বুধবার, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সন্ধ্যা ৬:৫৯
Home / পরামর্শ / বানানচর্চা- ০২ : বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম

বানানচর্চা- ০২ : বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম

মুহাম্মদ মহিউদ্দীন কাসেমী :
[বানানপ্রেয়সীদের জন্যে এ নীতিমালাটি দেওয়া হল]

মুখবন্ধ
উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত বাংলা বানানের নিয়ম বলতে বিশেষ কিছু ছিল না। উনিশ শতকের সূচনায় যখন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক পর্ব শুরু হলো, বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের উন্মেষ হলো, তখন মোটামুটি সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন-অনুযায়ী বাংলা বানান নির্ধারিত হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় বহু তৎসম শব্দ থাকলেও অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশী, বিদেশী শব্দের পরিমাণ কম নয়। এছাড়া রয়েছে তৎসম, অতৎসম প্রত্যয়, বিভক্তি, উপসর্গ ইত্যাদি সহযোগে গঠিত নানারকমের মিশ্র শব্দ। তার ফলে বানা নির্ধারিত হলেও বাংলা বানানের সমতাবিধান সম্ভবপর হয়নি। তাছাড়া, বাংলা ভাষা ক্রমাগত সাধুরীতির নির্মোক ত্যাগ করে চলিত রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। তার উপর, অন্য অনেক ভাষার মতো বাংলারও লেখ্যরূপ সম্পূর্ণ ধ্বনিভিত্তিক নয়। তাই বাংলা বানানের অসুবিধাগুলো চলতেই থাকে। এই অসুবিধা ও অসঙ্গতি দূও করার জন্য প্রথমে বিশ শতকের বিশের দশকে বিশ্বভারতী এবং পরে ত্রিশের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রসহ অধিকাংশ পণ্ডিত ও লেখক সমর্থন করেন। এখন পর্যন্ত এই নিয়মই আদর্শ নিয়মরূপে মোটামুটি অনুসৃত হচ্ছে।
তবু বাংলা বানানে সম্পূর্ণ সমতা বা অভিন্নতা যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নয়। বরং কালে কালে বানানের বিশৃঙ্খলা যেন বেড়ে গেছে। কতগুলি শব্দের ক্ষেত্রে দেখা যায় নানাজনে নানারকম বানান লিখছেন। বাংলার মতো উন্নত ভাষার পক্ষে এটা গৌরবের কথা নয়। বানানের এইসব বিভিন্নতা ও বিশৃঙ্খলার কী কী ভাষাতাত্ত্বিক, ধ্বনিতাত্ত্বিক, এমনকি সামাজিক কারণ থাকতে পারে এখানে সে আলোচনার দরকার নেই। তবে অনেক চলমান ও বর্ধিষ্ণু ভাষাতেই দীর্ঘকাল জুড়ে ধীরে ধীরে বানানের কিছু কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। তখন এমক সময়ে বানানের নিয়ম নতুন করে বেঁধে দেওয়ার বা সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়। পূর্বে বলেছি, এ-যাবৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্দেশিত নিয়ম আমরা অনুসরণ করে চলেছি। কিন্তু আধুনিক কালের দাবি অনুযায়ী নানা বানানের যে সব বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি আমরা দেখছি সেই পরিপ্রেক্ষিতে বানানের নিয়মগুলিকে আর একবার সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশেষত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়মে বিকল্প ছিল কিছু বেশি। বিকল্প হয়তো একেবারে পরিহার করা যাবে না, কিন্তু যথাসাধ্য তা কমিয়ে আনা দরকার। এইসব কারণে বাংলা একাডেমী বাংলা বানানের বর্তমান নিয়ম নির্ধারণ করছে।
বাংলাদেশে এ-কাজ হয়তো আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। ১৯৪৭-এর পর সরকার, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও কোনো কোনো ব্যক্তি বাংলা বানান ও লিপির সংস্কারের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা কখনো সফল হয়নি। আমরা এই নিয়মে বানান বা লিপির সংস্কারের প্রয়াস না করে বানানকে নিয়মিত, অভিন্ন ও প্রমিত করার ব্যবস্থা করেছি। এ-কাজ করার দাবি অনেক দিনের। এবং তা যে বাংলাদেশে একেবারে হয়নি সে কথাও ঠিক বলা চলে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে কর্মশালা করে ও বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে বাংলা বানানের নিয়মের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছেন। বোর্ড এই নিয়ম করেছেন প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারের জন্য। সেই নিয়মের খসড়া থেকে আমরা সাহায্য নিয়েছি এবং সেজন্য আমরা বোর্ডের প্রতি কৃতজ্ঞ। বলা বাহুল্য, বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই ক্ষেত্রে যে পথিকৃতের কাজ করেছিলেন তার জন্য সকল বাঙালিই তাঁদেও কাছে কৃতজ্ঞ। এ-ছাড়া বহৃ অভিধান-প্রণেতার সাহায্য আমরা গ্রহণ করেছি। তাঁদের প্রতিও আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
এই নিয়ম সুপারিশ করার জন্য বাংলা একাডেমী নিম্নরূপ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন :
প্রফেসর আনিসুজ্জামান, সভাপতি;
প্রফেসর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সদস্য;
জনাব জামিল চৌধুরী, সদস্য;
অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস, সদস্য; এবং
জনাব বশীর আল্হেলাল, সদস্য-সচিব।
এখন থেকে বাংলা একাডেমী তার সকল কাজ, তার বই ও পত্রপত্রিকায় এই বানান ব্যবহার করবে। ভাষা ও সাহিত্যেও জাতীয় প্রতিষ্ঠানরূপে বাংলা একাডেমী সংশ্লিষ্ট সকলকে-লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং বিশেষভাবে সংবাদপত্রগুলিকেÑ সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে এই বানান ব্যবহারের সুপারিশ ও অনুরোধ করছে।
প্রতিটি নিয়মের সঙ্গে বেশি করে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যাতে নিয়মটি বুঝতে সুবিধা হয়। অদূর ভবিষ্যতে এই নিয়মানুগ, যতদূর সম্ভব বৃহৎ একটি শব্দকোষ সংকলন ও প্রকাশের ইচ্ছা আমাদের রয়েছে।
আর একটি কথা। আমরা আগে ইঙ্গিত করেছি, এটি কোনো বানান-সংস্কারের প্রয়াস নয়। আমরা কেবল বানানের নিয়ম বেঁধে দিয়েছি, বরং বলা যায়, বানানের নিয়মগুলিকে ব্যবহারকারীর সামনে তুলে ধরেছি। এইসব নিয়ম বা এইসব বানানে ব্যাকরণের বিধান লঙ্ঘন করা হয়নি।

তৎসম শব্দ
১. ০১. তৎসমস অর্থাৎ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অবিকৃত সংস্কৃত শব্দের বানান যথাযথ ও অপরিবর্তিত থাকবে। কারণ এইসব শব্দের বানান ও ব্যাকরণগত প্রকরণ ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট রয়েছে।

১. ০২. তবে যে-সব তৎসম শব্দে ই ঈ বা উ ঊ উভয়ই শুদ্ধ সেইসব শব্দে কেবল ই বা উ এবং তার কার চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে। যেমন : কিংবদন্তি, খঞ্জনি, মসি, লহরি, সরণি, সূচিপত্র, উর্ণা, উষা।

১. ০৩. রেফ-এর পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন : অর্চনা, অর্জন, অর্থ, অর্ধ, কর্দম, কর্তন, কর্ম, কার্য, গর্জন, মূর্ছা, কার্তিক, বার্ধক্য, বার্তা, সূর্য।

১. ০৪. সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) লেখা যাবে। যেমন : অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত, শুভংকর, হৃদয়ংগম, সংঘটন। তবে অঙ্ক, অঙ্গ, আকাক্সক্ষা, গঙ্গা, বঙ্গ, লঙ্ঘন, সঙ্গ, সঙ্গী প্রভৃতি সন্ধিবদ্ধ নয় বলে ঙ স্থানে ং হবে না।

অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দ
২. ০১. ই ঈ উ ঊ
সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কার চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে। এমনকি স্ত্রীবাচক ও জাতিবাচক ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। যেমন গাড়ি, চুরি, দাড়ি, বাড়ি, ভারি (অত্যন্ত অর্থে), শাড়ি, তরকারি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, বাঙালি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, সরকারি, মাস্টারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বে-আইনি, ছড়ি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, মামি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, ছুঁড়ি, নিচ, নিচু, ইমান, চুন, পুব, ভুখা, মুলা, পুজো, উনিশ, উনচল্লিশ।
অনুরূপভাবে -আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে। যেমন : খেয়ালি, বর্ণালি, মিতালি, সোনালি, হেঁয়ালি।
তবে কোনো কোনো স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে। যেমন : রানী, পরী, গাভী।
সর্বনাম পদরূপে এবং বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন : কী করছ? কী পড়ো? কী আর বলব? কী জানি? কী যে করি! তোমার কী। এটা কী বই? কী করে যাব? কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে। কী আনন্দ! কী দুরাশা!
অন্য ক্ষেত্রে অব্যয় পদরূপে ই-কার দিয়ে কি শব্দটি লেখা হবে। যেমন : তুমিও কি যাবে? সে কি এসেছিল? কি বাংলা কি ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি পারদর্শী। পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে। যেমন : ছেলেটি, লোকটি, বইটি।

২.০২. ক্ষ
ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত শব্দ খির, খুর ও খেত না লিখে সংস্কৃত মূল অনুসরণে ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত-ই লেখা হবে। তবে অ-তৎসম শব্দ খুদ, খুদে, খুর, খেপা, খিধে ইত্যাদি লেখা হবে।

২.০৩. মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য ন
তৎসম শব্দের বানানে ণ, ন-য়ের নিয়ম ও শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে। এ-ছাড়া তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র কোনো শব্দের বানানে ণত্ব-বিধি মানা হবে না অর্থাৎ ণ ব্যবহার করা হবে না। যেমন : অঘ্রান, ইরান, কান, কোরান, গুনতি, গোনা, ঝরনা, ধরন, পরান, সোনা, হর্ন।
তৎসম শব্দের ট ঠ ড ঢ-য়ের পূর্বে নাসিক্য বর্ণ ণ হয়, যেমন : কণ্টক, লুণ্ঠন, প্রচ-। কিন্তু তৎসম ছাড়া অন্য সকল শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ-য়ের আগেও কেবল ন হবে। ৪.০১ দ্রষ্টব্য।

২.০৪. শ, ষ, স
তৎসম শব্দে শ, ষ, স-য়ের নিয়ম মানতে হবে। এ-ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে সংস্কৃতের ষত্ব-বিধি প্রযোজ্য হবে না।
বিদেশী মূল শব্দে শ, স-য়ের যে প্রতিষঙ্গী বর্ণ বা ধ্বনি রয়েছে বাংলা বানানে তাই ব্যবহার করতে হবে। যেমন : সাল (=বৎসর), সন, হিসাব, শহর, শরবত, শামিয়ানা, শখ, শৌখিন, মসলা, জিনিস, আপস, সাদা, পোশাক, বেহেশ্ত, নাশত্, কিশমিশ, শরম, শয়তান, শার্ট, স্মার্ট,। তবে পুলিশ শব্দটি ব্যতিক্রমরূপে শ দিয়ে লেখা হবে। তৎসম শব্দে ট, ঠ, বর্ণের পূর্বে ষ হয়। যেমন : বৃষ্টি, দৃষ্ট, নিষ্ঠা, পৃষ্ঠা। কিন্তু বিদেশী শব্দে এই ক্ষেত্রে স হবে। যেমন : স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্টুডিয়ো, স্টেশন, স্টোর, স্ট্রিট।
কিন্তু খ্রিষ্ট যেহেতু বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণও হয় তৎসম কৃষ্টি, তুষ্ট, ইত্যাদি শব্দের মতো, তাই ষ্ট দিয়ে খ্রিষ্ট শব্দটি লেখা হবে।
২.০৫. আরবি-ফারসি শব্দে ‘সে’ (ث) , ‘সিন্’ (س) ‘সোয়াদ’ (ص) বর্ণগুলির প্রতিবর্ণরূপে স, এবং ‘শিন্, (ش)-এর প্রতিবর্ণরূপে শ ব্যবহৃত হবে। যেমন : সালাম, তসলিম, ইসলাম, মুসলিম, মুসলমান, সালাত, এশা, শাবান (হিজরি মাস), শাওয়াল (হিজরি মাস), বেহেশত। এই ক্ষেত্রে স-এর পরবির্তে ছ লেখার কিছু প্রবণতা দেখা যায়, তা ঠিক নয়। তবে যেখানে বাংলায় বিদেশী শব্দের বানান সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে স ছ-য়ের রূপ লাভ করেছে সেখানে ছ ব্যবহার করতে হবে। যেমন : পছন্দ, মিছিল, মিছরি, তছনছ।

২.০৬. ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশী শব্দ সাধারণভাবে বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতি-অনুযায়ী লিখতে হবে। যেমন : কাগজ, জাহাজ, হুকুম, হাসপাতাল, টেবিল, পুলিশ, ফিরিস্তি, হাজার, বাজার, জুলুম, জেব্রা।
কিন্তু ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ শব্দে ‘যে’ (ز) . ‘যাল’ (ذ) ‘যোয়াদ’ (ض) ‘যোই’ (ظ) রয়েছে, যার ধ্বনি ইংরেজি ু এর মতো, সেক্ষেত্রে উক্ত আরবি বর্ণগুলির জন্য য ব্যবহৃত হওয়া সঙ্গত। যেমন : আযান, এযিন, ওযু, কাযা, নামায, মুয়ায্যিন, যোহর, রমযান। তবে কেউ ইচ্ছা করলে এই ক্ষেত্রে য-এর পরিবর্তে জ ব্যবহার করতে পারেন। জাদু, জোয়াল, জো, ইত্যাদি শব্দ জ দিয়ে লেখা বাঞ্ছনীয়।

২.০৮. এ, অ্যা
বাংলায় এ বা -েকার দ্বারা অবিকৃত এ এবং বিকৃত বা বাঁকা অ্যা এই উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনি নিষ্পন্ন হয়। তৎসম বা সংস্কৃত ব্যাস, ব্যায়াম, ব্যাহত, ব্যাপ্ত, জ্যামিতি, ইত্যাদি শব্দের বানান অনুরূপভাবে লেখার নিয়ম রয়েছে। অনুরূপ তৎসম এবং বিদেশী শব্দ ছাড়া অন্য সকল বানানে অবিকৃত-বিকৃত নির্বিশেষে এ বা -েকার হবে। যেমন : দেখে, দেখি, যেন, জেনো, কেন, কেনো (ক্রয় করো), গেল, গেলে, গেছে।
বিদেশী শব্দে অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে এ বা -েকার ব্যবহৃত হবে। যেমন : এন্ড (বহফ), নেট, বেড, শেড।
বিদেশী শব্দে বিকৃত বা বাঁকা উচ্চারণে অ্যা বা ্যা ব্যবহৃত হবে। যেমন অ্যান্ড (ধহফ), অ্যাবসার্ড, অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাক, ম্যানেজার, হ্যাট।
তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষভাবে দেশী শব্দ রয়েছে যার ্যা-কারযুক্ত রূপ বহুল-পরিচিত। যেমন : ব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা। এসব শব্দে ্যা অপরিবর্তিত থাকবে।

২.০৯. ও
বাংলা অ-কারের উচ্চারণ বহুক্ষেত্রে ও-কার হয়। এই উচ্চারণকে লিখিত রূপ দেওয়ার জন্য ক্রিয়াপদের বেশ কয়েকটি রূপের এবং কিছু বিশেষণ ও অব্যয় পদের শেষে, কখনো আদিতে অনেকে যথেচ্ছাভাবে ে া -কার ব্যবহার করছেন। যেমন : ছিলো, করলো, বলতো, কোরছ, হোলে, যেনো, কেনো (কীজন্য), ইত্যাদি ও-কারযুক্ত বানান লেখা হচ্ছে। বিশেষ ক্ষেত্রে ছাড়া অনুরূপ ে া -কার ব্যবহার করা হবে না। বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে এমন অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ে া -কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব ঘটতে পারে। যেমন : ধরো, চড়ো, বলো, বোলো, জেনো, কেনো (ক্রয় করো), করানো, খাওয়ানো, শেখানো, করাতো, মতো, বালো, আলো, কালো, হলো।

২.১০. ং , ঙ
তৎসম শব্দে ং এবং ঙ যেখানে যেমন ব্যবহার্য ও ব্যাকরণসম্মত সেইভাবে ব্যবহার করতে হবে। এ-সম্পর্কে পূর্বে ১.০৪ অনুচ্ছেদে কিছু নিয়মের কথা বলা হয়েছে। তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দের বানানের ক্ষেত্রে ওই নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এই ক্ষেত্রে প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে সাধারণভাবে অনুস্বার (ং) ব্যবহৃত হবে। যেমন : রং, সং, পালং, ঢং, রাং, গাং,। তবে শব্দে অব্যয় বা বিভক্তি যুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরচিহ্ন থাকলে ঙ হবে। যেমন : বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের। বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ দু’টি ং দিয়ে লিখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে।

২.১১. রেফ (র্ ) ও দ্বিত্ব
তৎসম শব্দের অনুরূপ বানানের ক্ষেত্রে যেমন পূর্বে বলা হয়েছে, অ-তৎসম সকল শব্দেও রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন : কর্জ, কোর্তা, মর্দ, সর্দার।

২.১২. বিসর্গ
শব্দের শেষে বিসর্গ (ঃ) থাকবে না। যেমন : কার্যত, মূলত, প্রধানত, প্রয়াত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ।
পদমধ্যস্থ বিসর্গ থাকবে। তবে অভিধানসিদ্ধ হলে পদমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জনীয়। যেমন : দুস্থ, নিস্পৃহ।

২.১৩. আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দ
আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে ে া -কার যুক্ত করা হবে। যেমন : করানো, বলানো, খাওয়ানো, পাঠানো, নামানো, শোয়ানো।

২.১৪. বিদেশী শব্দ ও যুক্তবর্ণ
বাংলায় বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণকে বিশ্লিষ্ট করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যুক্তবর্ণের সুবিধা হচ্ছে তা উচ্চারণের দ্বিধা দূর করে। তাই ব্যাপকভাবে বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণ বিশ্লিষ্ট করা অর্থাৎ ভেঙে দেওয়া উচিত নয়।
শব্দের আদিতে তো অনুরূপ বিশ্লেষ সম্ভবই নয়। যেমন : স্টেশন, স্ট্রিট, স্প্রিট, স্প্রিং। তবে কিছু কিছু বিশ্লেষ করা যায়। যেমন : সেপটেম্বর, অকটোবর, মাক্র্স, শেক্সপিয়র, ইস্রাফিল।
২.১৫. হস্-চিহ্ন
হস্চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন : কাত, মদ, চট, ফটফট, কলকল, ঝরঝর, তছনছ, জজ, টন, হুক, চেক, ডিশ, করলেন, বললেন, শখ, টাক, টক।
তবে যদি ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকে তাহলে হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন : উহ্, যাহ্।
যদি অর্থের বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে তাহলেও তুচ্ছ অনুজ্ঞায় হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন : র্ক, র্ধ, র্ম, বল্।

২.১৬. ঊর্ধ্ব-কমা
ঊর্ধ্ব-কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন : করল (করিল), ধরত, বলে (=বলিয়া), হয়ে, দু জন, চার শ, চাল (=চাউল), আল (=আইল)।

বিবিধ
৩.০১. যুক্ত-ব্যঞ্জনবর্ণগুলি যতদূর সম্ভব স্বচ্ছ করতে হবে অর্থাৎ পুরাতন রূপ বাদ দিয়ে এগুলির স্পষ্ট রূপ দিতে হবে। তার জন্য কতকগুলি স্বরচিহ্নকে বর্ণের নিচে বসাতে হবে। যেমন : গু, রু, শু, দ্রু, রূ, ভ্রু, হৃ, ত্র, ভ্র।
তবে ক্ষ, জ্ঞ, ঞ্জ, ষ্ণ, হ্ম, ভ্র, হ্নÑ এইসব ক্ষেত্রে পরিচিত যুক্ত-রূপ অপরিবর্তিত থাকবে। কেননা তা বিশ্লিষ্ট করলে উচ্চারণবিকৃতির সম্ভাবনা থাকে।

৩.০২. সমাসবদ্ধ পদগুলি একসঙ্গে লিখতে হবে, মাঝখানে ফাঁক রাখা চলবে না। যেমন : সংবাদপত্র, অনাস্বাদিতপূর্ব, পূর্বপরিচিত, রবিবার, মঙ্গলবার, স্বভাবগতভাবে, লক্ষ্যভ্রষ্ট, বারবার, বিষাদম-িত, সমস্যাপূর্ণ, অদৃষ্টপূর্ব, দৃঢ়সঙ্কল্প, সংযতবাক, নেশাগ্রস্ত, পিতাপুত্র।
বিশেষ প্রয়োজনে সমাসবদ্ধ পদটিকে একটি, কখনো একটির বেশি হাইফেন (-) দিয়ে যুক্ত করা যায়। যেমন : মা-মেয়ে, মা-ছেলে, বেটা-বেটি, বাপ-বেটা, ভবিষ্য-তহবিল, সর্ব-অঙ্গ, বে-সামরিক, স্থল-জল-আকাশ-যুদ্ধ, কিছু-না-কিছু।

৩.০৩. বিশেষণ পদ সাধারণভাবে পরবর্তী পদের সঙ্গে যুক্ত হবে না। যেমন : সুনীল আকাশ, স্তব্ধ মধ্যাহ্ন, সুগন্ধ ফুল, লাল গোলাপ, ভালো দিন, সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু যদি সমাসবদ্ধ পদ অন্য বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদের গুণ বর্ণনা করে তাহলে স্বভাবতই সেউ যুক্তপদ একসঙ্গে লিখতে হবে। যেমন : কতদূর যাবে, একজন অতিথি, তিনহাজার টাকা, বেশির-ভাগ ছেলে, শ্যামলা-বরন মেয়ে। তবে কোথাও কোথাও সংখ্যাবাচক শব্দ একসঙ্গে লেখা যাবে। যেমন : দুজনা।

৩.০৪. নাই, নেই, না, নিÑ এই নঞর্থক অব্যয় পদগুলি শব্দের শেষে যুক্ত না হয়ে পৃথক থাকবে। যেমন : বলে নাই, যাই নি, পাব না, তার মা নাই, আমার ভয় নেই।
তবে শব্দের পূর্বে নঞর্থক উপসর্গরূপে ‘না’ উত্তরপদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যেমন : নারাজ, নাবালক, নাহক।
অর্থ পরিস্ফুট করার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভূত হলে না-এর পর হাইফেন ব্যবহার করা যায়। যেমন : না-বলা বাণী, না-শোনা কথা, না-গোনা পাখি।
৩.০৫. উদ্ধৃতি মূলে যেমন আছে ঠিক তেমনি লিখতে হবে। কোন পুরাতন রচনায় যদি বানান বর্তমান নিয়মের অনুরূপ না হয়, উক্ত রচনার বানানই যথাযথভাবে উদ্ধৃত করতে হবে। যদি উদ্ধৃত রচনায় বানানের ভুল বা মুদ্রণের ত্রুটি থাকে, ভুলই উদ্ধৃত করে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে শুদ্ধ বানানটির উল্লেখ করতে হবে। এক বা দুই ঊর্ধ্ব কমার দ্বারা উদ্ধৃত অংশকে চিহ্নিত করতে হবে। তবে উদ্ধৃত অংশকে যদি ইনসেট করা হয় তাহলে ঊর্ধ্ব-কমার চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে না। তাছাড়া কবিতা যদি মূল চরণ-বিন্যাস অনুযায়ী উদ্ধৃত হয় এবং কবির নামের উল্লেখ থাকে সেক্ষত্রেও উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেওয়ার কোনো দরকার নেই। ইনসেট না হলে গদ্যের উদ্ধৃতিতে প্রথমে ও শেষে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেওয়া ছাড়াও প্রত্যেক অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দিতে হবে। প্রথমে, মধ্যে বা শেষে উদ্ধৃত রচনার কোনো অংশ যদি বাদ দেওয়া হয় অর্থাৎ উদ্ধৃত করা না হয়, বাদ দেওয়ার স্থানগুলিকে তিনটি বিন্দু বা ডট্ (অবলোপ চিহ্ন) দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে। গোটা অনুচ্ছেদ, স্তবক বা একাধিক ছত্রের কোনো বৃহৎ অংশ বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি তারকার দ্বারা একটি ছত্র রচনা করে ফাঁকগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে।
কোনো পুরাতন অভিযোজিত বা সংক্ষেপিত পাঠে অবশ্য পুরাতন বানানকে বর্তমান নিয়ম-অনুযায়ী পরিবর্তিত করা যেতে পারে।

৪.০১. ণত্ব-বিধি সম্পর্কে দুই মত
অ-তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেন নি। একটি মতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দে যুক্তাক্ষরে ণ্ট ণ্ঠ – ণ্ঢ হবে। যথা : ঘণ্টা, লণ্ঠন, গু-া। অন্য মতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট ন্ঠ ন্ড ব্যবহৃত হবে। যথা : ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড।

চলতি ভাষায় ক্রিয়াপদের কতকগুলি রূপ

হ-ধাতু : হয়, হন, হও, হস, হই। হচ্ছে। হয়েছে। হোক, হোন, হও, হ। হলো, হলে, হলাম। হতো। হচ্ছিল। হয়েছিল। হবো, হবে। হয়ো, হস। হতে, হয়ে, হলে হবার (হওয়ার), হওয়া।
খা-ধাতু : খায়, খাও, খান, খাস, খাই। খাচ্ছে। খেয়েছে। খাক, খান, খাও, খা। খেল, খেলে, খেলাম। খেত, খাচ্ছিল। খেয়েছিল। খাব, খাবে। খেয়ো, খাস, খেতে, খেয়ে, খেলে, খাবার (খাওয়ার), খাওয়া।
দি-ধাতু : দেয়, দেন, দাও, দিস, দিই। দিচ্ছে। দিয়েছে। দিক, দিন, দাও, দে। দিল, দিলে, দিলাম। দিত। দিচ্ছিল। দিয়েছিল। দেবো, দেবে। দিও (দিয়ো), দিস। দিতে, দিয়ে, দিলে, দেবার (দেওয়ার), দেওয়া।
নি-ধাতু : নেয়, নেন, নাও, নিস, নিই। নিচ্ছে। নিয়েছে। নিক, নিন, নাও, নে। নিল, নিলে, নিলাম। নিত। নিচ্ছিল। নিয়েছিল। নেব, নেবে। নিও (নিয়ো), নিস। নিতে, নিয়ে, নিলে, নেবার ( নেওয়ার), নেওয়া।
শু-ধাতু : শোয়, শোন, শোও, শুস, শুই। শুচ্ছে। শুয়েছে। শুক, শোন, শোও, শো। শুল, শুলে, শোবার ( শোওয়ার), শোওয়া।
র্ক-ধাতু : করে, করেন, করো, করিস, করি। করছে। করেছে। করুক, করুন, করো, কর। করল, করলে, করলাম। করত। করছিল। করেছিল। করব, করবে। কোরো, করিস। করতে, করে, করলে, করবার (করার), করা।
কাট্-ধাতু : কাটে, কাটেন, কাটো, কাটিস, কাটি। কাটছে। কেটেছে। কাটুক, কাটুন, কাটো, কাট। কাটল, কাটলে, কাটলাম। কাটত। কাটছিল। কেটেছিল। কাটব, কাটবে। কেটো, কাটিস। কাটতে, কেটে, কাটলে, কাটবার (কাটার), কাটা।
লিখ-ধাতু : লেখে, লেখেন, লেখো, লিখিস, লিখি। লিখছে। লিখেছে। লিখুক, লিখুন, লেখো, লেখ। লিখল, লিখলে, লিখলাম। লিখত। লিখছিল। লিখেছিল। লিখব, লিখবে। লিখো, লিখিস। লিখতে, লিখে, লিখলে, লেখবার (লেখার), লেখা।
শিখ্-ধাতু : শেখে, শেখেন, শেখো, শিখিস, শিখি। শিখছে। শিখেছে। শিখুক, শিখুন, শেখো, শেখ। শিখল, শিখলে, শিখলাম। শিখত। শিখছিল। শিখেছিল। শিখব, শিখবে। শিখো, শিখিস। শিখতে, শিখে, শিখলে, শেখবার (শেখার), শেখা।
উঠ্-ধাতু : ওঠে, ওঠেন, ওঠো, উঠিস, উঠি। উঠছে। উঠেছে। উঠুক, উঠুন, ওঠো।, ওঠ। উঠল, উঠলে, উঠলাম। উঠত। উঠছিল। উঠেছিল। উঠব, উঠবে। ওঠো, উঠিস। উঠতে, উঠে, উঠলে, ওঠবার (ওঠার), ওঠা।

আরও পড়ুন : বানান চর্চা : ১

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমীর নিউ ভার্সন এবং রাষ্ট্র থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন!

সৈয়দ শামছুল হুদা: বাংলাদেশের একটি আলোচিত অন্যতম রাজনৈতিক দলের নাম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সরকারে থাকা ...