শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৮:৩৮
Home / আকাবির-আসলাফ / হযরত শাহ সুলতান রূমী রহ.

হযরত শাহ সুলতান রূমী রহ.

sufismপ্রাককথন
বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এখানে এসেছেন হাজার হাজার মুবাল্লিগ, ধর্ম প্রচারক আল্লাহর অলীগণ। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের পর থেকে এই ধর্ম প্রচারকগণ নবোদ্যমে ইসলামের প্রচার শুরু করেন। তাদের প্রচারে তদানীন্তন বাংলার কুসংস্কার পাপাবিদগ্ধ সমাজে জ্বলতে শুরু করে সত্যের সোনালি শিখা। ভুলপথের মানুষেরা আসতে থাকে ইসলামের শীতল ছায়ায়।
সে সময়কারই এক জনপদ ছিল বর্তমানের নেত্রকোণা। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারের থাবায় আচ্ছন্ন ছিল তখন এই নেত্রকোণা। হিন্দু সম্প্রদায়ের দারুণ প্রভাব ছিল এ অঞ্চলে। বলতে গেলে তারা ছিল তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ, মুসলমানরা ছিল সংখ্যায় অল্প। এজন্যেই তখন এলাকার নাম ছিল কালীগঞ্জ। হিন্দুরা সেসময় মুসলমানদের উপর নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালাত, হেয় প্রতিপন্ন ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। নিরুপায় হয়ে কোনো মুসলমান কোনো হিন্দুবাড়িতে ঢুকলে সেখানে নিজ হাতে পানি পান করার সুযোগ ছিল না তার। পাত্রে হাত লাগিয়ে পান করার সুযোগ ছিল না, বরং উপর দিকে মুখ হা করে থাকতে হত আর বাড়ির চাকর শ্রেণীর কেউ উপর থেকে মুখে জল ঢেলে দিত।
এ অবস্থার অবসান ঘটান যিনি, শিক্ষার আলোয় শিক্ষিত করে সভ্যতা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শেখান যিনি, তিনি হলেন মহান সমাজ সংস্কারক, ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম এবং বাংলাদেশে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আগমনকারী হযরত শাহ্ সুলতান কামরুদ্দীন রূমী।

প্রাগৈতিহাস
শাহ সুলতান রূমীর পূর্বের জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। শুধু জানা যায়, তিনি রোমের প্রতাপশালী এক সম্রাটপুত্র ছিলেন। তৎকালীন রোম সম্রাট ছিল তার ভাই আর তিনি সাম্রাজ্যের যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সে জীবনে তিনি অত্যন্ত বিলাসপ্রিয় ছিলেন। একদিনের একটি ঘটনায় তার জীবনের ধারা পরিবর্তন হয়ে যায়। ঘটনাটি হল- রাজ পরিবারের এক বাঁদী একদিন তার শয়নকক্ষ ঠিকঠাক ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে গিয়ে শাহ সুলতানের বিছানায় ক্ষণিকের জন্যে শুয়ে পড়ে। ইত্যবসরে শাহ সুলতান নিজ কক্ষে ঢুকে বাঁদীর এ ঔদ্ধত্য দেখে ক্রোধান্তিত হন এবং বাঁদীকে সাতটি বেত্রাঘাত করেন। এতে বাঁদী রক্তাক্ত হয়েও হাসতে থাকে। সুলতান বিস্মিত কণ্ঠে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে বাঁদী সহাস্যে বলে, ‘যুবরাজ! আমি যেমন আপনার বাঁদী, আপনিও তেমন আরেকজনের বান্দা। আমার ক্ষণিকের আরামের অন্যায়ে আপনি সাতটি বেত্রাঘাত করলেন। আর আপনি যে পূর্ণ যৌবনকালের সুদীর্ঘ সময় আরাম করে আসছেন, তাহলে আপনার জন্যে আপনার মাওলা কতোগুলো বেত্রদ-ের ব্যবস্থা করবেন?’
এ কথায় সুলতান বিহ্বল হয়ে পড়েন এবং প্রকৃত শান্তি ও স্থায়ী আরামের খোঁজে হন্যে হয়ে যান। রাজ্যশাসন, রাজকীয় ভোগ-বিলাসের মোহ ত্যাগ করেন। আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়েন। আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেন। তাই তখন বিশ্বনন্দিত ও বিখ্যাত বুযুর্গ, অলীয়ে কামেল হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহির দরবারে ছুটে যান। সে দরবারেই পেয়ে যান স্বীয় মামা হযরত সাইয়্যেদ মুহিউদ্দীন সুরখুল আম্বিয়া সুরতনী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে। উভয়জন থেকে তিনি ইলমে মারেফাতের দীক্ষা গ্রহণ করে ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে যান।

এদেশে আসার কারণ
হযরত রূমী তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভে যতোই অগ্রসর হলেন ততোই সংসার জীবনের প্রতি উদাসীন ও বিমুখ হতে লাগলেন। আত্মীয়-স্বজনরা চিন্তায় পড়ে গেল। তাকে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে এক রূপসী রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহের আয়োজন করল। কিন্তু এতোদিনে তিনি তো আর সেই শাহ সুলতান নেই; এখন সামান্য মানব- রাজ্যকে তুচ্ছ, অসার, অর্থহীন মনে করে বিশ্ব জনসমুদ্র সেবায় অবগাহনোদ্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়ার দীপ্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তিনি। তাই হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত জিন্দা করার দৃঢ় প্রত্যয়ে বিশ্বখ্যাত তাপস মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহির ইঙ্গিতে মুর্শিদ মামা সুরতানী রহমাতুল্লাহি আলাইহিসহ জন্মভূমি ত্যাগ করে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন।
পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে ঘোর কুসংস্কারে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর পূর্ব দিককে কুরআনের আলোয় আলোকিত করতে এবং ইসলামের পবিত্র শান্তির নবজীবন দানের উদ্দেশ্যে ছুটে আসেন বাংলার এই ভূমিতে।

শাহ্ সুলতান রূমীর রহ. বাংলাদেশে আগমন
শাহ্ সুলতান কামরুদ্দীন রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ৪৪৫ হিজরী (১০৫৩ ঈসায়ী) সনে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে সুদূর রোম (ইটালি) থেকে ১২০ জন সূফী-সাধক নিয়ে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে আগমন করেন। তার আগে আর কোনো সুফী দরবেশ বাংলাদেশের এ অঞ্চলে ধর্ম প্রচার করতে আসেন নি বলে ধারণা করা হয়।
তখন শুধু এই বাংলায়ই নয় বরং সারা ভারত উপমহাদেশেই ছিল পৌত্তলিকদের কাঁসার ঘণ্টার মহা কলরোল। মুসলমানদের ছায়াটুকুও সহ্য করতে পারত না তখনকার শাসকরা। এ অবস্থায় তিনি গঙ্গানদী পাড়ি দিয়ে রাজশাহী সীমান্তে পৌঁছেন এবং রাজশাহী জেলার উপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এরপর ইসলাম প্রচারের অভিযানে পূর্বদিকে অগ্রসর হন। সবশেষে তিনি ময়মনসিংহে পদার্পণ করেন।
সে সময় কৌম, হিন্দু, মঙ্গোলীয়, গারো, হাজং, কোচ, মোচ, পৌঘণ্র, দ্রাবিড়, ব্রাহ্মন, আর্য, সেন, বৌদ্ধ ইত্যাদি জাতি বিভিন্ন রাজত্বের অধীনে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল। কোথাও শান্তির লেশমাত্র ছিল না। তাই রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বিভিন্ন এলাকা ও অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য বিভিন্ন দাওয়াতী কাফেলা প্রেরণ করতে থাকেন। এ পর্যায়ে ১৩ জন দরবেশের একটি বাহিনী বরেন্দ্রভূমির মহাস্থানের দিকেও প্রেরণ করেন। দুজন দরবেশের উপর দুর্মুটের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। আর তিনি নিজে হযরত সুরখুল আম্বিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহিসহ চল্লিশজন আউলিয়ার সমভিব্যাহারে তৎকালীন বিশাল প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র নদী আধ্যাত্মিক শক্তিবলে পাড়ি দেন এবং নদীর পশ্চিমতীরের বালুচরে (বর্তমান ময়মনসিংহ) ইসলামের প্রচারাভিযান শুরু করেন। এভাবে চতুর্দিকে ইসলামের প্রচারকার্য চলতে থাকে। এতদঞ্চলের স্বৈররাজাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণ দীনের প্রচারকদের মোহময় এবং শান্তির বাণী শুনে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিতে থাকে।

নেত্রকোনায় শাহ সুলতান রূমী রহ.
রাজনৈতিক ও সামরিক দক্ষতায় পারদর্শী যুবরাজ শাহ সুলতান রহমাতুল্লাহি আলাইহি মোমেনশাহীতে ইসলামের বিজয় নিশান উড়িয়ে এবার আরো পূর্বদিকে অগ্রসর হতে ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বতীরের কোচরাজ বোকাই কোচের রাজধানী বোকাইনগরে এসে রাজা বোকাইকে ইসলামের সার্বজনীন ন্যায়-নীতি, ইনসাফ ও সাম্যের বাণী শুনিয়ে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। রাজা পূর্ব থেকেই তাদের তৎপরতার কথা শুনে আসছিলেন। তাই তার জ্ঞানদীপ্ত মন এই অলীদের মুখে ইসলামের মর্মবাণী শুনে সশ্রদ্ধ হয় এবং তিনি স্বপরিবারে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর হযরহ শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এখানে একটি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এখান থেকেই ইসলামের প্রচার ও প্রসার অভিযান শুরু করেন। এতে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ইসলাম ও মুসলমানদের কর্তৃত্ব সৃষ্টি হতে থাকে।
নেত্রকোনা তখন মোমেনশাহীরই একটি অংশ। হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি শুনতে পেলেন যে, নেত্রকোণায় হিন্দুদের দাপট চলছে। তারই হাতে দীক্ষিত এবং বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলমানদের উপর নানা ধরনের নির্যাতন হচ্ছে। তখন তিনি বোকাই নগরের কায়কাউস বাহিনীর সমভিব্যাহারে নেত্রকোণা অভিমুখে রওনা হন এবং বিনা বাধায় মদনরাজ্যের কাছাকাছি চলে আসেন। নেত্রকোণার অদূরে মদনকোচের শাসন ছিল। রাজা মদনকোচ দরবেশের ব্যাপারে অত্যন্ত বেপরেয়া ও উদাস ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন যে, এই দরবেশ ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম থেকে বিভক্ত হয়ে মাত্র কয়েকজনের একটি বাহিনী নিয়ে আসছেন, তাই তিনি বিষয়টিকে তেমন আমল দিলেন না বরং হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে অবাধে ইসলাম প্রচারের সুযোগ দিলেন। এতে শত শত মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতে লাগল। কিন্তু এলাকার গোঁড়া হিন্দুরা এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং তীব্রভাবে ক্ষেপে উঠে। ফলে সেখানে হিন্দু ও মুসলমানদের সঙ্গে একপ্রকার খ-যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে হিন্দুরা মুসলমানদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

সামন্তরাজা মদনকোচের ইসলাম গ্রহণ
পরাজয় বরণ করে এলাকার প্রভাবশালী ও কূটকৌশলী হিন্দুরা রাগে দুঃখে রাজার কাছে অভিযোগ করল যে, ‘এই মুসলিম নেতা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, যে হারে মানুষ তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করছে এবং মুসলমান হচ্ছে, এতে অদূর ভবিষ্যতে আপনার রাজ্যে হিন্দুধর্মই বিলীন হয়ে যাবে। উপরন্তু তারা সুসংহত ও সুসংগঠিত হয়ে আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। তখন আপনার কিছুই করার থাকবে না।’
জায়নামাযের কারিশমা
এদিকে হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজের ও তাঁর সাথীদের বসবাসের জন্য একখ- জমি চেয়ে ভক্ত রূপস মল্লিককে রাজা মদনকোচের নিকট দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। প্রস্তাবটি রাজদরবারে উত্থাপিত হলে রাজার বোন নন্দিনী এই বলে আপত্তি করে যে, এরা এ সুযোগ পেলে মানব বলি ও গো হত্যা করবে। সুতরাং এদেরকে জায়গা দেয়া যায় না। তাই প্রস্তাবটি প্রথমবারের মতো প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়।
প্রত্যাখ্যানের জবাবে রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি শুধু নিজের জায়নামায বিছানোর জন্য অল্প খানিকটা জায়গা প্রদানের আবেদন করেন। এমন অতিক্ষুদ্র বস্তু চাইলে রাজা তা তুচ্ছজ্ঞানে মঞ্জুর করেন। কিন্তু পরক্ষণেই রাজার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, বিদেশিরা হয়তো জায়নামাযের নিচের জায়গায় গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। তাই তৎক্ষণাৎ রাজা সৈন্য-সামন্ত নিয়ে তথায় হাজির হন এবং নামায শেষে জায়নামাযের নিচের জায়গা খনন করতে তার লোকদেরকে হুকুম করেন। লোকেরা অনেক খোড়াখুড়ি করেও গুপ্তধনের কোনো সন্ধান পেল না।
হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মদনকোচের মনের সংশয় দূর করার জন্যে জায়নামাযখানা শূন্যে ছুড়ে দিলেন। জায়নামাযটি সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে বিদ্যুত বেগে সম্প্রসারিত হতে থাকে এবং অগ্নির লেলিহান শিখার মতো হাজার হাজার ফণাধারী সাপের অবর্ণনীয় শো শো শব্দে মদনকোচের রাজ্য কাঁপাতে থাকে এবং চারদিক ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে যেতে থাকে।
এবার মদনকোচ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে প্রায় জ্ঞানশূন্য অবস্থায় বাঁচার আকুতি জানাতে থাকে দরবেশের কাছে। হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তখন তাকে তিনটি প্রস্তাব দিয়ে যে কোনোটি গ্রহণ করার আহবান জানান। প্রস্তাব তিনটি হল- হয়তো ইসলাম গ্রহণ, অথবা বশ্যতা স্বীকার, নয়তো জিহাদ।
রাজা প্রথম প্রস্তাবটি গ্রহণ করে মুসলমান হওয়ার স্বীকৃতি দেন। এরপর হযরত শাহ সুলতান রূমী তার জায়নামাযটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন এবং ভীত-বিহ্বল পরিবেশ থেকে সকলকে মুক্ত করেন। হিন্দু রাজা এবং তার পাইক-পেয়াদারা এক মহাবিপদ থেকে সেদিনকার মতো বেঁচে সবাই যার যার বাড়ি ফিরে যায়।

বিষের পেয়ালা হাতে
পরদিন রাজা ইসলাম গ্রহণ উপলক্ষে হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে রাজ দরবারে দাওয়াত করেন। সদলবলে হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি রাজার প্রাসাদে গিয়ে উপস্থিত হন, কিন্তু রাজার হাবভাব ও ভোজন পর্বের আয়োজন দেখে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ব্যাপারটি সঠিক উপলব্ধির জন্যে সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধ্যানমগ্ন হলেন। ধ্যান শেষে বললেন, রাজভোজে বিষ মেশানো আছে। রাজা নিজেকে সামলে নিয়ে খাবারে চৌদ্দ তোলা বিষ মিশ্রিত থাকা সত্ত্বেও তিনি তা অস্বীকার করে বললেন, নিশ্চয়ই খাবারে বিষ মিশ্রিত নেই। সত্যকে চাপা দিয়ে মিথ্যার আশ্রয়ে নিজেকে সত্যবাদী বলে দৃঢ় থাকলেন।
হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এমনিতেই নিজের বহু অলৌকিক কার্যকলাপের মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করছিলেন। যে কেউ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে, সে মুসলমান হয়ে প্রাণোৎসর্গকারী শিষ্য হয়ে যেত। অতএব তিনি মনে করলেন যে, এখানেও একটি কাজ হোক। তাই তিনি বিসমিল্লাহ বলে আহার গ্রহণ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে শিষ্যরাও গ্রহণ করল। কিন্তু আল্লাহ তাআলার অপার মহিমা যে, কারো কোনো ক্ষতি হল না।
এ দৃশ্য দেখে রাজা অভিভূত এবং লজ্জিত হলেন। ভাবলেন, আগেরটায় জাদুর সম্ভাবনা ছিল কিন্তু এটায় জাদু থাকতে পারে না। তাই এবার মনে-প্রাণে ইসলামের মর্মকথা জানতে চাইলেন। হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার সুললিত কণ্ঠে কুরআনে হাকীমের কিছু আয়াত শরীফ তিলাওয়াতের পর এমন হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ইসলামের মর্মকথা বর্ণনা করতে আরম্ভ করলেন যে, রাজাসহ দরবারে উপস্থিত সমস্ত মানুষ কাঁদতে কাঁদতে ব্যাকুল হয়ে পড়েন এবং তখনই সবাই কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যান।
হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আধ্যাত্মিক প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ও সুললিত কণ্ঠের অধিক্বারী ছিলেন। তাই তাঁর ওয়াজ ও কর্ম প্রচেষ্টায় মোমেনশাহীর আকাশে-বাতাসে বৈপ্লবিক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন থেকে বেরিয়ে এসে শান্তির ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকেন।
মূলতঃ আমাদের দেশে বুযুর্গানে দীন, আউলিয়ায়ে কেরাম, সূফী-দরবেশ, পীর-ফকীরগণের মাধ্যমেই ইসলামের প্রচার হয়। কোনো রাজা-বাদশাহদের দ্বারা হয় নি। হযরত শাহ সুলতান কমরউদ্দীন রূমী ও তার দীক্ষাগুরু হযরত সুরখুল আম্বিয়া সুরতনীসহ ১২০ বুযুর্গ এবং পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আরও বহু অলী-দরবেশদের বিরাট অবদানের প্রেক্ষিতেই এ অঞ্চলের সর্বত্র ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে।

নেত্রকোণার মদনপুরে শাহ সুলতান রূমী চিরনিদ্রায়
এ অঞ্চলে আজও যারা মুসলমান হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে গর্বের অংশীদার মনে করছেন এবং দুনিয়ার সম্মান ও আখিরাতের প্রশান্তি লাভে ধন্য হয়েছেন বা হচ্ছেন, সবই এই মহান সাধক, সমাজ সংস্কারক, ধর্ম প্রচারক হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও তাঁর অনুসারীদের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে।
হযরত শাহ সুলতান রূমীর শায়খ হযরত সুরখুল আম্বিয়া সুরতানী তাঁর জীবনের শেষদিকে সুলতান রূমীকে নেত্রকোণায় রেখে পশ্চিমাঞ্চল- পাবনা ও বগুড়ায় ধর্মপ্রচারে মনোনিবেশ করেন। অবশেষে স্বদেশে চলে যান। আর বাকি সাথীরা প্রায় সবাই মোমেনশাহী এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন। তাদের স্মৃতি বিজড়িত মসজিদ, মাদরাসা, দরগাহ অনেক স্থানেই দেখা যায়।
হযরত শাহ সুলতান রূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও তাঁর কিছু সাথী ও ভক্ত মদনপুরের দরগাতেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
নেত্রকোণা আজ সেই নেত্রকোণা নেই। পার্থিব উন্নয়নের পাশাপাশি ধর্মীয় উন্নতিও সাধিত হয়েছে অনেক। মুসলমানের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ আর হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে নেই কোনো হানাহানি, নেই কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হাঙ্গামা। বলতে গেলে নেত্রকোণায় আজ শান্তির এক অপূর্ব পরিবেশ এবং নিরাপত্তার অনুপম নীড় বিদ্যামান, যা সেই মহান বুযুর্গানে দীনের পুণ্যপরশেই সম্ভব হয়েছিল।

শাহ সুলতান রূমীর মাজার শরীফ
হযরত শাহ সুলতান রূমীর দরগাহে প্রতিদিন শত শত মানুষের ভীড় হয়, কোলাহলে সমস্ত অঙ্গন সবসময় মুখরিত থাকে। মানুষ তাঁর জিয়ারত করে মহান আল্লাহ পাকের কাছে দুআ মঞ্জুরের আবেদন জানাচ্ছে। এমন দৃশ্য কোনো প্রেসিডেন্টের মাজারেও আছে বলে কোনোদিন শোনা যায় নি। কিন্তু কিছু ভ- ফকীর মাজারে সিজদা দিয়ে মাজার অঙ্গনে গাঁজার আসর জমিয়ে পবিত্র পরিবেশকে অপবিত্র করছে। এ থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাজত করুন এবং তাঁর দারাজাত বুলন্দ করুন আর তাঁর আরামগাহকে সুশীতল রাখুন। আমীন !

সূত্র :
বৃহত্তর মোমেনশাহী : উলামা ও আকাবির
মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সম্পাদিত
প্রকাশনায় : নাসিরাবাদ ফাউন্ডেশন মোমেনশাহী; প্রকাশকাল : ২০০৫
বাংলাদেশের সুফী-সাধক
গোলাম সাকলায়েন রচিত
প্রকাশনায় : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ইসলাম
আব্দুল মান্নান তালিব রচিত
প্রকাশনায় : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...