লিখেছেনঃ নুরুল কবির, সম্পাদক নিউ এইজ
প্রথম পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন
সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাকে ভাগ করার এমন ক্যাম্পেইনের মধ্যেও বেঙল মুসলিম লীগ এবং বেঙল কংগ্রেসের কিছু সংখ্যক নেতা বিভাজন ঠেকিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের বাইরে এটিকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন। বাঙলার খ্যাতিমান নেতারা ছিলেন এই তালিকায়। তাদের মধ্যে বেঙল মুসলিম লীগের সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি আবুল হাশিম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর বেঙল কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বোস ও বাঙলার প্রাদেশিক আইনসভায় কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা কিরণ রায় ছিলেন অন্যতম।
১৯৪৬ সালের অক্টোবরে আবুল হাশিম শরৎ বোসের সাথে ভারত ভাগ এবং বাঙলাকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গঠনের বিষয়ে আলাপ করতে শরতের বাসায় এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে শরৎ এই প্রস্তাবে সমর্থন দেন। এরপর সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (আইএনএ) বার্ষিক ভোজসভায় এই সংগঠনের নেতাদেরও সমর্থন আবুল হাশিম পেয়েছিলেন [আবুল হাশিম, উপরে উল্লিখিত, পৃষ্ঠা ১৫২]। হাশিম তার স্মতিচারণে লিখে গেছেন যে, তিনি এরপরই আইএনএ’র ভোজসভায় অংশ নিয়েছিলেন এবং সেখানে দলটির নেতাদের অকুণ্ঠ সমর্থনও পেয়েছিলেন। এরপর থেকেই নিজেদের দাবি আদায়ে একসাথে কাজ শুরু করেন। এরপর ১৯৪৭ এর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এক বৈঠকে পূর্বভারতের বিহারের পুর্নিয়া থেকে আসাম পর্যন্ত এলাকার বাংলা ভাষাভাসী জনগোষ্ঠিকে অন্তর্ভূক্ত করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলা গঠনে বিষয়ে আবুল হাশিম এবং শরৎ বোস আলোচনা করেন [মোহাম্মদ এইচআর তালুদকার, পূর্বেল্লেখিত, পৃষ্ঠা ২৮-২৯]।
একই সময়ে বাঙলার সাবেক মূখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী বাঙলা ভাগের বিরুদ্ধে দাঁড়ান এবং স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ বাঙলার পক্ষে অবস্থান নেয়াদের সাথে যোগ দেন। তিনি ১৯৪৭ এর ২৬ এপ্রিল মাউন্টব্যাটেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের বৈঠকে সোহরাওয়ার্দী ভাইসরয়কে বলেন, যথেষ্ট সময় দেয়া হলে এবং বাঙলাকে অবিভাজিত রাখা হলে তিনি এটিকে (বাঙলা) পাকিস্তানের সাথে যোগ না দেয়ার ব্যাপারে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে রাজি করার চেষ্টা করবেন [হারুন-উর-রশীদ, পূবোল্লিখিত, পৃষ্ঠা ২৭২]।বিশেষ করে, কলকাতাকে পশ্চিমবঙ্গের সাথে রেখে বাঙলা ভাগের যে পরিকল্পনা মাউন্টব্যাটেন করেছিলেন তা বাঙলার মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যান করার পর জিন্নাহ স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাঙলা গঠনের জন্য কাজ করতে সোহরাওয়ার্দীকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন [মোহাম্মদ এইচআর তালুকদার, পূর্বোল্লিখিত, পৃষ্ঠা ২৮]
মাউন্টব্যাটেনের সাথে সাক্ষাতের পরদিন ২৭ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী দিল্লীতে একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম ও অবিভাজিত বাঙলা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি এও বলেন যে, হিন্দুমহাসভা এবং কংগ্রেসের সমর্থনে বাঙলা ভাগের যে দাবি তোলা হচ্ছে তা অদূরদর্শী এবং ‘অধৈর্য প্রসূত হতাশা’র বহিঃপ্রকাশ। অধ্যাপক হারুন-উর-রশীদ দিল্লীতে সোহরাওয়ার্দীর ওই বক্তব্যকে ‘স্বাধীন অবিভক্ত বাঙলা’ আন্দোলনের ‘আনুষ্ঠানিক যাত্রা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন [হারুন-উর-রশীদ, পূর্বোল্লেখিত, পৃষ্ঠা ২৬১]। এর আগে ১৯৪৭ সালের ২১ এপ্রিল খ্যাতিমান বাঙালী নিন্মবর্ণ নেতা এবং তৎকালীন ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী জগেন্দ্রনাথ মন্ডল প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে জানান, বাঙলার নিন্মবর্ণ হিন্দুরা বাঙলা ভাগের প্রস্তাবের বিরোধী। [পূর্বোল্লেখিত, পৃষ্ঠা ২৬০]
দিল্লীতে সংবাদ সম্মেলন করে ওই দিনই সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় ফিরেন এবং পরদিন ২৮ এপ্রিল মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম, খাজা নাজিমুদ্দীন এবং ফজলুর রহমানকে নিয়ে শরৎ বোসের সাথে সাক্ষাৎ করে স্বাধীন ও অভিবিক্ত বাঙলার দাবি আদায়ে করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন। এরপরই বেঙল মুসলিম লীগ নুরুল আমীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতার কমিটি গঠন করে যার অন্য সদস্যরা হলেন, সোহরাওয়ার্দী, হাবিবুল্লাহ বাহার, হামিদুল হক চৌধুরী এবং ফজলুর রহমান। এ কমিটিকে হিন্দু নেতৃবৃন্দ যেমন, বেঙল কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ, কিরণ শংকর রায় এবং শরৎ বোসের সাথে সমঝোতার দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৪৭ এর ১২ মে আবুল হাশিম এবং শরৎ বোস অবিভক্ত বাঙলার দাবি নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সাথে দেখা করে তার আশীর্বাদ নেন [মোহাম্মদ এইচআর তালুকদার, পূর্বোল্লেখিত, পৃষ্ঠা ২৯]।
কিন্তু পরদিন ১৩ মে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি জেবি কৃপালিনী বাঙলা ঐক্য রক্ষার আবেদনকে নিঃশর্তভাবে উড়িয়ে দেন। আশরাফুদ্দীন চৌধুরী নামে একজন বর্ষীয়ান মুসলিম জাতীয়তাবাদী এবং কৃষকনেতার আবেদনের জবাবে কৃপালিনী লিখেন, কংগ্রেস সর্বশক্তি দিয়ে যা চায় তা হচ্ছে পাকিস্তান এবং লীগের (মুসলিম লীগ) অধিকার থেকে যতটুকু পারা যায় এলাকা উদ্ধার করা। এই দল (কংগ্রেস) চায় একটি স্বাধীন ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে যতটুকু পারা যায় এলাকা রক্ষা করা। ফলে আমরা দাবি জানাচ্ছি যেন বাঙলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করে এলাকাগুলোকে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে চিহ্নিত করে দেয়া হয়। [সুজাতা বসু, অ্যাগ্রারিয়ান বেঙল: ইকোনোমি, সোশ্যাল স্ট্রাকচার এন্ড পলিটিক্স: ১৯১৯-১৯৪৭, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, প্রথম ভারতীয় সংস্করণ, হায়দরাবাদ, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ২৩০-২৩১]
তারপরও বাঙলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যৌথ কমিটির সদস্যরা ২০ মে স্বাধীন অবিভক্ত বাঙলার পক্ষে একটি অস্থায়ী আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। [পূর্বোল্লেখিত] চুক্তির উল্লেখযোগ্য পয়েন্টগুলোর মধ্যে ছিল, (১) বাঙলার মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকবে কিন্তু হিন্দু মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে বেঙল কংগ্রেসের মনোনীত নতুন সদস্যদেরকে দ্রুত নিয়োগ দেয়া হবে। (২) বাঙলা পাকিস্তান বা ভারত কারো সাথে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকবে। বাঙলা পাকিস্তানে নাকি ভারতে যোগ দেবে, না স্বাধীন থাকবে সে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে আইনসভায় (বাঙলার), যেটি জনগনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত। (৩) মুসলিম, হিন্দু, নিন্মবর্ণের মানুষসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের আইনসভার আসন নির্ধারিত হবে জনসংখ্যার হারের ভিত্তিতে। (৪) পরিষদের মন্ত্রীদের মনোনয়নেও সাম্য বজায় রাখা হবে। [১৫৫ নং ফুটনোট দ্রষ্টব্য, মোহাম্মদ এইচআর তালুকদার, পূর্বোল্লিখিত, পৃষ্ঠা ২৩৫]
এসময় এই উদ্যোগকে ভেস্তে দিতে কংগ্রেসের একটি অংশ মিথ্যা প্রচারণা শুরু করে যে, বাঙলা ভাগের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আইনসভার সদস্যদের মাঝে স্থানীয় মুসলিম লীগ টাকা ঢালছে। এর মাধ্যমে নাকি মুসলিম লীগ হিন্দু এবং নিন্মবর্ণের জনগোষ্ঠির মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে। কংগ্রেসের এই অংশটি এমন প্রচারণার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতাদেরকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙলা ভাগের পক্ষে প্রভাবিত করেছিল।
প্যাটেল সরাসরি স্বাধীন ও অবিভক্ত বাঙলার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং এই উদ্যোগকে মুসলমানদের ‘ফাঁদ’ হিসেবে অভিহিত করেন। একই সাথে তিনি বাঙলার কংগ্রেস নেতাদেরকে এই ‘ফাঁদে’ পা না দিতে হুশিয়ার করেন। বাঙলার মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের কিছু নেতাদের মধ্যে অবিভক্ত বাঙলার পক্ষে চুক্তি হওয়ার পরদিন ২১ মে শংকর রায়কে সতর্ক করে লেখা এক চিঠিতে প্যাটেল লিখেছেন, ‘কংগ্রেসের সব সদস্যের জন্য নিজেদের পছন্দ অপছন্দকে উপেক্ষা করে দলের অফিসিয়াল নীতির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকা বাধ্যতামূলক। চিঠিতে প্যাটেল এও উল্লেখ করেন যে, একজন নিয়ম মেনে চলা কংগ্রেসম্যান হিসেবে শংকর রায় এই উপদেশ মেনে চলবেন বলে তিনি আশা করছেন। [হারুন-উর-রশীদ, পূর্বোল্লিখিত, পৃষ্ঠা ২৯৭]। প্যাটেলের এই পরিস্কার সতর্কবার্তা মূলত শংকরের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি ছাড়া আর কিছুই নয়, যদি তিনি অবিভক্ত বাঙলা প্রকল্প নিয়ে আর সামনে এগুতে চান।
নেহেরুও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। ১৭ মে কিরণ শংকর রায়কে লেখা এক চিঠিতে নেহেরু বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক স্বাধীন বাঙলা, যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থা এবং অর্ধেক ভাগাভাগির যেসব প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সেগুলো বাঙলা এবং ভারত উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর বলে তিনি নিশ্চিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘ঐসব প্রস্তাব বা এ ধরনের অন্যান্য প্রস্তাবাদি একমাত্র ভারতের সাথে (বাঙলা) যোগ দেয়ার ভিত্তিতেই গ্রহণ করা যায়।… আমি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এই মুহুর্তে বেশি নিশ্চিত যে, আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের বন্দুক হাতে রাখতে হবে। যদি পুরো বাঙলা ভারতের সাথে যোগ না দেয় তাহলে অবশ্যই বাঙলা ভাগ হবে এবং পশ্চিমবঙ্গকে অবশ্যই ভারতের সাথে যোগ দিতে হবে। সামনের কঠিন দিনগুলোতে আমি আশা করবো বাঙলার কংগ্রেসম্যানরা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং এই অবস্থানের পক্ষে দাঁড়াবে।’ [চিঠিটি দেখুন, বাংলাদেশ টাইমস, ঢাকা, আগস্ট ১১, ১৯৯৪]। একই চিঠিতে শংকর রায়কে আশ্বস্ত করে ভবিষ্যদ্বানী হিসেবে নেহেরু লিখেছিলেন যে, বাঙলা ভাগ হয়ে পশ্চিম অংশ ভারতে যোগ দিলে পূর্ব অংশও অচিরেই ভারতের সাথে চলে আসবে। যদিও ২৭ মে একটি সংবাদ সম্মেলনে পূনরায় স্বাধীন বাঙলার বিপক্ষে বলতে গিয়ে কারণ হিসেবে দেখান যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙলা স্বাধীন হওয়ার অর্থ সেটি মুসলিম লীগের প্রভাবে থাকা। [হারুন-উর-রশীদ, পূর্বোল্লিখিত] আর এ কারণেই তিনি এই ধারণার বিরোধী।
একই সময়ে বাঙলার আইনসভার সদস্যরা বিষয়টিকে ছেড়ে দেন ১৯৪৭ এর ৫ আগস্ট ভোটাভুটি উপর। এর মাধ্যমে হিন্দুস্তান আইনসভা, নাকি পাকিস্তান আইনসভা- কোনটাতে বাঙলা যুক্ত হবে সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।এমন পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ সালের ৯ জুন শরৎ বোস জিন্নাহকে অনুরোধ করে লেখেন, ‘বাঙলাকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে রাখতে অনুগ্রহপূর্বক আপনি মুসলিম লীগ নেতাদের স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিন।’ [শরতের এই চিঠির পুরো বক্তব্য আবুল হাশিমের পূর্বোল্লিখিত বইয়ের ১৭৫-১৭৬ পৃষ্ঠায় দেয়া আছে]।
জিন্নাহকে চিঠি লেখার দিনেই (৯ জুন) এবং এর পরের দিন শরৎ বোস গান্ধীর কাছে কয়েকটি টেলিগ্রাম পাঠান। তাতে তিনি বাঙলার মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করেন এবং একই সাথে বাঙলাকে ভাগ না করার বিষয়ে নেহরু এবং প্যাটেলকে বুঝাতে গান্ধীর প্রতি অনুরোধ জানান। জবাবে ১১ জুন গান্ধী এক টেলিগ্রাম বার্তায় শরৎ বোসকে জানান যে, তিনি এ বিষয়ে পন্ডিত নেহরু এবং সরদার প্যাটেলের সাথে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তারা উভয়েই এমন প্রস্তাবের ঘোর বিরোধী। [কামরুদ্দীন আহমদ, অ্যা সোশিও পলিটিক্যাল হিস্টরি অব বেঙল এন্ড দ্য বার্থ অব বাংলাদেশ, চতুর্থ সংস্করণ, ইনসাইড লাইব্রেরি, ঢাকা, ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ৮২]। গান্ধী বোসকে বাঙলার ঐক্যেবদ্ধতার সংগ্রাম বাদ দেয়ার এবং বিভাজনের জন্য যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে তাতে বাধা না দেয়ার পরামর্শ দেন। [পূর্বোল্লিখিত সূত্র, এছাড়াও আবুল হাশিমের আগে উল্লিখিত বই, পৃষ্ঠা ১৭৭-১৭৮]। এখানে স্পষ্ট যে, নেহরু এবং প্যাটেলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গান্ধী বাঙলা ভাগ নিয়ে তার পূর্বতর অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন।
অন্যদিকে জিন্নাহ মুসলিম লীগ আইনপ্রণেতাদেরকে পাকিস্তানের পক্ষে এবং অবিভক্ত বাঙলার পক্ষে ভোট দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। জিন্নাহ পুরো বাঙলাকে পাকিস্তানের সাথে চেয়েছিলেন। [আবুল হাশিম, পূর্বোল্লিখিত, পৃষ্ঠা ১৭৬]। বাঙলা ভাগের বিরুদ্ধে জিন্নাহর এই অবস্থান লুইস মাউন্ট ব্যাটেন কর্তৃক বাঙলা ও পাঞ্জাব ভাগ করার পরিকল্পনার বিরোধিতায় জিন্নাহর অবস্থানকেই প্রমাণ করে। (ব্যাটেনের) বিভাজন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘পাঞ্জাব একটি জাতি। বাঙালীও একটি জাতি। মুসলিম অথবা হিন্দু পরিচয়ের আগে এখানকার বাসিন্দাদের পরিচয় হচ্ছে তারা ‘পাঞ্জাবী’ এবং ‘বাঙালী’। আপনি যদি এই দুই প্রদেশকে আমাদের (পাকিস্তানের সাথে) দিতে চান তাহলে তা কোনোভাবেই ভাগ করতে পারেন না। এমন বিভক্তি দীর্ঘমেয়াদে রক্তক্ষয় ও সমস্যার কারণ হবে। [ল্যারি কলিন্স এবং ডমিনিক লেপিরি, মাউন্ট ব্যাটেন এন্ড দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, বিকাশ পাবলিশিং হাউজ প্রাইভেট লিঃ, নিউ দিল্লী, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ৬৩]।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতারা বিভাজনের পক্ষে যেভাবে মরণপন দাঁড়িয়েছিলেন, বেঙল মুসলিম লীগও বিভাজনের বিরুদ্ধে মরণপন দাঁড়িয়েছিল। যদিও দলটির মূলধারার নেতারা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলা চাননি। বরং জিন্নাহর প্রথম চাওয়া অনুযায়ী দলটি অবিভক্ত বাঙলাকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করতে চেয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচারণ অনুযায়ী, বেঙল মুসলিম লীগের সাবেক সভাপতি মাওলানা আকরাম খাঁ তখন প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন যে, বাঙলা ভাগ হলে তার লাশের উপর দিয়ে হবে। আমি যতদিন বেঁচে আছি বাঙলাকে ভাগ হতে দেবনা। পুরো বাঙলাই পাকিস্তানের অংশ হবে। [শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃষ্ঠা ৭৮]।
সাবেক বেঙল কংগ্রেসের সভাপতি সুরেন্দ্র মোহন দাস ও সেক্রেটারি কালীপদ মুখার্জি এবং দলটির হাইকমান্ড বাঙলার হিন্দুপ্রধান অংশ পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের অধীনে চাচ্ছিলেন। এজন্য হাইকমান্ড থেকে বাঙলার কংগ্রেসীয় আইনপ্রণেতাদেরকে বিভাজনের পক্ষে ভোট দিতে নির্দেশনা দেয়া হয় [আবুল হাশিম, পূর্বোল্লিখিত, পৃষ্ঠা ১৭৬]।
স্বাধীন বাঙলার বিষয়ে আলোচনা করতে সোহরাওয়ার্দী বেঙল মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল হাশিম এবং সোহরাওয়ার্দীও মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী ১৯৪৭ সালের ১১ মে গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করে। কিন্তু সাক্ষাৎকালে গান্ধী বাঙলায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ঘটনায় ‘প্রতিটা মানুষের মৃত্যুর জন্য নৈতিকভাবে’ সোহরাওয়ার্দীকে (তৎকালীন বাঙলার প্রশাসনিক প্রধান হওয়ার প্রেক্ষিতে) দায়ী করেন। এটাকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী রেগে যান এবং তিনি ‘সার্বিক সমস্যার মূল হোতা’ হিসেবে গান্ধীকে অভিযুক্ত করেন। [পূর্বোল্লিখিত, পৃষ্ঠা ১৬৭-১৬৮]। এরপর সোহরাওয়ার্দী চলে গেলে অবিভক্ত বাঙলার দাবির ব্যাপারে গান্ধী মূল্যায়ন ছিল: “হাশিম, সমস্যা হল সোহরাওয়ার্দীকে কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না” [পূর্বোল্লিখিত, পৃষ্ঠা ১৬৮]।
বিভক্ত বাঙলার পক্ষে কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার অব্যাহত প্রচারণার মুখে ১৯৪৭ এর ২০ জুন শেষ পর্যন্ত বাঙলার হিন্দু এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর আইনপ্রণেতাদের একটি যৌথ সভা হয় আইনসভার চেম্বারে। পরদিন কলকাতা ভিত্তিক দৈনিক দ্য স্ট্যাটসম্যান রিপোর্ট করে যে, আইনসভার স্পীকার নূরুল আমিনের (১৮৯৭-১৯৭৪) সভাপতিত্বে ওই যৌথ সভায় ভারতের সাথে যোগ দেয়ার পক্ষে ৯০ জন আইনপ্রণেতা মত দেন। অন্যদিকে পাকিস্তানে যোগ দেয়ার পক্ষে মত দেন ১২৬ জন। এরপর হিন্দুপ্রধান এবং মুসলিমপ্রধান জেলাগুলোর আইনপ্রণেতারা বাঙলা ভাগ হবে কিনা, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আলাদা আলাদাভাবে বৈঠকে বসেন।
হিন্দুপ্রধান জেলাগুলোর আইনপ্রণেতাদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ। তাদের মধ্যে ৫৮ জন বিভাজনের পক্ষে ভোট দেন এবং বাকি মুসলিম লীগের ২১ জন বিপক্ষে ভোট দেন। ৫৮ জনের সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষ আরো সিদ্ধান্ত নেয় যে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো ভারতে যোগদান করবে। অন্যদিকে, মুসলিমপ্রধান জেলাগুলোর আইনপ্রণেতাদের মধ্যে ১০৬ জন (যার ১০০ জনই মুসলিম লীগের) বাঙলা ভাগের বিপক্ষে ভোট দেন। বাকি ৩৫ জন পক্ষে ভোট দেন। একপর্যায়ে হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোর আইনপ্রণেতাদের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে ১০৭-৩৪ ভোটে মুসলিমপ্রধান এলাকার আইনপ্রণেতারা প্রস্তাবিত পাকিস্তানে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নিন্ম বর্ণের হিন্দুদের প্রতিনিধি পাঁচ আইনপ্রণেতা এবং খ্রিস্টানদের প্রতিনিধিত্বকারী একজন মুসলিম লীগের পক্ষে ভোট দেন। [২১ জুনের স্ট্যাটসম্যানের রিপোর্টটি সফর আলী আকন্দের ‘লীগ মুভমেন্ট এন্ড দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১৩, এর ১৬ পৃষ্ঠায় রয়েছে।] উল্লেখ্য, বেঙল ন্যাশনাল কংগ্রেসের সাথে তাল মিলিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার বেঙল শাখার সাথে সংশ্লিষ্ট আইনপ্রণেতারা বাঙলা ভাগের পক্ষে ভোট দেন [আবুল হাশিম, পূর্বোল্লিখিত, পৃষ্ঠা ১৮২]
অতঃপর বাঙলা হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার ভিত্তিতে দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল এবং পূর্ববাঙলা পাকিস্তানের সাথে যোগ দিল।
(চলবে)
মূলধারা বাংলাদেশ-এর সৌজন্যে