আবুল কাসিম আদিল : পুঁজিবাদীদের কাছে বিদ্যাও পণ্য। আরবীতে সুন্দর একটি প্রবাদ আছে, আল-কাতিবু কাল-হিমার— লিপিকার গাধাসদৃশ। অর্থাৎ গাধার পিঠে বিদ্যাপূর্ণ বইয়ের বোঝা আর আলুর বস্তা তুলে দেয়া সমান কথা। এক মণ আলু আর এক মণ বই, গাধার কাছে একই কথা। পূর্বযুগের হস্তলিপিকারের মতো আধুনিক যুগের পুস্তকপ্রকাশক, মুদ্রক, বিক্রেতা, ব্যবসায়ী, এমনকি জ্ঞানী-গুণীদের অবস্থাও গাধার অনুরূপ। তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যবসা— আলু বেচে হোক, বই বেচে হোক, বা জ্ঞান বেচে।
হ্যাঁ, এদেশে বিদ্যার বিকিকিনি হচ্ছে দেদার। বিদ্যা নয় শুধু, বিদ্যাবাহকও বিক্রি হচ্ছে খুব। পত্রিকায়-টেলিভিশনে বিদ্যাবাগীশদের হাট বসে। তারা নিজেরা নিজেদের মগজ-মস্তক খুব সস্তা দামেই বিক্রি করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের কাছে। এবং এসব তারা স্বেচ্ছায়-সানন্দে করছে। এ নিয়ে লাজ-লজ্জা, সংকোচ তাদের মধ্যে মোটেই নেই। বরং এতে তারা মনে হয় গর্বিতই।
এদেশের বিদ্যাবাগীশশ্রেণির মধ্যে বিদ্যার অহঙ্কার ব্যাপক। সাধারণ মানুষ ফসল ফলায়, কারখানায় কাজ করে দেশের চাকা চলমান রাখে। বিদ্যাপূজারীরা সেই সম্পদ ভোগ করে আর উৎপাদকের উপর উৎপীড়ন করে। সাধারণ মানুষের রক্ত পানি করা টাকায় বিদ্যার্জন করে মানুষের শোষণকাণ্ডে বিদ্যা-বুদ্ধি সগর্বে ব্যবহার করে।
এদের বিদ্যা-বুদ্ধি সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসে না। তাদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা সাধারণ্যের উপকারে ব্যয়িত হয় না। হয় না, কারণ এই বিদ্যাবাগীশেরা যাদের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে, তাদের বিদ্যা-বুদ্ধিও জনকল্যাণে ব্যয়িত হতো না। কারণ তারা তো এখানকার মানুষের উপকারের জন্য এদেশে আসে নি। তারা এসেছিল ব্যবসার জন্য, স্রেফ ব্যবসার জন্য। ব্যবসার স্বার্থেই তাদের সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল। তারা ব্যবসা করেছে। এবং তাদের ব্যবসার পক্ষে অনুকূল একটি শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করে গিয়েছে। আজকের শিক্ষিতসমাজ সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্তরপ্রজন্ম। চেহারা-সুরতে পার্থক্য থাকলেও চলনে-বলনে, চিন্তা-ভাবনায় এরাও ইংরেজ। এদের চিন্তার সঙ্গে এদেশের মাটি ও মানুষের কোনোরূপ যোগ নেই। দীর্ঘদিন যাবত এদেশে যে শোষণ, উৎপীড়ন ও অবিচারের ধারা চলছে, এসবে শিক্ষিতজনেরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। এদেশে বড় ধরনের যত দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে, সব শিক্ষিতদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে।
বাস্তবজীবনের সঙ্গে যে বিদ্যার যোগ নেই, মাটি ও মানুষের সঙ্গে যে বিদ্যার সম্পর্ক নেই— সে বিদ্যা ব্যর্থ। ব্যর্থবিদ্যা মানবসমাজের উন্নতির জন্য দরকার নেই। এখানে আমরা মূর্খ মাঝি ও বিদ্যাবোঝাই বাবুমশাইর ঘটনা স্মরণ করতে পারি। সুকুমার রায় পদ্যাকারে যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন। মূর্খ মাঝির হরেক রকম তত্ত্বজ্ঞান নেই বলে বিদ্যাবোঝাই বাবুমশাই আত্মাহঙ্কারে যখন স্ফীত হয়ে মাঝিকে তিরস্কার করে বলছিলেন, ‘তোমার বারো আনাই মিছে’, এর একটু পরেই মশাইয়ের ষোলো আনা মিছে হয়ে যায় সামান্য সাঁতার তথা প্রয়োগিক জ্ঞান না থাকার কারণে। এই ফাঁকির জ্ঞানের কারণেই আজকের কথিত শিক্ষিতশ্রেণির মাটিতে পা পড়ে না। এর বলেই তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না, এটা সবাই জানে। বই কিনে এবং পড়ে যে আউলিয়াও হওয়া যায় না, এটা অনেকেই জানে না। বই পড়েই যে মানুষ ভালোমানুষ হতে পারে না, সে উদাহরণ আমাদের সমাজে বিস্তর। বরং খারাপ মানুষদের অধিকাংশই তথাকথিত শিক্ষিতশ্রেণিভুক্ত।