বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১০:৩২
Home / আমল / ক্ষমার মহানুভবতা

ক্ষমার মহানুভবতা

silent-duaড. মুজাম্মিল এইচ সিদ্দিকী : আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধিমত্তা দান করেছেন। আর বুদ্ধিমত্তার দাবি হচ্ছে দায়িত্বশীলতা। একজন মানুষের বুদ্ধিমত্তা যত বেশি থাকবে, তিনি তত বেশি দায়িত্বশীল। তিনি নারী বা পুরুষ, যা-ই হোন না কেন।

বুদ্ধিমত্তা না থাকলে দায়িত্ব থাকে না। ছোট শিশুদের দায়দায়িত্ব নেই। কারণ তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটেনি। উন্মাদকে কোনো কিছুর জন্য দায়ী করা যায় না। কেননা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য হারিয়ে গেছে। যা হোক, আমাদের মানবসত্তার একটি অংশ হলো আমরা ভুল করে থাকি। মাঝে মধ্যে আমরা অনিচ্ছাকৃত ভুল করি। তবে কখনো কখনো আমরা জেনেশুনে এবং ইচ্ছা করেই পাপকাজ করি এবং অন্যদের ব্যাপারে ভুল করে থাকি। একটা কথা আছে, তা হলো, ভুল করা মানবিক ব্যাপার এবং ক্ষমা করা আল্লাহ-প্রদত্ত গুণ। এই কথাটির উভয় অংশই অত্যন্ত সত্য। মানুষ হিসেবে আমরা দায়িত্বশীল ঠিকই; তবে আমাদের ভুলত্রুটি হয়ে থাকে। তাই আমরা সর্বদাই আল্লাহতায়ালার ক্ষমার প্রত্যাশী। ইসলাম দুই ধরনের ক্ষমার কথা বলে; ক. আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং খ. মানুষের করা ক্ষমা। দুটোই আমাদের দরকার। এর কারণ হলো আমরা আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেমন ভুল করে বসি, তেমনি ভুল হয় মানুষ হিসেবে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বেলায়।

আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালার অনেক নামের উল্লেখ আছে। এগুলোকে বলা হয় ‘আসমাউল হুসনা’ বা সবচেয়ে সুন্দর নাম। নামগুলো প্রকাশ করছে আল্লাহ তায়ালার বিভিন্ন ও বহুমুখী গুণ ও বৈশিষ্ট্য। তাঁর, কয়েকটি নাম করুণা ও ক্ষমার সাথে সংশ্লিষ্ট। এ ধরনের নামগুলোর ওপর আলোকপাত করা যাক।

১. আল গফুর (সর্বাধিক ক্ষমাশীল)। আল কুরআনে নামটি এসেছে ৭০ বারেরও বেশি। এই নামের একই উৎস থেকে আরো কিছু নাম এসেছে আল্লাহ তায়ালার। যেমন, গাফির ও গফফার। আরবি ভাষার ‘গাফারা’ শব্দটির অর্থ আবৃত করা, কিংবা গোপন করা। এর থেকে এসেছে তাৎপর্যবাচক কয়েকটি শব্দ। যেমন ক্ষমা করা, অব্যাহতি প্রদান, নিষ্কৃতি প্রভৃতি। আল্লাহ এ সব কিছু করে থাকেন। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ শিরক ক্ষমা করেন না (তওবা না করলে), তবে তিনি যার ব্যাপারে ইচ্ছা করেন, তার অন্য সব গুনাহ বা পাপ মাফ করে দিতে পারেন’ (সূরা আন নিসা, আয়াত-১১৬)। আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা লাভের উদ্দেশ্যে আমাদের উচিত তাঁর দিকে রুজু হওয়া।

২. আল আফ্উ। এটা ক্ষমার আরেক অংশের সাথে সম্পর্কিত। কুরআনে নামটির উল্লেখ রয়েছে পাঁচবার। শাব্দিকভাবে ‘আফ্উ’ মানে, উপশম, পুনঃস্থাপন, অব্যাহতিদান, মুক্ত করা। আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শব্দটির অর্থ হলো, আমাদের পাপ ও ভ্রান্তির কারণে যে শাস্তিপ্রাপ্য, এর বোঝা থেকে আমাদের মুক্তি দেয়া; অথবা পাপ ও ভুলের মাধ্যমে আমরা নিজেদের যে মর্যাদা হানি করেছি, এর পুনঃপ্রতিষ্ঠা। আল কুরআনে কোনো কোনো সময়ে আফউ ও গফুর উভয় নামই এসেছে একসাথে।

৩. আল তাওয়াব (তওবা বা অনুশোচনা গ্রহণকারী)। আল্লাহর এই নাম কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে ১১ বার। আল্লাহ তায়ালা তাদের তওবা কবুল করে নেন, যারা আন্তরিকতার সাথে তওবা করে এবং প্রত্যাবর্তন করে তাঁর দিকে। ‘তাওয়াব’ শব্দটি দ্বারা বোঝায় ‘প্রায়শ প্রত্যাবর্তনকারী’। এর তাৎপর্য হলো আল্লাহ বারবার তওবা কবুল করে থাকেন। তারপর আবার আমরা গুনাহ করি, ভুল করি। তবুও আমরা তওবা করলে তিনি দয়াবশত তা গ্রহণ করে থাকেন। এভাবে আমাদের আরো একবার সুযোগ দেন সত্যের পথে ফিরে আসার।
৪. আল হালিম (ধৈর্যশীল)। কুরআন শরিফে এই নাম ১৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে। এই নামের তাৎপর্য হলো, আল্লাহ তায়ালা বিচার করে ফেলার জন্য তাড়াহুড়া করেন না। তিনি বান্দাদের সময় দেন। তিনি পরিচয় দেন ধৈর্যশীলতার, যাতে তাঁর বান্দারা তাঁর দিকে ফিরে আসে।

৫. আল রাহমান ও আল রাহিম (সর্বাধিক করুণাময় ও দয়ালু)। কুরআনে আল্লাহতায়ালার এই দু’টি নাম সবচেয়ে বেশি এসেছে। আল রাহমান এসেছে ৫৭ বার। আর আল রাহিম এর দ্বিগুণ ১১৫ বার। আল রহমান ইঙ্গিত দেয়, আল্লাহর করুণা বিপুল। আল রাহিম বোঝায়, আল্লাহ তায়ালা সব সময়ই করুণাময় বা দয়ালু। তিনি ভালোবাসা ও করুণায় পরিপূর্ণ।

আল কুরআন শেখায় যে, আল্লাহ হলেন বিচারক। তিনি শাস্তিও দিয়ে থাকেন। আল কুরআন অনুসারে আল্লাহর ন্যায়বিচার হচ্ছে, তিনি কাউকে অহেতুক বা অতিরিক্ত শাস্তি দেন না বা দেবেন না। তিনি কারো ভালো কাজকে উপেক্ষা করবেন না। তবে কোনো পাপীকে ক্ষমা করার ইচ্ছা করলে তাঁর এটা করার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। আল্লাহ তায়ালার করুণা অপরিসীম এবং তাঁর ভালোবাসারও নেই সীমা-পরিসীমা।

আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা, করুণা ও ক্ষমা সম্পর্কে কুরআনের বহু আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনেক হাদিস রয়েছে। রাসূল সা: যেসব মুনাজাত শিখিয়েছেন, তার একটিতে তিনি বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি সবচেয়ে বেশি ক্ষমাশীল; আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করুন’ (আল তিরমিযি ও ইবন মাজাহ)। আল্লাহর করুণা ও ক্ষমা আমাদের প্রয়োজন সব সময়ই। কখনো এই ধারণা করা ভুল যে, আল্লাহর ক্ষমা ব্যতিরেকেই আখেরাতে নাজাত বা মুক্তি লাভ করা সম্ভব।

আল্লাহ তায়ালার করুণা ও ক্ষমায় আস্থা রাখার বিষয়টি অতিশয় গুরুত্ববহ। তেমনি, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ক্ষমাশীলতার ভিত্তিতে গড়ে তোলাও প্রয়োজন। যারা আমাদের প্রতি অন্যায় করে, তাদের আমরা ক্ষমা না করা পর্যন্ত আমরা আল্লাহর তরফ থেকে ক্ষমা লাভের প্রত্যাশা করতে পারি না। পরস্পরকে ক্ষমা করে দেয়া, এমনকি শত্রুকে পর্যন্ত ক্ষমা করা হলো ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলোর একটি। আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের অভিহিত করেছেন এভাবে ‘যারা বড় বড় পাপ কাজ ও অশ্লীলতা পরিহার করে চলে এবং যখন তারা ক্রুদ্ধ হয়, তখন ক্ষমা করে দেয়’ (সূরা আশ শূরা, আয়াত ৩৭)।

একই সূরায় আল্লাহ বলছেন, ‘মন্দ কাজের পুরস্কার মন্দই; তবে যে কেউ ক্ষমা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তার পুরস্কার আল্লাহর হাতে’ (সূরা আশ শূরা, আয়াত-৪০)। অন্য এক জায়গায় আল-কুরআন বলছে, ‘যদি তোমরা প্রতিশোধ নাও, তবে অতটুকু প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ কষ্ট তোমাদের দেয়া হয়েছে। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, তা হলে এটা ধৈর্যধারণকারীদের জন্য উত্তম’ (সূরা নাহল, আয়াত ১২৬-১২৭)।

একটি সুবিখ্যাত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, আল্লাহ তাঁকে ন’টি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। এর একটি হচ্ছে, ‘তাদের ক্ষমা করা যারা আমার প্রতি অন্যায় করে।’

রাসূলে করিম সা: ছিলেন সর্বাধিক ক্ষমাশীল ব্যক্তি। তিনি তাঁর দুশমনদের ক্ষমা করে দিতে সদা প্রস্তুত ছিলেন। যখন তিনি তায়েফ গিয়েছিলেন আল্লাহ তায়ালার বাণী প্রচারের জন্য, সেখানকার মানুষেরা তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করেছিল। তারা তাঁর ওপর পাথর নিক্ষেপ করেছিল। লাঞ্ছিত ও আহত অবস্থায় তিনি সে শহর ছেড়ে এসেছিলেন। যখন তিনি আশ্রয় নিলেন একটি গাছের নিচে, আল্লাহর ফেরেশতা এসে হাজির হলেন এবং তাঁকে বললেন, তায়েফের জনগণের ওপর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং আল্লাহ তাকে পাঠিয়েছেন ওদের ধ্বংস করার জন্য। কারণ তারা আল্লাহতায়ালার প্রিয় নবী সা:-এর সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। তায়েফবাসীকে রক্ষা করার জন্য নবীজী সা: আল্লাহর কাছে মুনাজাত করলেন। কারণ ওরা যা করেছে, এটা তাদের অজ্ঞতার ফল। রাসূল সা: বললেন, ‘হে আল্লাহ, এই লোকগুলোকে সুপথ দেখাও; কারণ তারা জানত না যে, তারা কী করছিল’ (আল বুখারি)।

যখন রাসূলুল্লাহ সা: মক্কায় প্রবেশ করলেন বিজয়ের পর, তাঁর সামনে ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুদের কয়েকজন। তারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে বহু বছর ধরে; তাঁর অনুসারীদের নির্যাতন করেছে এবং তাঁদের অনেককে করেছে হত্যা। এসব অপরাধের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা করার পুরো ক্ষমতাই তাঁর ছিল। বর্ণিত আছে, রাসূল সা: ওদের বললেন, ‘এখন তোমাদের ব্যাপারে আমি কী করব বলে তোমরা মনে করো?’ তারা প্রতিশোধ ছাড়া আর কিছু আশা করছিল না এবং এ কারণে করুণা ভিক্ষা করল। রাসূল সা: বললেন, ‘আজ আমি তোমাদের সেটাই বলব, যা ইউসুফ আ: তাঁর ভাইদের বলেছিলেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনব না। যাও, তোমাদের সবাই মুক্ত’ (আল আলবানী)।

অল্প সময় পরই তাদের সবাই এসে রাসূল সা:-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করল। তিনি এমনকি হিন্দাকেও মাফ করে দিলেন, যে তাঁর পিতৃব্য, হজরত হামযা রা:-এর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। তাঁকে হত্যার পর এই মহিলা তাঁর দেহকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল, আর চিবিয়েছিল হামযা রা:-এর কলিজা। যখন সে ইসলাম গ্রহণ করে, রাসূল সা: তাকেও ক্ষমা করেছিলেন।

ক্ষমা করার একটি স্মরণীয় ঘটনার উল্লেখ আছে আল কুরআনে। এটা আয়েশা রা:-এর ওপর অপবাদের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা সম্পর্কিত। মদিনার কিছু মুনাফিক তাঁর নামে অপবাদ দিয়েছিল। তারা প্রয়াস পেয়েছিল তাঁর মহান চরিত্র কলঙ্কিত করার। ওদের একজনের নাম মিসতাহ। সে ছিল হজরত আয়েশা রা:-এর পিতা, হজরত আবু বকর রা:-এর চাচাতো ভাই। এই তরুণকে আবু বকর রা: আর্থিকভাবে সাহায্য করতেন। কিন্তু মিসতাহ তাঁর কন্যার নামে অপবাদ দেয়ার কারণে তিনি ওয়াদা করলেন যে, তাকে আর সাহায্য দেবেন না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আবু বকর রা:-কে এবং তাঁর মাধ্যমে সব ঈমানদারকে মনে করিয়ে দিলেন, ‘তোমাদের মাঝে যারা উচ্চমর্যাদা আর আর্থিক প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এ মর্মে কসম না করে যে, তারা আত্মীয়স্বজন, অভাবগ্রস্ত এবং আল্লাহর রাস্তায় হিজরতকারীদের কোনো সাহায্য করবে না। তাদের ক্ষমা করা এবং দোষত্রুটি উপেক্ষা করা উচিত। তোমরা কি কামনা করো না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেন? আল্লাহ সর্বদা ক্ষমাশীল, পরম করুণাময় (সূরা আন নূর, আয়াত-২২)।

হজরত আবু বকর রা: তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এবং বললেন, ‘হ্যাঁ, আসলেই আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’ তিনি চাচাতো ভাই মিসতাহকে সাহায্য করা শুধু অব্যাহতই রাখেননি, এর পরিমাণও বাড়িয়েছিলেন।

ইসলাম ন্যায়বিচার এবং অন্যায়কারীদের শাস্তিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে একই সমান গুরুত্বারোপ করে ক্ষমা, দয়া ও ভালোবাসার ওপর। সামাজিক শৃঙ্খলার স্বার্থে দরকার সুবিচার, আইন এবং আরো কিছু। কিন্তু ক্ষতির উপশম এবং মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন ক্ষমার।

অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আমাদের নিজেদের পাপ ও ভুলত্রুটির ক্ষমার জন্য আমরা যেমন আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা প্রত্যাশা করি, তেমনি যারা আমাদের প্রতি অন্যায় করে থাকে, তাদের ক্ষমা করার অভ্যাস নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে অবশ্যই।

ভাষান্তর : মোহাম্মদ আবু জাফর

সৌজন্যে : অন্যদিগন্ত

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

আধ্যাত্মিকতা

ডক্টর আব্দুস সালাম আজাদী:: আধ্যাত্মিকতা **************** রুহানিয়্যাত বা আধ্যাত্মিকতা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মূল ...