আমাদের আকাবির- ২৭
প্রথম বচন
সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর ইসলাম প্রচার শুরুর প্রায় ছয়শ বছর পর ৬১৫ হিজরীতে রাজশাহী তথা মহাকাল গড়ের মানুষ ইসলামের বাণী শোনার সৌভাগ্য অর্জন করে। আর এই মহান কর্ম সম্পাদন করেন দরবেশ ও কামিল পীর, আউলিয়াগণ। তাঁদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং প্রথম সূফী সাধক হচ্ছেন হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.।
এই মহান সাধকের নাম নিয়ে আজও যেন বিতর্কের অন্ত নেই। ড. এনামুল হক তার ‘সুফীইজম ইন বেঙ্গল’ গ্রন্থের ২৩১ পৃষ্ঠায় এ বিবৃতিটি উদ্বৃত করেছেন- ‘মাখদুম সাহেবের নাম ‘হযরত শাহ রূপোশ’। তার অন্য নাম কি ছিল তা আমি জানি না’। ‘বাংলাদেশে ইসলাম’ গ্রন্থের লেখক আবদুল মান্নান তালিব বলেছেন, ‘অবশ্যি রূপোশও কোনো নাম বা নামের অংশ হতে পারে না। এটিও উপাধি বিশেষ। রূপোশ ফার্সি শব্দ, এর অর্থ হচ্ছে অবগুণ্ঠনাবৃত মুখ। কাজেই হযরত শাহ মাখদুম রূপোশের আসল নাম জানা অসম্ভব।’
‘আমাদের সূফিয়ায়ে কিরাম’ গ্রন্থে আলমগীর জলিল তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা অঞ্চলে যেসব পীর দরবেশ ও সূফী সাধক ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠাকল্পে নিজেদের উৎসর্গ করেন তাদের মধ্যে হযরত পীর শাহ মাখদুম জালালউদ্দীন রূপোশের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়।’ দেখা যাচ্ছে প্রাবন্ধিক এখানে তার নাম ‘হযরত পীর শাহ মাখদুম জালালউদ্দীন রূপোশ বলেছেন। অন্যত্র হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.-এর নাম ‘আবদুল কুদ্দুস জালালুদ্দীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
জন্ম ও আগমনকাল
হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.-এর জন্মসন এবং বাংলাদেশে তাঁর আগমনের সন নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে; এমনকি তাঁর জন্মস্থান নিয়েও মতভেদ দেখা যায়। যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ. ১৪৭৫ ঈসায়ীতে ইয়ামান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিশাপুর নামক স্থানে শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু গবেষকদের গবেষণা এবং ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ প্রমাণ করে যে, সূফী সম্রাট হযরত শাহ মাখদুম ৬১৫ হিজরীর ২রা রজব মোতাবেক ১২০৮ ঈসায়ীতে বাগদাদ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।
বংশ পরিচিতি
ইসলামের এক সংকটময় মুহূর্তে আল্লাহ পাকের করুণায় ন্যায় ও সত্যের প্রতীক পবিত্র ইসলামের পুনরোজ্জীবনকারী মহাপুরুষ হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.-এর জন্ম হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অলী, অলীকুল শিরোমনি হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ.-এর বংশে। যিনি মাতৃ-পিতৃ উভয় সূত্রেই ছিলেন জগদ্বিখ্যাত সাইয়িদ বংশের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। তাঁর পূণ্যবান পিতার বংশসূত্র উর্ধ্বতন পর্যায়ে আওলাদে রাসূল সা.-এর হযরত হাসান রা.-এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, অপরদিকে সতী সাধ্বী মাতার বংশক্রম উর্ধ্বতন পর্যায়ে মিলিত হয়েছে হযরত হুসাইন রা.-এর সঙ্গে। এজন্যই তিনি ‘আল হাসানী এবং আল হুসাইনী’ উভয়বিধ উপাধিতেও বিভূষিত। সুতরাং পিতা এবং মাতা উভয় সূত্রেই তিনি মহানবী মুহাম্মাদ সা.-এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বড়পীর হযরত আবদুল কাদির রহ.-এর ছিলেন হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.-এর দাদা। বড়পীর সাহেবের ২৭জন পুত্রের মধ্যে হযরত আযাল্লাহ শাহ ছিলেন একজন। হযরত আযাল্লাহ শাহের দ্বিতীয় পুত্রই হলেন হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ. ।
শৈশবকাল ও শিক্ষা
হযরত সাইয়িদ আবদুল কুদ্দুস শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.এর শৈশবকাল ও শিক্ষা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। দু-একটি গ্রন্থে যৎসামান্য ধারণা প্রদান করা হয়েছে মাত্র। হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.-এর জন্মগতভাবেই উচ্চবংশীয় এবং পীর আউলিয়ার সন্তান, তাঁর পিতা ছিলেন তৎকালের স্বনামধন্য দরবেশ আর তাঁর পিতামহ ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম দরবেশ, অলীকুল শিরোমণি হযরত সাইয়িদ মহিউদ্দীন আবদুল কাদির জিলানী রহ.এর। হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.-এর বড় ভাই হযরত সাইয়িদ আহমাদ তন্নুরী মীরান শাহ রহ.-ও একজন বিখ্যাত অলী ছিলেন।
তাঁর পিতার নাম ছিল সাইয়িদ আযাল্লাহ শাহ রহ.। হযরত আযাল্লাহ শাহ রহ.-এর তিনটি পুত্র সন্তান ছিল এবং সৌভাগ্যক্রমে তাঁদের তিনজনই ছিলেন বিখ্যাত অলী। বড় ছেলের নাম হযরত সাইয়িদ আহমাদ তন্নুরী ওরফে মীরান শাহ রহ.-এর। ছোট ছেলে হযরত সাইয়িদ মুনির আহমদ রহ. এবং মেজ ছেলে ছিলেন সর্বাধিক বিখ্যাত পীর হযরত সাইয়িদ আবদুল কুদ্দুস শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.।
হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ. হিজরীর ৬১৫ ২রা রজব মোতাবেক ১২০৮ ঈসায়ীতে বাগদাদ নগরীতে নিজ পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেন।
[এখানে সম্ভবত হিজরী সন এবং ঈসায়ী সনগণনার মধ্যে খানিকটা বিভ্রাটের সম্ভাবনা রয়ে গেছে। মুহাম্মাদ জোহুরুল ইসলাম রচিত ইসলামিক ফাউ-েশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ (রহ)-এর বিস্ময়কর জীবন ও কর্ম’ গ্রন্থে হিজরী ৬১৫ বনাম ঈসায়ী ১২০৮ যে সনগণনা উল্লেখ করা হয়েছে গ্রন্থের পরবর্তী সনগণনার ক্ষেত্রে দুই সনের মধ্যে সে গণনার ক্রমধারা পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন, গ্রন্থের ৮৩ নাম্বার পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে ‘… শাহ মাখদুম (রহঃ) কাঞ্চনপুরের সন্নিকটে শ্যামপুরে স্ব-স্ব খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন ৬৮৫ হিজরী/১২৮৭ খ্রীস্টাব্দে’। এখানে দেখা যাচ্ছে, হিজরী সন ’৮৫ এবং ঈসায়ী সন ’৮৭; দুই বছরের তারতম্য। কিন্তু জন্মসন লিখার সময় লিখা হয়েছে হিজরী সন ৬১৫ এবং ঈসায়ী সন ১২০৮; ৭ বছরের তারতম্য। উপরন্তু, হিজরী সনকে এখানে বেশি দেখানো হয়েছে ঈসায়ী সনের চেয়েÑ ১৫ বনাম ০৮। সম্ভবত তাঁর জন্মসন এবং জীবনী সংক্রান্ত উপাত্তগুলো তেমন নির্ভরযোগ্য ছিল না বিধায় এমন বিভ্রাটের জন্ম নিয়েছে। এই জীবনীর পরবর্তী অংশেও এমন সনবিভ্রাট পরিলক্ষিত হলে মনে করবেন এটি উৎসগ্রন্থ থেকেই চয়নকৃত, আমাদের বিভ্রাট নয়।-সম্পাদক]
তিনি শিশুকাল থেকেই উচ্চশিক্ষিত এবং বিখ্যাত সব অলী দরবেশের সাহচার্য পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন। তাঁর পিতা বিখ্যাত অলী সাইয়িদ আযাল্লাহ শাহ রহ. শিশু ছেলের চালচলন, আচার-আচরণ লক্ষ করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর এই ছেলে ভবিষ্যতে একজন জগদ্বিখ্যাত কামিল দরবেশ হবেন। তাই শৈশবেই তাঁর শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নবান হয়ে উঠেন এবং আপন তত্ত্বাবধানে রেখে জগদ্বিখ্যাত দরবেশ হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রতিষ্ঠিত বাগদাদ শরীফের ‘মাদরাসায়ে কাদেরিয়ায়’ পড়িয়ে দীন ইসলামের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলেন।
হযরত শাহ মাখদুম-এর রাজশাহী আগমনের কারণ
তিনি রামপুর বোয়ালিয়াতে হযরত তুরকান শাহ রহ.-এর নির্মম শাহাদাতের কথা শুনে প্রতিশোধ গ্রহণার্থে চারজন কামিল দরবেশ সঙ্গে নিয়ে কুমীরকে বাহন করে নদীপথে বোয়ালিয়া অভিমুখে যাত্রা করেন। অন্যান্য বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত শাহ মাখদুম রহ-এর পূর্বেই হযরত তুরকান শাহ রহ.-এর নামক এক দরবেশ কতিপয় শাগরিদসহ ইসলাম প্রচার করতে এসে রাজশাহী (রামপুর বা মহাকালগড়) অধিপতি অংশুদেব চান্দভন্ডী বর্মভোজ ও অংশুদেব খের্জুর চান্দ নামক দুই রাজভ্রাতার হাতে নির্যাতিত ও নিহত হন। এই দুর্ঘটনা ঘটে আনুমানিক ৬৭৭/১২৭৯ সালে। কেননা এই ঘটনার দশ বছর পর বাগদাদ শরীফ হতে হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.-এর বড় পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ-এর রূহানী নির্দেশে এই হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশে বাংলায় আগমন করেন ৬৮৭ হিজরী মোতাবেক ১২৮৯ ঈসায়ীর দিকে। প্রথম কিছুদিন নোয়াখালী জেলার শামপুর দায়রায় অবস্থানের পর শাহ মাখদুম চারজন দরবেশসহ মাখদুম নগরে এসে স্থায়ী আবাস নির্মাণ করেন।
কোনো কোনো বর্ণনামতে, হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি নোয়াখালী জেলার শামপুর মোকাম থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দিয়ে বাঘা নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে পদ্মা নদীর নিকটস্থ যে কেল্লা স্থাপন করেছিলেন সেটিই মাখদুম নগর নামে খ্যাত। এই মাখদুম নগরে অবস্থান করার ফলে বহু ধর্মহীন মানুষ ধীরে ধীরে সত্য ধর্ম ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে নিজেদের ধন্য করেন। এ সকল নব মুসলিম এবং পীর দরবেশদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইসলামের বাণী দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই মাখদুম নগরে হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ. আস্তানা প্রতিষ্ঠা করেন ৬৮৭ হিজরী বা ১২৮৯ ঈসায়ী সালে।
কথিত আছে, বাঘার নিকটে তিনি একটি ছোট্ট কেল্লা নির্মাণ করে সেখানে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে মুজাহিদ তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পরে এখান থেকেই মাওলা ফকীর বাহিনী নিয়ে রামপুর মহাকালগড় আক্রমণ ও দখল করেন হিজরী ৭২৬ মোতাবেক ১৩২৬ ঈসায়ী সালে। এই বিজয়ের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ নির্মিত একটি বিজয় তোরণের ধ্বংসাবশেষ এখনও মাখদুম নগরে পদ্মা নদীর তীরে বিদ্যমান। কিংবদন্তি মতে, শাহ মাখদুম হঠাৎ এই বিজয় অভিযান প্রেরণ করেন নি। এর জন্য তাকে বহু বছর যাবত প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছিল।
রামপুর রাজ্যের মহাকাল মন্দিরে নরবলি সহযোগে মহাকাল দেবের পূজা হত এবং বছরের এক নির্দিষ্ট দিনে এই বলিদান কার্যকর করা হত। রাজার নির্দেশে প্রতিবছর কোনো না কোনো প্রজার এক যুবক পুত্রকে বলি দেওয়ার প্রচলন ছিল। পিতা রাজি না হলেও জোরপূর্বক এই বলিদান কার্যকর করা হত। মাখদুম নগর থেকে সূফী সাধকগণের মহাকালগড়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারার্থে যাতায়াত এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণে নানাভাবে উদ্বুদ্ধকরণের ফলে বহু অমুসলিম ইসলাম ধর্মের মহান আদর্শে মুগ্ধ হয়ে পবিত্র ইসলাম ধর্ম কবুল করতে থাকে। এভাবে মহাকালগড়ে ইসলামের শক্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিছুকাল পরে হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি মাখদুম নগর থেকে তাঁর বহু অনুচরদের মহাকালগড়ের জুলুমবাজ দেওরাজাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।
হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহির রাজশাহী আগমনের অন্যতম আরও একটি কারণ হচ্ছে, তার জন্মভূমি বাগদাদের চরম অশান্ত ও ভীতিকর পরিবেশ। কেননা ১২৫৮ ঈসায়ীতে অসভ্য, বর্বর মোঙ্গল জাতি, পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের মতে আল্লাহর অভিশাপ হালাকু খান নামে অভিহিত বাগদাদ আক্রমণ করার পর সেখানে যে অবর্ণনীয় ধ্বংসলীলা চালায় তা সত্যিই কল্পনাতীত। তাদের এই আক্রমণ ও ধ্বংসলীলায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে তথাকার জনগণ। সমস্ত পরিবেশ হয়ে উঠে বসবাসের অনুপযোগী।
হযরত শাহ মাখদুম এর আগমন এবং তদানীন্তন বাংলাদেশ
হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি যে সময় এদেশে আগমন করেন সে সময় এদেশের সমাজব্যবস্থা মোটেই সুখকর ছিল না; আর রাজনৈতিক অবস্থাতো ছিল মুসলমানদের সম্পূর্ণ প্রতিকূলে। এদেশের মানুষকে কিছুটা সচেতন করার প্রয়াস পেলেও দুনিয়াবী সফলতা তিনি পান নি এবং এ অঞ্চলের মানুষও ইসলামের সঠিক শিক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হয় নি। তাই স্বভাবতই এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের মহান দিকপাল হিসেবে হযরত শাহ মাখদুম রহমাতুল্লাহি আলাইহি যে প্রধানতম খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন এদেশে আগমন করেন তখন এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার মতো দেশীয় আবহাওয়াও ছিল চরম প্রতিকূল। সস্তা মূল্য দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলেন কিন্তু বাংলার আবহাওয়া তাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “দেশটি ভেজা ও অন্ধকার এবং খোরাসানবাসীদের মতো ঐশ্বর্যসম্ভারে পরিপূর্ণ দোজখ।”
তখন শুধু আবহাওয়াই প্রতিকূল ছিল তাই নয়, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ছিল ইসলাম প্রচারকদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। স্বাভাবিক কারণেই হিন্দু রাজারা ইসলাম প্রচারকদেরকে সুনজরে দেখতে পারে নি। তারা এসব ইসলাম প্রচারকদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাত, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করার চেষ্টা করতেও কসুর করত না। ফলে ইসলাম প্রচারক সূফী দরবেশদের অনেককে এদেশের হিন্দু সামন্তরাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। এসব যুদ্ধে কেউ কেউ শহীদও হয়েছেন। কিন্তু তাদের জীবন, কর্ম, চরিত্র ও চিন্তা অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করে এবং পরবর্তীকালে ইসলাম প্রচারের ধারাও অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে সংশ্লিষ্ট এলাকা ইসলামের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। সূফী ও দরবেশদের অনেকেই নিজেদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও অলৌকিক শক্তির (কারামত) সাহায্যে সাধারণ মানুষকে সম্মোহিত করেন বলে জানা যায়। কিন্তু জনগণের ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণের মূলে এ অলৌকিক শক্তির তাড়না যতোটুকু ছিল, তারচেয়ে অনেক বেশি ছিল ইসলামের অন্তর্নিহিত সম্মোহনী ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাব।
হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ এবং নতুন সংঘাত
রাজশাহীতে হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহির আবির্ভাব যখন ঘটে তখন রাজশাহীর আদি পরিচয় ছিল মহাকাল গড়। এর সামন্তরাজারা দেও-দৈত্যের উপাসক হয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার, নিষ্ঠুরতা ও নরবলি দ্বারা এ অঞ্চলের মানুষের মনে ত্রাস ও তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। এদের রাজ্য ছিল বর্তমানের সমগ্র রাজশাহী শহর। রাজধানী বা শাসনকেন্দ্রে মঠ, মন্দির, দেও-দেবতার মূর্তির সমাবেশ ছিল দরগাপাড়ায়। এদের আরাধ্য দেবতা হিসেবে মহাকাল দেও-এর এক ভীষণ মূর্তি ছিল এই মঠে। মূলত সে সময় এই মহাকাল গড় এক দৈত্যপুরীতে পরিণত হয়েছিল যেখানে মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা ছিল না, নানারকম কুসংস্কারে সমাচ্ছন্ন ছিল ধর্মীয়সহ সকল পরিবেশ। সমাজ জীবনে বিরাজ করছিল নগ্নতা ও বর্বরতা। অন্ধকারের এই ঘোর অমানিশা ভেদ করে হঠাৎ প্রভাতিকিরণ ঝলমল করে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিল সমগ্র রাজশাহী শহরসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। যে মহান মানব এই অন্ধকারপুরীকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে তুললেন, মানুষকে দিলেন সঠিক পথের দিশা, তিনি আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন অলীকুল শিরোমণি মহান সাধক হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি। অন্যত্র বলা হয়েছে, হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি শিক্ষা সমাপ্ত করে বহু দরবেশ ও মাওলানা, ফকির, গাজী সমভিব্যাহারে ঐ দানবকুল ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার করার জন্য তথায় (রাজশাহী) প্রেরিত হন।
হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর দাদাজান হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ.-এর রূহানী নির্দেশে এতদঞ্চলে আগমন করেছিলেন একথা প্রায় সকল জীবনীকার বর্ণনা করেছেন; তবে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে যে, তিনি কোন্ স্থান থেকে এদেশে আগমন করেন। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, তিনি বাগদাদ নয় বরং দিল্লিতে থাকাকালীন রূহানী নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশে আসেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে, হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণকালে হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির বংশধরগণ বাগদাদ থেকে কাবুল, কান্দাহার, পারস্য ও পাক-ভারতের বিভিন্ন জনপদে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হযরত শাহ মাখদুম রহমাতুল্লাহি আলাইহির পিতা হযরত আযাল্লাহ শাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি দিল্লিতে অবস্থান গ্রহণ করেন। আযাল্লাহ শাহ দিল্লি থাকাকালে তাঁর তিন পুত্র তাঁর সাহচার্য থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। হালাকু খানের মৃত্যুর পর আযাল্লাহ শাহ পুনরায় বাগদাদ গমন করলেও তার যোগ্য পুত্রত্রয় ইসলাম প্রচারের ব্রত নিয়ে অনুচরবর্গসহ বাংলার জনপদে আগমন করেন।
সত্যকথা বলতে কী, মহান এই সাধক হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবনের প্রকৃত তথ্য অনেকটা রহস্যাবৃত থাকলেও প্রাচীন ফার্সি গ্রন্থের মূল নথি থেকে অনূদিত একটি প্রাচীন বাংলা গ্রন্থের পা-ুলিপি অধুনা হস্তগত হয়েছে। সেখান থেকে আহরিত তথ্যাদি, প্রস্তরফলকে অঙ্কিত ফার্সি ভাষায় লিখিত বাণীসমূহ, তৎকালীন তাম্রলিপিসমূহের তথ্য ও লোক পরম্পরায় লোকজ কাহিনীর ধারাবাহিকতা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে এই মহামনীষীর জীবনেতিহাস দেদীপ্যমান হয়ে রয়েছে এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। ঐতিহাসিক তথ্যাদি থেকে জানা যায় যে, হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে বারোজন শিষ্যসহ গৌড় পাণ্ডুয়াতে অবস্থান গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে পৌত্তলিকতার মুকাবিলা করতে করতে বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায় আগমন করে স্থায়ী আস্তানা স্থাপন করেন। বড়ভাই হযরত সাইয়িদ আহমদ তন্নুরী বা হযরত মীরান শাহ রহ.-সহ ৬৮৫ হিজরী সনে বাগদাদ শরীফ থেকে ধর্ম প্রচারার্থে ও সামাজিক অবিচার-অনাচার, অত্যাচার ও কদাচার দূরীকরণার্থে এদেশে আগমন করেন। মীরান শাহ লক্ষীপুর জেলার কাঞ্চনপুরে এবং শাহ মাখদুম রহমাতুল্লাহি আলাইহি কাঞ্চনপুরের সন্নিকটে শ্যামপুরে স্ব স্ব খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন ৬৮৫ হিজরী ১২৮৭ ঈসায়ী সালে। ইসলামী বিশ্বকোষসহ অন্যান্য বর্ণনাতেও অনুরূপ তথ্য পাওয়া যায়।
হযরত শাহ মাখদুম শ্যামপুর এলাকায় দায়রা স্থাপন করে প্রায় দু-বছর অবস্থান করেন এবং ইসলাম প্রচার করতে থাকেন ৬৮৫-৬৮৭ হিজরী/১২৮৭-১২৮৯ ঈসায়ী পর্যন্ত সময়। শ্যামপুর দায়রা সূত্রে জানা যায়, দায়রার প্রতিষ্ঠাতা যাকীউদ্দীন হুমায়নী রহমাতুল্লাহি আলাইহি হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.-এর একজন বিশিষ্ট মুরিদ ছিলেন। হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি সেই দায়রার যাবতীয় দায় দায়িত্ব মুরিদ যাকীউদ্দীনের হস্তে অর্পণ করে খলীফা নিযুক্ত করে চারজন দরবেশ সঙ্গী নিয়ে গৌড় রাজ্যের দিকে অগ্রসর হন। তার সঙ্গী চারজনের নাম হচ্ছে যথাক্রমে ১. হযরত সাইয়িদ শাহ আব্বাস রহ., মাজার মাখদুম নগর, বাঘা, রাজশাহী; ২. হযরত শাহ সুলতান রহ.হি, সুলতানগঞ্জ, গোদাগাড়ী উপজেলার সন্নিকটে, রাজশাহী; ৩. হযরত শাহ করম আলী রহ., বিড়ালদহ, নাটোর রোড, রাজশাহী এবং ৪. হযরত সাইয়িদ দিলাল শাহ বুখারী রহ., মাজার দিলালপুর (আলাইপুর) বাঘা, রাজশাহী।
হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ. ও তাঁর সঙ্গীগণ এ অঞ্চলে এসে ইসলামের সুমহান বাণী জনগণের মাঝে প্রচার করতে থাকেন। কথিত আছে, বাঘার নিকটে তিনি একটি ছোট কেল্লা নির্মাণ করে সেখানে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে এবং হযরত তুরকান শাহ রহ-এর নির্মম শাহাদাতের প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে মুজাহিদ তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর এই মহৎ উদ্যোগে স্বতস্ফুর্তভাবে সাড়া দিয়ে দলে দলে লোক ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এতে মুজাহিদ দলে লোক দিন দিন বৃদ্ধি হতে থাকে এবং হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতেই থাকে। এদিকে হযরত শাহ সাহেব দৈত্যরাজার বিরুদ্ধে লড়াই করার পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন।
হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ. এলাকার নাপিতের নিকট থেকে তান্ত্রিক রাজাদের জাদুকুণ্ড সম্পর্কে সঠিক তথ্য লাভ করেছিলেন। ঐ নাপিতের ছেলেকে মন্দিরে বলি দেয়ার উদ্দেশে দৈত্যরাজার সামন্তরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, দৈত্যরাজের মন্দির প্রাঙ্গনে প্রাচীরবেষ্টিত অবস্থায় এক জাদুকুণ্ড কূপ ছিল। দৈত্যরাজ তা দ্বারা জাদুবিদ্যা পরিচালনা করে অসম্ভব অনেক অলৌকিক কাজ দেখিয়ে নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করত। হযরত শাহ মাখুদম রহমাতুল্লাহি আলাইহি ঐ নাপিত দ্বারা অনুসন্ধান লাভ করে আধ্যাত্মিক শক্তি বলে জাদুকুণ্ডের যাদু নষ্ট করে দেন। শত চেষ্টা করেও নাপিত পুত্রকে বলি দেয়া সম্ভব না হলে, তখন রাজার নির্দেশে রাজপ্রাসাদ হতে একটি মোটাতাজা মহিষ এনে দেবতার উদ্দেশে বলি দিয়ে কোনোরকমে রাজা তার মান রক্ষা করেন।
এমনি সময় ঘটনাক্রমে হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ. কোথা হতে মন্দির প্রাঙ্গনে এসে উপস্থিত হন এবং রোষকষায়িত নেত্রে মন্দিরের অভ্যন্তরে একবার দৃষ্টিপাত করেন। আল্লাহর প্রিয় অলী একটিবার মাত্র দৃষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গেই দেব মন্দিরের মূর্তিগুলো আপনা-আপনি ভেঙ্গে চুরমার হয় যায়। মন্দির প্রাঙ্গনে উপস্থিত জনতা ও আমাত্যবর্গ অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করে অদ্ভুত এই ঘটনা। এবার হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি সরাসরি দেওরাজের সমীপে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত রাগতঃস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে রাজা! তুমি নরবলি দাও কেন? এর মাহাত্ম্যই বা কী?’
দেওরাজ উত্তরে বলল, ‘যাকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হয় তার ভাগ্য সত্যিই খুব ভালো। কারণ তার এই বলি হবার কারণে সে সহ তার সাত পুরুষ স্বর্গবাসী হওয়ার সুযোগ লাভ করে।’ শাহ মাখদুম রহ. বললেন, ‘তাই নাকি! তবে তো বেশ। তা রাজা মহাশয়! আপনার কি কোনো সন্তানাদি রয়েছে?’ দেওরাজ রাগতস্বরে উত্তর দিল, ‘থাকবে না কেন, আছে। আর তা একটি দুটি নয়। আছে ছয়-ছয়টি পুত্র সন্তান!’ শাহ মাখদুম রহ. বললেন, ‘বড্ড খুশি হলাম, তবে হে রাজন! তুমি কেন তোমার ঐ ছয় সন্তানকে বলি দিয়ে ৪২তম পুরুষ পর্যন্ত স্বর্গবাসী হওয়ার সুযোগ নিচ্ছ না?’ লা-জওয়াব রাজা চরম ক্রোধান্বিত হয়ে হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঘোষণা করলেন এবং সে যুদ্ধে দেওরাজা চরম পরাজয় বরণ করে শাহ সাহেবের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।
শিক্ষা বিস্তারে হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ-এর অবদান
খ্যাতিমান দরবেশ হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ. তাঁর সারাটি জীবন ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কাজেই কাটিয়েছেন; পাশাপাশি ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রদানেরও ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। আমরা জানি, হযরত শাহ মাখদুম রহ.-এর জীবনের শেষ পর্যায়ে এতো অসংখ্য মত ও পথের মানুষ ইসলাম কবুল করেছিলেন যার ইয়ত্তা নেই। এই অগণন নব্য মুসলমানকে ইসলামের সুমহান শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে তিনি তাঁর অনুসারীদের মধ্য থেকে বিভিন্নজনকে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণের পাশাপাশি বিভিন্নজনকে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের আজ্ঞা দেন। তিনি নিজ দায়িত্বে তাঁর আস্তানার পাশেই একটি কাঁচা মসজিদ তৈরি করেন এবং সেই মসজিদ সংলগ্ন ‘মাখদুমী কাদিরিয়া মাদরাসা’ নামে একটি মাদরাসা নির্মাণ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই মাদরাসায় ইসলামের যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর এই মহান ও যুগান্তকারী উদ্যোগে নব মুসলিমগণ ইসলামের সঠিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভ করেন এবং এখান থেকেই অত্রাঞ্চল সর্বপ্রথম ইসলামী আলোর প্রদীপ শিখায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আলোতে অজ্ঞানতা ও কদর্য বিদূরিত হয়ে মানুষ হয়ে উঠে সত্যিকার মানুষ, সত্যিকার মুসলিম। তার তৈরি মাদরাসার সত্যতা স্বীকার করে জনৈক আলহাজ্ব আবুল কাশেম বলেছেন, ‘হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইসলাম প্রচারের জন্য এই আস্তানায় বিদ্যাপীঠ চালু করেন।’
হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ-এর ওফাতকাল
তিনি তাঁর পরম বন্ধুর সান্নিধ্যে যাওয়ার প্রাক্কালে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্বের সর্বশেষ কাজুটুকু সেরে নেওয়ার জন্য সকলকে তাঁর সকাশে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। যথাসময়ে সকল অলী দরবেশ এবং তাঁর গুণগ্রাহী অনুচরবৃন্দ এসে উপস্থিত হন। দৈত্যরাজদ্বয় (মহাকালগড়ের দুই রাজভ্রাতা) ও তাদের পুত্র পরিজনকে তিনি মুরিদ বানান। হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহির নির্দেশ পেয়ে তাঁর চার খলীফাসহ অনেক লোক তাঁর আস্তানায় হাজির হতে থাকেন হিজরী ৭৩১ মোতাবেক ১৩৩১ ঈসায়ীতে। জোহরের নামায শেষে দরবেশ তাঁর চার খলীফা ও পালিত পুত্রদ্বয় সকলকে অসিয়ত দান করেন। তিনি তাঁর অসিয়ত নামায় হযরত শাহ আব্বাস রহ., হযরত শাহ সুলতান রহ., শাহ করম আলী রহ., সাইয়িদ দিলাল শাহ বুখারীকে স্থায়ী খলীফা নিযুক্ত করার ঘোষণা দেন। তাঁর পালিত পুত্রদ্বয় শাহ দাউদ ও শাহ গরীবের উপর দরগাপড়া তথা শাহ মাখদুম রূপোশ রহ.-এর মাজারসহ অত্রাঞ্চলের খাদেমের দায়িত্বভার প্রদান করেন। অন্য বর্ণনায় অবশ্য শাহ গরীব ও শাহ দাউদের পূর্বপুরুষ শাহ জলিল ও শাহ নিয়ামতকে শাহ মাখদুম রহ.-এর আস্তানার খাদেম পদের দায়িত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
মোটকথা, হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহ. তাঁর সঙ্গী চারজনকে চার স্থানের খলীফার দায়িত্ব এবং তাঁর আস্তানার দায়িত্ব প্রদান শেষে তিনি তাদের নিকট বেশ কিছু গুপ্ত রহস্য ও ভবিষ্যদ্বানী ব্যক্ত করে অসিয়ত প্রদান করে জানান যে, আমার ভ্রাতার বংশের সন্তান শাহ নূর বাগদাদ শরীফ থেকে এখানে এসে খলীফার পদ লাভ করবেন। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এই আস্তানার খলীফা পদপ্রাপ্ত হবেন না এবং হওয়ার যোগ্যও নন। শাহ নূরের আসন আমার ডান পাশে থাকবে। সেই আমার পরম স্নেহের জন, সেই এখানে সসম্মানে ভূষিত হবে। এরপর আসরের নামাযান্তে দরবেশ সাহেব সকলের সামনে তাঁর ছোট্ট ভাষণে জানিয়ে দিলেন যে, আল্লাহর কুরআন, রাসূলের হাদীসসহ ইসলামী শরীয়তের যাবতীয় বিধি-বিধান যথাযথ পালন ব্যতীত আল্লাহর নৈকট্য লাভ আদৌ সম্ভব নয়। এরূপে নানা উপদেশ প্রদান করতে করতে তিনি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দরবেশ তাঁর খাদেম শাহ দাউদ ও শাহ গরীব এবং অন্যান্য খলীফাদের সঙ্গে করে বর্তমান দরবেশের রওজা মুবারক স্থানে গিয়ে তাঁর হাতের লাঠি দ্বারা নিজ কবরের স্থান এবং তাঁর ভাইয়ের বংশের সন্তান হযরত শাহ নূরের কবরের স্থানও চিহ্নিত করে দেন।
এই ঘটনার পরপরই তিনি আস্তানায় ফিরে এসে নিজ মসজিদে মাগরিবের নামায আদায় করার জন্য প্রবেশ করেন। নামায শেষে পুনরায় সকলকে উপদেশ প্রদান করেন যে, ইসলাম ধর্মের বিধান বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ পাকের পবিত্র কুরআনে নামায ও রোযা মুসলমানদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত এবং নামায ও রোযা কোনও অবস্থায় মুসলমানের জন্য মাফ নেই। এরপর নিজ আস্তানায় ফিরে এসে তাঁর শরীর চাদর দিয়ে আগাগোড়া ঢেকে ঘুমিয়ে পড়েন। এই মহান দরবেশের শেষ শয্যা যে চিরনিদ্রায় পরিণত হবে একথা কেউ কল্পনা করতে পারেন নি। তবে সবাই নিশ্চিতভাবে জেনে গিয়েছিলেন যে, হযরত শাহ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি দুনিয়াবী সকল দায়-দায়িত্ব মিটিয়ে খুব শীঘ্রই আপন বন্ধুর সান্নিধ্যে চলে যাবেন। তাই উপস্থিত খলীফাগণ এবং অন্যান্য সকলেই একটু বিমর্ষ হয়ে পড়লেন, কারও মুখে কোনো কথা নেই, স্বজন হারানোর চিন্তা যেন সকলকে বোবা বানিয়ে দিল।
এভাবে কতোটা সময় অতিক্রান্ত হলে, ভক্তদের উতলা মন বেশি ধৈর্য ধরতে সক্ষম হল না। তারা দরবেশের মুখের চাদর সরিয়ে দেখলেন, এই মহান দরবেশ চিরনিদ্রায় মগ্ন রয়েছেন অর্থাৎ দুনিয়ার সকল মায়া ত্যাগ করে তিনি পরম বন্ধুর সান্নিধ্যে চলে গিয়েছেন।
এই দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিকে কান্নার মাতম শুরু হয়ে যায়। কে কাকে কীভাবে সান্ত¡না দেবে তার ভাষা সবাই হারিয়ে ফেলে। সকলেই আজ যেন মাতৃহীন, পিতৃহীন অসহায় অবোধ শিশু। এভাবে দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ার পর শত সহস্র শোকাতুর জনতাসহ খলীফাগণ এই দরবেশের জানাযা পড়ে চিহ্নিত স্থানে তাঁকে সমাহিত করে। সেদিন ছিল ২৭ শে রজব ৭৩১ হিজরী মোতাবেক ১৩৩১ ঈসায়ীর আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টা।