শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৪:২৪
Home / অনুসন্ধান / সন্ত্রাসবাদের জনক প্রথম জঙ্গি সংগঠন ইহুদিদের ‘হাগানাহ’

সন্ত্রাসবাদের জনক প্রথম জঙ্গি সংগঠন ইহুদিদের ‘হাগানাহ’

haganaবর্তমান বিশ্বে সবচে আলোচিত ইস্যুগুলোর একটি হচ্ছে ‘জঙ্গিবাদ’। শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মধ্যপ্রাচ্য। আর মধ্যপ্রাচ্য মানেই আরব, মুসলিম। মোটকথা জঙ্গিবাদকে মুসলিমদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোতে এখন একটি কথা প্রচলিত হয়ে গেছে, ‘অল মুসলিমস আর নট টেরোরিস্ট, বাট অল টেরোরিস্টস আর মুসলিম’। অর্থাৎ সব মুসলিমরাই সন্ত্রাসী নয়, তবে সব সন্ত্রাসীরাই মুসলিম।

জঙ্গিবাদ সবচে বেশি আলোচিত হচ্ছে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার্সে হামলার পর। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে হামলাটি হওয়ায় ঘটনাটি ‘নাইন ইলেভেন’ নামেও পরিচিত। এরপরই আলোচনায় আসে আল-কায়েদা, লাদেন। ওই ঘটনাটি নিয়েও আছে অনেক বিতর্ক। তবে জঙ্গিবাদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্কটা কিন্তু সেখান থেকেই নয়। এর আরো পুরনো ইতিহাস আছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম জঙ্গি সংগঠন ছিল ইহুদিদের ‘হাগানাহ’ নামের একটি দল। ব্রিটিশদের সহায়তায় এই জঙ্গি দলটি গঠন করেছিল ইহুদিরা। উদ্দেশ্য ছিল, ফিলিস্তিন ভূখণ্ড থেকে আরবদের তাড়িয়ে সেখানে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

হাগানাহ’র সেই ইতিহাস জানতে হলে প্রথমেই চলে যেতে হবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়টাতে। আজকের এই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি তখন ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় খেলাফতের পতন হয়। উসমানীয়দের অধীনে থাকা রাষ্ট্রগুলো চলে যায় মিত্রশক্তির অধীনে। ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট পায় ব্রিটিশরা। ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য সেখানে একটি রাষ্ট্র গঠনের কথা থাকলেও ১৯১৭ সালে হঠাৎ করেই বেলফোর চুক্তির মাধ্যমে ওই ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণা দেয় ব্রিটিশ সরকার।

তবে এতে কিছু সমস্যা ছিল। কারণ তৎকালীন ফিলিস্তিনে তখনও আরবরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং রাতারাতি ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না। সেজন্য দেরি করতে থাকে ব্রিটিশ সরকার। আর এতেই মরিয়া হয়ে ওঠে ইহুদিরা। যত দ্রুত সম্ভব ফিলিস্তিনে স্বাধীন ইহুদিরাষ্ট্র ‘ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দিতে থাকে তারা। এদিকে স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা বেলফোর চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা আন্দোলন শুরু করেন। অনিবার্য হয়ে ওঠে সংঘাত। এই সময়টাতে আরবদের দমনে সশস্ত্র পথ বেছে নেয় ইহুদিরা। একের পর এক তারা জঙ্গি সংগঠন গঠন করতে থাকে। ১৯২০ সালে প্রথমেই তারা তৈরি করে ‘হাগানাহ’। এরপর তৈরি করে ‘ইরগুন’ এবং ‘স্টার্ন গ্যাং’।

হাগানাহ’র জাহাজ

প্রথমে তারা যে ‘হাগানাহ’ তৈরি করেছিল, সেটাই ছিল মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম কোনো জঙ্গি সংগঠন। ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এই হাগানাহ-ই হয় তাদের সামরিক বাহিনী ‘ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস’ (আইডিএফ)। আজও ইসরায়েলে সেই বাহিনীটিই প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে। ১৯২০ সাল থেকে আরব নিধনের কাজ শুরু করে হাগানাহ। প্রথমে তাদের কার্যক্রম ছিল জেরুজালেম এবং তেল আবিবের মধ্যে সীমাবদ্ধ। শুরুর দিকে তারা অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ করতে থাকে। আর এসব কাজে হাগানাহকে সহায়তা দিচ্ছিল ব্রিটিশরা।

১৯২৪ সালে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতির অভিযোগে তারা জ্যাকব দে হান নামের এক ইহুদিকে হত্যা করে। এটাই তাদের প্রথম স্বীকৃত হত্যাকাণ্ড। এরপর একের পর এক হত্যাকাণ্ড এবং আরবদের ওপর দমন পীড়ন চালাতে থাকে হাগানাহ। হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের তারা বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। তাদের এসব অপকর্ম যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল তখনই নীতি পাল্টে ফেলে এই জঙ্গি দলটি। একদিকে তারা বেছে নেয় আত্মঘাতি হামলার পথ। অপরদিকে কিছু ইহুদি এবং ব্রিটিশদের ওপরও হামলা চালাতে থাকে হাগানাহ।

১৯৩৭-১৯৩৯ সালের ফিলিস্তিনের মধ্যে বিভিন্ন গণপরিবহণ এবং ব্রিটিশ সেনাদের টহলযানে হামলা চালায় তারা। এতে ২৪ জন নিহত হয়। ১৯৪০ সালের ২৫ নভেম্বর হাগানাহ প্রথমবারের মত বড় আকারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ফ্রান্সের জাহাজ এসএস প্যাট্রিয়া প্রায় ১৮০০ ইউরোপীয় ইহুদিসহ ফিলিস্তিনের হাইফা বন্দরে উপস্থিত হয়। অনুমোদন না থাকায় ব্রিটিশ প্রশাসন জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তে দেয়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে হাগানাহ। তারা এই ১৮০০ ইহুদিকে যেকোন মূল্যে ফিলিস্তিনের মাটিতে নামাতে জাহাজের ভেতর বোমা সংস্থাপন করে, যাতে জাহাজটি কার্যকারিতা হারিয়ে বন্দর ত্যাগ করতে না পারে। কিন্তু বোমায় বিধ্বংসী উপাদান বেশি হওয়ায় জাহাজটি একেবারে ডুবেই যায়। এতে ২৬৮ জন ইহুদী নিহত এবং ১৭২ জন আহত হয়।

হাগানাহ’র নারী জঙ্গি

১৯৪৬ সালে আরেকটি বড় ধরনের অভিযান চালায় হাগানাহ। একে ‘অপারেশন মারকোলেট’ বা ‘নাইট অব দ্য ব্রিজেস’ বলা হয়। ফিলিস্তিনের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আরব দেশ লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান এবং মিশরের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়ার জন্য ওই বছরের ১৬ ও ১৭ জুন ১১টি সেতু ধ্বংস করে দেয় সংগঠনটি। তাদের সাথে যোগ দেয় আরেক ইহুদি জঙ্গি সংগঠন ‘পালমাচ’। একই বছরের ২৬ জুলাই হাগানাহ এবং অপর জঙ্গি সংগঠন ইরগুন একসঙ্গে জেরুজালেমে কিং ডেভিড হোটেলে বোমা হামলা চালায়। এতে ৯১ জন নিহত হয়। এরমধ্যে ছিল ২৮ ব্রিটিশ, ৪১ আরব এবং ১৭ জন ইহুদি।

১৯৪৭ সাল থেকে গণহারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করতে শুরু করে হাগানাহ। ১৯ ডিসেম্বর সাফাদ নামক একটি আরব গ্রাম আক্রমণ করে দুইটি বাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। এতে পাঁচ শিশুসহ মোট ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হন। ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি মাউন্ট ক্যারমেলের একটি গ্রামে হামলা করে ১৭ জনকে হত্যা করে তারা। ৪ জানুয়ারি তারা ব্রিটিশ সেনাদের পোশাক পরে ছদ্মবেশে জাফফায় প্রবেশ করে আরব ন্যাশনাল কমিটির সদর দপ্তর উড়িয়ে দেয় হাগানাহ। এতে ৪০ জন নিহত এবং ৯৮ জন আহত হন।

হাগানাহ’র এসব অপকর্মের কাহিনী লেখা আছে ইসরায়েলের হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং ইতিহাসবিদ ইলান প্যাপ’র ‘এথনিক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন’ বইতে। এই বইতেই পাওয়া যায় দেইর-ইয়াসিন নামক একটি ফিলিস্তিনি গ্রামের কথা। ইহুদি সৈন্যরা গ্রামটি অবরোধ করে প্রথমে তারা বেপরোয়া গুলিতে বহু মানুষকে খুন করে। বাকিদের একটি স্থানে এনে জড়ো করে। আরব তরুণীরা নির্বিচার ধর্ষণের শিকার হন। শেষে ৩০ শিশুসহ সেখানে মোট ৯৩ জনকে হত্যা করা হয়। অনেকেই মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যা এরচেয়ে অনেক বেশি হবে।

এভাবেই ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা করত হাগানাহ

তৎকালীন প্রধান ইহুদি নেতা বেন-গুরিয়ন ১৯৩৮ সালে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি ফিলিস্তিন থেকে আরবদের বলপূর্বক বের করে দিতে চাই এবং আমি মনে করি এতে অনৈতিকতার কিছু নেই।’ ১৯৪৮ সালে বিশেষ অনুকূল পরিস্থিতিতে তার সেই ‘নৈতিকতা’ বাস্তবরূপ পায়। ওই বছর ১৪ মে ফিলিস্তিনে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের ম্যান্ডেট শেষ হয়। সেদিন রাত ১২টা ১ মিনিটে জুয়িস্ট পিপলস কাউন্সিল ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এরপরও অব্যাহত থাকে নৃশংসতা, নির্মম সশস্ত্র আগ্রাসন। ছয় মাসের পরিকল্পিত অভিযানের মাধ্যমে ৫৩১টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। ১১টি শহর করা হয় জনশূন্য, ফিলিস্তিনি জনসাধারণের অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ, প্রায় ৮ লাখ মানুষকে দেশ থেকে পুরোপুরি উৎখাত করা হয়। হারানো ভূখণ্ড ফিরে আজও লড়ে যাচ্ছে ‘নিজ দেশে পরবাসী’ ফিলিস্তিনিরা।

প্রথম দিককার এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সাদৃশ্য আছে আজকের আইএস বা আল কায়েদার মতো সংগঠনগুলোর। এদের প্রত্যেকের জন্ম এবং লালন সবকিছুই করেছে বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। ব্রিটিশদের পতনের পর মার্কিন সাম্রাজ্যের যুগ শুরু হয়। প্রত্যক্ষভাবে তারা ইসলামের নামে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটায়। এমনকি ক্ষমতায় যেতেও সাহায্য করে।

আজকের দিনের জঙ্গি সংগঠনগুলোর তাকালেও দেখা যাবে, ইসলামের নামে তারা সবচে বেশি হত্যা করে মুসলিমদেরই। তাদের নির্মমতার সবচে বেশি শিকার মুসলিমরা। এসব জঙ্গিদের দ্বারা সবচে ক্ষতিগ্রস্তও হয় মুসলিমরাই। তবে ওরা তো পশ্চিমা দেশেও ইদানিং হামলা করছে! জনমত ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে হাগানাহ-ও কিন্তু কিছু ইহুদি হত্যা করেছিল। আজকের জঙ্গিরাও একই পথের অনুসারি।

সৌজন্যে- বাংলামেইল২৪ডটকম/ আরএস

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...