শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১২:৩১
Home / অনুসন্ধান / উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও বাংলা ভাগ (পর্ব-১)
নূরুল কবীর

উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও বাংলা ভাগ (পর্ব-১)

নূরুল কবীর
নূরুল কবির

লিখেছেনঃ নুরুল কবির, সম্পাদক  নিউ এইজ

আমি জানিনা ভারতে কখনো পাকিস্তান-প্রভাবিত রাজনীতির উত্থান হবে কিনা। তবে আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত, যেভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের লেখক-সাহিত্যিকেরা এবং সরকারের শিক্ষা বিভাগ বাঙলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের মুখের ভাষাকে তাদের সাহিত্যকর্মে এবং পাঠ্যপুস্তকে উপেক্ষা করে যাচ্ছেন তাতে এখানকার সাহিত্যজগতে একটি পাকিস্তানের জন্ম হবে, (আবুল মনসুর আহমদ, ১৮৯৮-১৯৭৮)।

পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ একরকম নয়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষজন, যারা সংস্কৃত ভাষার প্রভাব থেকে কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি, পূর্ববঙ্গের মানুষের ভাষার শব্দ, উচ্চারণ ভঙ্গি এবং এখানকার নানাবিধ রীতিনীতি নিয়ে উপহাস করতো। আবার এখানকার লোকজনও একইরকমভাবে এসবের জবাব দিত। (কামরুদ্দীন আহমদ)।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই বোধয় বাঙলা ভাগের জন্য প্রধানত দায়ী। (আহমদ ছফা, ১৯৪৩-২০০৪)।

১৯৪৭ ভারতকে ভাঙ্গার ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী রাজনীতি বাঙলাকেও ভাগ করে ফেলে। এবং সেই ভাঙনটাও ছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিবেচনায়। ভাঙন প্রক্রিয়ায় বাঙলার মুসলিমপ্রধান অঞ্চল পূর্ববঙ্গ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং হিন্দুপ্রধান অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের অন্তর্ভূক্ত হয়।

এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় বহু কারণের মধ্যে বাংলা ভাষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার কথ্য এবং লিখিত রূপের বড় ধরনের ভিন্নতা, হিন্দু লেখকদের সাহিত্যকর্মে সংস্কৃত ভাষা ও শব্দের প্রাধান্য অন্যদিকে মুসলমানদের সাহিত্যকর্মে আরবী-ফার্সি শব্দের প্রভাব, এমনকি দুই ধর্মের লেখকদের সাহিত্যের বিষয়বস্তুর ভিন্নতা বাংলা ভাষী এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ভাঙনকে সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ভিত্তিতে সম্পন্ন হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। তবে ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙলার ভূ-রাজনৈতিক বিভাজন ঘটলেও ভাষা এবং সাহিত্যে মুসলমান এবং হিন্দুদের মধ্যকার বিভাজন আরো আগে থেকে শুরু হয়েছিল। এদিক থেকে বিবেচনা করলে, রাজনৈতিকভাবে বাঙলার বিভাজন মূলত তার আগে থেকে চলে আসা ভাষা এবং সাহিত্যের বিভাজকে অনুসরণ করেই হয়েছে।

মনে রাখা দরকার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা ভাগ হওয়া এই বাঙলার রাজনৈতিক অস্তিত্ত্বের আবির্ভাব হয় ১৩ শতকে মুসলিম শাসনের সময়। বাঙলার সামাজিক ইতিহাসের ওপর বিশেষজ্ঞ দুর্গাচন্দ্র সান্যাল সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন যে, বর্তমানের সম্পূর্ণ বাঙলা ভূখন্ড মুসলিমদের আগে হিন্দু শাসনের সময় কখনো এক দেশ হিসেবে রাজনৈতিকভাবে আবির্ভূত হয়নি।

তিনি লিখেছেন, ‘গৌঢ়ের হিন্দু রাজারা ক্রমানুসারে এ অঞ্চলের পাঁচটি রাজ্য দখল করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সেগুলো হচ্ছে বরেন্দ্রভূমি, বঙ্গ, মিথিলা, রাঢ় এবং বকদ্বিপ বা বগদি। এগুলোকে তখনকার গৌঢ়ের অধীনরাজ্য বলা হতো। পরবর্তীতে মুসলিম শাসকরা এই অধীনরাজ্যগুলো অধিকার করেন। তারা মিথিলাকে মগদের সাথে একিভূত করে সুবে-বিহার নাম দেন। অন্যদিকে বাকি চারটিকে একত্র করে নাম দেন সুবে-বাঙালা। ‘বাঙালা দেশ’ নামটি এই ‘বাঙালা’ থেকেই আগত।এরপর উত্তর এবং পূর্ব সীমান্ত মুসলিম শাসকদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর আশপাশের এলাকাগুলো বাঙালা দেশের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। এভাবে বাঙলা দেশ একটি বিশাল দেশে পরিণত হয়’ [দুর্গাচন্দ্র সান্যাল, বাঙালার সামাজিক ইতিহাস (সোশ্যাল হিস্টোরি অব বাংলা), মডেল পাবলিশিং হাউজ, কলকাতা, ১৪১০ (বাংলা বর্ষপঞ্জি), (২০০৩ ইসায়ী), পৃষ্ঠা ১৮]। ব্রিটিশরা এই বাঙালা দেশকে ‘বেঙ্গল’ বলতো।

উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা বাংলা ভাগ

বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত বিভাগের অনিবার্য ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে বাঙলা হয়।এটা হয়েছে উপনিবেশী ব্রিটিশ শাসক এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা। বিশেষ করে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের আরোপিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা জমিদারি প্রথার মাধ্যমে সৃষ্ট কলকাতা ভিত্তিক হিন্দু জমিদার শ্রেণী যারা ভদ্রলোকশ্রেণী হিসেবেই পরিচিত ছিল, তারাই এই বিভাজনে মূল ইন্ধন যুগিয়েছে।

বেশ ক’জন খ্যাতিমান মুসলিম রাজনীতিবিদ ও বেঙল মুসলিম লীগের নেতা, যেমন পশ্চিমবঙ্গের আবুল হাশিম এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বেঙ্গল কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসু এবং কিরণ শংকর রায়ের মতো নেতাদের সাথে মিলে চেষ্টা করেছিলেন প্রদেশটিকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে রাখতে। কিন্তু ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের হাইকমান্ড এবং হিন্দু মহাসভা বিভাজনে বদ্ধপরিকর থাকায় ঐক্য প্রচেষ্টাটি ভেস্তে গেল। বেঙ্গল কংগ্রেস স্বাধীন হিসেবে হোক, অথবা ভারত বা পাকিস্তানের অধীনে যেকোনো পরিস্থিতিতে বাঙলাকে অবিভাজিত রাখার চেষ্টার সক্রিয় বিরোধিতায় ছিল।  অন্যদিকে বেঙ্গল মুসলিম লীগ, বিশেষ করে দলটির পূর্ববঙ্গ কেন্দ্রিক নেতারাও বিভাজন ঠেকানোর প্রচেষ্টায় রাজনৈতিকভাবে আগ্রহ দেখাননি।

যদিও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদির পাশাপাশি ভাষাও পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণীকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙলা ভাগের বিরুদ্ধে সক্রিয় রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে না তুলতে নিরুৎসাহী করেছে। এই ভাষা (বাংলা), বহু আগেই ঔপনিবেশিক ইউরোপিয়ান ভাষাবিদ এবং ব্যয়াকরণবিদদের দ্বারা সাম্প্রদায়িক চরিত্র ধারণ করেছিল এবং তা (ভাষার সাম্প্রদায়িক রূপ) বহু উঁচুমাপের হিন্দু সাহিত্যিকরা গ্রহণ করে সাহিত্যে ব্যবহার করছিলেন।

১৯৪৭ সালের বাঙলা ভাগ প্রকৃতপক্ষে এ ধরণের দ্বিতীয় ঘটনা। প্রথমটি ঘটেছিল ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর। যেটি পরবর্তীতে ১৯১১ সালের ২০ আগস্ট রদ করা হয়। প্রথম বিভাজনটি রদ করা হয় কলকাতাভিত্তিক হিন্দু এলিট শ্রেনীর বড় ধরনের রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখে। এর ঠিক বিপরীত ভূমিকা নিয়ে দ্বিতীয় ঘটনায় কলকাতার হিন্দু এলিটরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভাজন নিশ্চিত করে। উভয় সময়ে তাদের উদ্দেশ্য একই ছিল। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ওপর সাম্প্রদায়িক বিচারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখা।

বাঙালা ভাগ ঠেকাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া সাবেক বেঙ্গল মুসলিম লীগের উল্লেখযোগ্য রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘বাঙলাকে ভাগ করতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার যৌথ আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায় এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলোর ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল’[আবুল হাশিম, ইন রেট্রোস্পেক্ট, বাংলাদেশ বুক কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৫৬]।

পশ্চিমবঙ্গের একজন ইতিহাসবিদ জয়া চ্যাটার্জিও লিখেছেন, ‘কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার প্রাদেশিক শাখাগুলোর মদদে পশ্চিমবঙ্গের বিরাট সংখ্যক হিন্দু ১৯৪৭ সালে বাঙলা ভাগ করে ভারতের অধীনে আলাদা একটি হিন্দু প্রদেশ সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালায় [জয়া চ্যাটার্জি, ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কম্যুনালিজম এন্ড পার্টিশন: ১৯৩২-১৯৪৫’, ক্যামব্রিজ ইউনিভাসির্টি প্রেস, নিউ দিল্লি, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ২২৭]।

১৯৪০ সালের দিকেও হিন্দুদের একটি বড় অংশকে বাঙলা ভাগের পক্ষে সম্মত করা খুব সহজ ছিল না। কারণ তাদের অনেকেই ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথম দশকে ঘটা বিভাজনের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমের কথা বলে লড়াই করেছিলেন। তারপরেই কম্যুনিস্ট হিন্দু নেতারা দেশপ্রেমকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করলেন। ১৯৪৭ সালের ৪ এপ্রিল মহাসভা নেতা এনসি চ্যাটার্জি পশ্চিমবঙ্গের হোগলী জেলার তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক বাঙলা হিন্দু সম্মেলনে বলেন, ‘পুরানো কিছু স্লোগানকে বারবার কপচানো এবং কিছু আকর্ষনীয় শব্দের দাস হয়ে থাকার নাম দেশপ্রেম নয়। বাঙলার ইতিহাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত অধ্যায় ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা আরোপিত বিভাজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। কিন্তু আমরা যদি পুরানো স্লোগানের চুড়ান্ত পরিণতি না বুঝে সেগুলো আওড়াতে থাকি তাহলে আমাদেরকে মাতৃভূমির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অপরাধে অপরাধী হতে হবে। স্বদেশী আন্দোলনের সময় বিভাজনের বিরোধিতা ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, যারা চেয়েছিল বাঙলাকে ভাগ করে উভয় প্রদেশে হিন্দুদেরকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার মাধ্যমে (ভারতের) স্বাধীনতার জন্য কাজ করা সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী শক্তিটিকে দুর্বল করে ফেলতে। আর আজকে আমরা বিভাজন দাবি করছি জাতীয়তাবাদী শক্তির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঠেকাতে এবং বাঙলার সংস্কৃতিকে রক্ষা করে বাঙলার হিন্দুদের জন্য একটি আলাদা ভূখন্ড- অর্জন করতে যেটি একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অংশ হবে’ [জয়া চ্যাটার্জি এভাবে এনসি চ্যাটার্জিকে উদ্ধৃত করেছেন  প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৪১]।

বাঙালী হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর কাছে ‘বাঙলার সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব’-এর স্পষ্ট অর্থ ছিল এককভাবে হিন্দুদের সংস্কৃতি এবং ‘জাতিরাষ্ট্র’র অর্থ ছিল শুধু হিন্দুদেও জন্য একটি রাষ্ট্র। তারা এরপর থেকে প্রচার করতে থাকেন যে, ১৯৪৭ সালের বাঙলা ভাগের পক্ষে লড়ে যাওয়া বাঙলার হিন্দুদের ‘দেশপ্রেমের দায়িত্ব’।

কেন তখন বাঙলা ভাগের পক্ষে দাঁড়ানো এখানকার হিন্দুদের জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে বিষয়ে যুক্তি দিয়ে এনসি চ্যাটার্জি বলেছেন, ‘আজকে আমাদের বিভাজন দাবিটি সেই একই আদর্শ এবং উদ্দেশ্যে থেকে উদ্গত যেটি হচ্ছে, জাতীয়তাবাদী শক্তির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঠেকানো এবং বাঙলার সংস্কৃতিকে রক্ষা করে বাঙলার হিন্দুদের জন্য একটি আলাদা ভূখন্ড – অর্জন করা যেটি একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অংশ হবে’ [প্রাগুক্ত]।

মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি ভারত ছাড়ার আগে এটিকে ভাঙার সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে আসছিল। যদিও বহু বছর ধরে ধর্মীয় বিবেচনায় ক্ষমতার আরো বড় ভাগ পেতে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ একে অন্যের সাথে লড়ে আসছিল, কিন্তু প্রথম দিকে তারাও বিভাজনের ধারণায় সায় দেয়নি। আবুল হাশিম লিখেছেন, ‘ব্রিটিশদের ভারত ভাগ প্রকল্পের প্রথম প্রস্তাব দেয়া হয় রাজগোপাল আচার্য্যরে মাধ্যমে যা কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয় [আবুল হাশিম, উপরে উল্লিখিত, পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৬]। [রাজগোপালের নামের বানান বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে লিখেছেন। যেমন রাজগোপালাচার্য্য, রাজগোপাল আচার্য্য ইত্যাদি। তিনি ছিলেন ১৯৪৬ সালে ভারতের অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প ও সরবরাহ বিষয়ক মন্ত্রী। এরপর ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পর ‘পূর্ববঙ্গের গভর্নর’ও ছিলেন । এছাড়া ১৯৪৮ এর জুনে মাউন্টব্যাটেন দায়িত্ব ছাড়লে রাজগোপাল ভারতের গভর্নও জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।]

যদিও রাজগোপাল আচার্য্য ১৯৪৪ সালে যখন মত প্রকাশ করেছিলেন  যে, শুধু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোকে নিয়ে একটি পাকিস্তান রাষ্ট্রকে কংগ্রেসের মেনে নেয়া উচিত। জয়া চ্যাটার্জি লিখেছেন, ‘তখন কলকাতার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু এই প্রস্তাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। রাজগোপালের ফর্মুলার পরোক্ষ অর্থ ছিল পাঞ্জাব এবং বাঙলার বিভাজন [জয়া চ্যাটার্জি, উপরে উল্লিখিত, পৃষ্ঠা ২৩১]।

পরবর্তীতে ১৯৪৭ এর ফেব্রুয়ারিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন  হিন্দু মহাসভার ড. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি এবং কংগ্রেসের ভল্লব ভাই প্যাটেলকে প্রভাবিত করে ব্রিটিশদের ভারত ভাঙার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাঙলা এবং পাঞ্জাবকে ভাগ করার অনুকূলে পরিস্থিতি তৈরি করতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করেন [আবুল হাশিম, উপরে উল্লিখিত, পৃষ্ঠা ১৫৫]।

ফেব্রুয়ারি মাসের ২২ তারিখ বাঙলার গভর্নর স্যার ফ্রেডেরিক বুরোসের সাথে বৈঠক করে পরদিন শ্যামা প্রসাদ ধর্মীয় বিবেচনায় বাঙলা ভাগ চেয়ে একটি বিবৃতি দেন। (ফ্রেডেরিক এ বিষয়ে শ্যামা প্রসাদকে ফুসলিয়েছিলেন বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে তা সঠিক নয়।) ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি আচার্য্য ক্রিপালিনি হিন্দু মহাসভা নেতার দাবির প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন ব্যক্ত করেন। তবে মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধি, যিনি শেষপর্যন্ত বাঙলা ভাগকে মেনে নিয়েছিলেন, ফেব্রুয়ারি মাসেই ‘মন্তব্য’ করলেন, বাঙলা যদি ভাগ হয়ে যায় তাহলে সাম্প্রদায়িকতা পূর্বভারতের এক দীঘকালীন সমস্যা হয়ে দেখা দেবে  [মোহাম্মদ এইচআর তালুকদার (সংকলন), মেমেয়ারস অব হোসে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উইথ অ্যা ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব হিজ লাইফ এন্ড ওয়ার্ক’, ইউনিভাসির্টি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ২৯]।

এভাবে কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা মিলে বাঙলাকে ধর্মীয় বিবেচনায় ভাগ করার ব্রিটিশ পরিকল্পনায় সমর্থন যোগাতে বাঙলার হিন্দুদেরকে প্ররোচিত করে। ১৯৪৭ এর মে মাসে এই দাবির পক্ষে দল দুটি যৌথভাবে কলকাতায় বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করে। ওই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ইতিহাসবিদ স্যার জদুনাথ সরকার [জয়া চ্যাটার্জি, উপরে উল্লিখিত, পৃষ্ঠা, ২৫০]।

প্রধানত কলকাতা ভিত্তিক হিন্দু অভিজাত শ্রেণী, যারা ‘ভদ্রলোক শ্রেণী’ বলেও পরিচিত ছিল, তখনকার মুসলিম লীগ শাসিত বাঙলাকে ভাগ করার পেছনের আন্দোলন রচনায় মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ভাগ হওয়াতে এই অভিজাত শ্রেনীর বিশেষ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধা ছিল। এ বিষয়ে জয়া চ্যাটার্জি লিখেছেন, ‘জমিদারি প্রথা দ্রুত ভেঙ্গে পড়ার কারণে এবং ক্ষমতা হারানোর পর হতাশাগ্রস্ত ভদ্রলোক শ্রেনী মূলধারার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে থেকে সরে এসে তাদের ঐতিহ্যগত সুবিধাদি রক্ষায় নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ভাগ হয়ে গেলে বিভিন্নভাবে প্রদেশটির ওই অংশের যেসব এলাকায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে সেগুলোতে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব পূনপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত ছিল। ওইসব এলাকায় ‘মুসলিম শাসনের’ সম্ভাবনা এবং অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি তিক্ততার সৃষ্টি করে এবং ওই এলাকাগুলোতেই ভাগ হওয়ার পক্ষে আন্দোলন সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেতে থাকে’ [প্রাগুক্ত , পৃষ্ঠা ২৫৩]।

হিন্দু ভদ্রোলোক শ্রেনীর অর্থনৈতিক সুবিধার বিষয়ে চ্যাটার্জি লিখেছেন, ‘প্রচারণায় ব্যক্তিস্বার্থের শক্তিশালী হিসেব নিকেশ উপস্থিত ছিল যা শুধু চমৎকারভাবে উপস্থাপনই করা হয়নি, বরং এর পেছনে ভাল পরিমাণ অর্থও ঢালা হয়েছিল। কলকাতা এবং কলকাতার বাইরের ব্যবসায়ীরা, হোক বাঙালী বা বহিরাগত, বাঙলা বিভাগের পক্ষে প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল’ [প্রাগুক্ত , পৃষ্ঠা ২৫৪]। ১৯৪৭ সালের মে মাসের ১ তারিখ কলকাতা ভিত্তিক দ্য স্ট্যাটসম্যান পত্রিকার একটি প্রতিবেদনের বরাতে হারুন-উর-রশীদ লিখেছেন, ‘কলকাতার বাঙালী এবং অবাঙালী হিন্দুদের বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্যিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের এক সভায় আলাদা পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের দাবির সমর্থনে একটি রেজুলেশন পাশ করে। লক্ষ্য অর্জনে বার্লা, গোয়েনকা, জালান, ড্রাইভার এবং নলিনি রঞ্জন সরকারের সমন্বয়ে একটি প্রভাবশালী কমিটিও গঠন করা হয়।’ [হারুন-উর-রশীদ, দ্য ফোরশেডোয়িং অব বাংলাদেশ: মুসলিম লীগ এন্ড মুসলিম পলিটিক্স: ১৯০৬-১৯৪৭’, পূণমার্জিত ও বর্ধিত সংস্করণ, সেকন্ড ইম্প্রেশন, ২০১২, দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২৫৯]।

পাশাপাশি ‘সারা প্রদেশ থেকে মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের কাছে এটা দাবি করে পিটিশন দায়ের করে যে, বাঙলায় মুসলিম লীগের শাসনে ব্যবসা-বানিজ্য একেবারে লাটে উঠেছে। এবং এ কারণে তারা (মাড়ওয়ারিরা) বাঙলা ভাগের উদ্যোগের পূর্ণ সমর্থনে রয়েছেন।’ যেসব ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে এই পিটিশনে স্বাক্ষর করা হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার্স অব কমার্স, দ্য অল বেঙ্গল ট্রেডার্স এন্ড কনজিউমার্স এসোসিয়েশন ইত্যাদি। এই সবগুলো সংগঠন ছিল অমুসলিমদের প্রভাবাধীন [জয়া চ্যাটার্জির ৯১ ফুটনোট দেখুন, উপরে উল্লিখিত, পৃষ্ঠা ২৫৪]।

(চলবে)

মূলধারা বাংলাদেশ-এর সৌজন্যে

About Abul Kalam Azad

এটাও পড়তে পারেন

আল্লামা আহমদ শফীকে কি আসলেই তিলে তিলে হত্যা করা হয়ছে?

আল্লামা শফী সাহেবের মৃত্যু নিয়ে ওনার খাদেম  শফীর সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০। ...