আরব বিশ্ব জুড়ে আন্দোলন শুধু দেশগুলোর রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও৷ অন্তত বিশেষজ্ঞরা তেমনটাই আশা করছেন৷
ইতিহাস
একটা সময় ছিল যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলিমরাই এগিয়ে ছিল৷ বীজগণিত আবিস্কার করা থেকে শুরু করে চিকিৎসা, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান সবক্ষেত্রেই দাপটের সঙ্গে কাজ করেছে মুসলিমরা৷ ১৩ থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত ইউরোপের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যবই ছিল ইবনে সেনার লেখা ‘দ্য ক্যানন অব মেডিসিন’ নামের চিকিৎসাবিদ্যার একটি বই৷ যেটা লেখা হয় ১০২৫ সালে ৷
মুসলিমদের এই স্বর্ণযুগ ছিল অষ্টম থেকে ১৩ শতকের মধ্যে৷ তখন বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবীরা বাস করতেন বাগদাদে, নয়তো কায়রোয়৷ কেউ কেউ তৎকালীন মুসলিম স্পেনের কর্দোবায়৷
কেন এমন হলো?
এ সম্পর্কে নানা মত রয়েছে৷ যেমন ১৩ শতকের দিকে মোঙ্গলদের আরব বিশ্ব দখল বা বিশ শতকের ঔপনিবেশিক শাসন এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন কেউ কেউ৷
অনেকে আবার ইসলাম বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের ভুল ব্যাখ্যাকেও দায়ী মনে করেন৷ এঁদেরই একজন নিদহাল গুয়েসোম৷ তিনি আলজেরিয়ার জ্যোতির্বিজ্ঞানী৷ বর্তমানে কাজ করছেন আরব
আমিরাতের ‘অ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটি অব শারজাহ’তে৷ গুয়েসোম বলছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অংক কষে বলে দিতে পারেন কোন্ দিন কোন্ দেশে রোজা শুরু হওয়া উচিত৷ কিন্তু তাদের এই প্রস্তাব ধর্মীয় সংস্থাগুলো মানতে রাজি নন বলে জানিয়েছেন তিনি৷ তারা মনে করে যন্ত্র নয়, খালি চোখে চাঁদ দেখা সাপেক্ষেই রোজা শুরু হবে৷ কিন্তু গুয়েসোম বলছেন, এর ফলে কোনো কোনো দেশে ভুলবশত এক বা দুইদিন পরে রোজা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ কেননা মেঘের কারণে খালি চোখে তো চাঁদ দেখা নাও যেতে পারে!শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানই নয়, মানুষের বিবর্তন, জিনতত্ত্ব বা নৃবিজ্ঞান এসব ক্ষেত্রেও গবেষণা করাটা ঠিক নয় বলে মনে করে অনেক ধর্মীয় সংগঠন৷ যেমন কিছু গোঁড়া খ্রিস্টান ধর্মীয় সংগঠন চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব মানতে রাজি নন৷
রাজনৈতিক ব্যবস্থা দায়ী?
এদিকে গত ৫০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে আরব বিশ্বে যে ধরণের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেটাও এই অঞ্চলে বিজ্ঞান প্রসারে একটা বাধা হিসেবে দেখছেন অনেকে৷ যেমন ব্রিটেনে জন্ম নেয়া কান্তা আহমেদ৷ তিনি সৌদি আরবের একটি হাসপাতালে বছর দুয়েক কাজ করেছেন৷
আহমেদ বলছেন আরব বিশ্বে কারও মেধাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না৷ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক বা গবেষক হিসেবে কাজ পেতে হলে মেধা নয়, থাকতে হয় ‘কানেকশন’ অর্থাৎ উঁচু পর্যায়ের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ৷ এছাড়া সেখানে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে
মত প্রকাশের সুযোগ কম৷ সাধারণভাবে সমাজে যে বিশ্বাস প্রচলিত এর বাইরে কেউ কিছু বললে সেজন্য তাঁকে বিরূপতার সম্মুখীন হতে হয়৷শিশুরাও এক ধরনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে বড় হয়৷ ইচ্ছেমত প্রশ্ন করে করে শেখার যে অভ্যাস উন্নত বিশ্বের শিশুদের রয়েছে সেটা আরব বিশ্বের দেশগুলোতে নেই৷
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দুর্নীতিও বিজ্ঞান চর্চায় আরেকটি বাধা৷ যার অন্যতম শিকার মিশরের আহমেদ জেওয়াইল৷ নোবেল জয়ী এই রসায়নবিদ কাজ করেছেন অ্যামেরিকার বিখ্যাত ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’ ক্যালটেক’এ৷
১২ বছর আগে তিনি কায়রোতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন৷ মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক তাঁর দুই বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের অনুমোদনও দেন৷ এছাড়া জেওয়াইলকে সম্মান জানাতে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ খেতাব ‘অর্ডার অব দি নীল’ দেয়া হয়৷ কথা ছিল, পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হবে৷ কিন্তু সেটা আর হয়নি৷
প্রকল্পের এক আদত ট্রাস্টি মোহাম্মদ আহমেদ ঘোনিম বলছেন মুবারক প্রশাসনের অনেকে জেওয়াইলের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি মেনে নিতে পারেনি৷ তাই তাঁর প্রকল্প যেন আলোর মুখ দেখতে না পারে সেই চেষ্টা তারা করেছে৷ কিন্তু আন্দোলনে মুবারকের পতনের পর এখন যারা দেশ পরিচালনা করছে তারা জেওয়াইলের প্রকল্প বাস্তবায়নের সব বাধা দূর করে দিয়েছে৷
বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, হয়তো এভাবেই কোনো একদিন মুসলমানরা আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্বকে নতুন কিছু উপহার দিতে পারবে৷
প্রতিবেদন: জাহিদুল হক
সম্পাদনা: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী