাকে বলে এদের শিশুদের জন্য আমি চেষ্টা করেও স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পারি নাই। জ্যুমে ফসল রোপনে পুর্বে পাহাড়ীরা পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সব পুড়ে সাফ করে তাতে গর্ত করে ঐগর্তে একসাথে নানা জাতের শব্জি এবং ধানের বীজ বপন করে যা স্টেগার্ড টাইমে হয়। জ্যুমের ফসল স্টেগার্ড টাইমে হয় বলে ফসল পাহারা এবং জ্যুমের ফসল ঘরে তুলতে প্রায় ছয় মাস সময় লেগে যায়। জ্যুমের টংঘর থেকে সম্ভবত : আমরা গোলঘর পাহাড় থেকে সমতলে আমদানী করেছি। পাহাড়ীরা সম্ভবত : তিনবার একই জ্যুমে ফসল রোপন করতে পারে। যখন জ্যুমে ফসল হয়না তখন সেই জ্যুমকে রাইন্যা বলে। পাহাড়ীরা সর্বভুক। এমন কিছু নাই পাহাড়ীরা খায়না। পাহাড়ীরা হাতির মাংস খায়। আমি ব্যোম হেডম্যান তিনবানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম হাতির কোন অংশ খোতে সুস্বাদু ? জবাবে বলেছিলো হাতির শূড় । আমি পাহাড়ীদের মধ্যে দুটো জিনিষ দেখি নাই :
এক। চোর ।
দুই। ফকির।