রবিবার, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ৯:২১
Home / কওমি অঙ্গন / বই পড়া নিয়ে মহাসংকটে মুসলিম বিশ্ব

বই পড়া নিয়ে মহাসংকটে মুসলিম বিশ্ব

bookহাতেম বাযিয়ান : আল-কুর’আনের প্রথম যে শব্দটি অবতীর্ণ হয়েছিল সেটা হচ্ছে “পড়ো”—একটা আদেশমূলক ক্রিয়াপদ। প্রথমদিকের আয়াতগুলোতে শব্দটি দুবার এসেছে। মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী আল-কুর’আন হচ্ছে মানবজাতির কাছে পাঠানো সর্বশেষ ও চূড়ান্ত ঐশীগ্রন্থ। আর সেই ঐশী সত্ত্বাকে বোঝার জন্য, জানার জন্য, তাঁর সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য প্রথম যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে “পড়ো”। জ্ঞান অর্জনের চাবিকাঠি হচ্ছে বই পড়া। এতে স্রষ্টা আর তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান বিকশিত হয়। এটা কোনো কাকতালীয় বিষয় নয় যে, “কুর’আন” শব্দটাও যে-মূল শব্দ থেকে এসেছে তার অর্থ পড়া, পুনরাবৃত্তি করা বা আবৃত্তি করা। কাজেই সঠিক ইসলামিক বুঝ অনুযায়ী শুধু পড়াটাও হতে পারে এক ধরনের ‘ইবাদাত।

আল-কুর’আনের অনেকগুলো নামের মধ্যে একটি হচ্ছে “আল-কিতাব” বা বই। প্রথম অবতীর্ণকৃত শব্দের সাপেক্ষে যদি এই নামের সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, ইসলাম ও মুসলিমদের জ্ঞানসংক্রান্ত ভিত্তিই হচ্ছে পড়াশোনা করা। সবধরনের জ্ঞান অর্জন, সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য এ এক ঐশী আদেশ। বই একদিকে যেমন জ্ঞানের উৎস, অন্যদিকে জ্ঞান সংরক্ষণের প্রাথমিক জায়গা। বই পড়ার মাধ্যমে উন্মোচিত হয় জ্ঞানের নতুন দিগন্ত।

আমার মূল কথা হচ্ছে অধিকাংশ মুসলিমদের কাছে বই পড়া আজ এক হারিয়ে যাওয়া শিল্প। বইয়ের সাথে সবধরনের সংযোগ যেন আজ মুমূর্ষ। গোটা মুসলিম বিশ্বে খুব কম পরিমাণ লোকই খুঁজে পাওয়া যাবে বইয়ের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক আছে। অথচ ইসলামি সভ্যতাজুড়ে দেখা যায় বই এবং বই পড়াকে ইসলাম কত সম্মানিত আর মর্যাদার উচ্চ আসনই না দিয়েছে। এর স্বকীয়তা এখানেই যে বই ও বই প্রকাশনার সঙ্গে সাধারণ জনগণের ছিল সুশৃঙ্খলবদ্ধ সংযোগ। ফ্রান্‌য রনসেনথাল তাঁর “Knowledge Triumphant: The Concept of Knowledge in Medieval Islam” বইতে লিখেছেন: “জ্ঞানের ধারণা ইসলামে অর্জন করেছিল অনন্য এক সাফল্য।” অতীতের সেই সাফল্য ছিল যথাযথ। আর এই সাফল্য অর্জন হয়েছিল অনবরত বইয়ের মধ্যে বুঁদ হয়ে থেকে এবং বৈচিত্রময় রকমারি সব বই থেকে স্বাদ নেওয়ার মাধ্যমে। যেসব বইয়ের মধ্যে এমন অনেক বইও ছিল যেগুলো ইসলামি বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিপরীত।

অনেকে হয়তো ইন্টারনেটের আবির্ভাব, নিত্যনতুন যোগাযোগ পণ্য এবং সংক্ষিপ্ত ভাষা ব্যবহারের প্রবণতাকে এজন্য দায়ী করবেন। হ্যাঁ, কথাটা একটা পর্যায় পর্যন্ত সঠিক। কিন্তু মূল সমস্যা আরও গভীরে। আর সেটার শুরু ইন্টারনেট আবির্ভাবেরও আগে। বইয়ের সাথে সংযোগ হারানো, এবং পরিণতিতে বই পড়াই ছেড়ে দেওয়া—এধরনের প্রবণতার শুরু আরও আগে, কম করে হলেও ১৮ শতকের দিকে। আর এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান।

এর পেছনে বহু কারণ আছে। যেমন: অন্তর্দ্বন্দ্ব, সামরিক ও কলাকৌশলগত জ্ঞানের উপর বেশি মনোযোগ দেওয়া, অনুদান কমে যাওয়া। তবে আমার মতে অন্যতম কারণ হচ্ছে ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে যাওয়া। কেননা ইসলামি সমাজে এগুলোই ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক মেরুদণ্ড। সমাজের প্রতিটি কোণায় কোণায় ‘আলিম, শিক্ষক ও শিক্ষণ পৌঁছে দেওয়ার মূল চালিকাশক্তি ছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলো। ওয়াকফের ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে দেখা যায় কেন্দ্রীয় সরকার একসময় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা শুরু করেছিল এবং ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রযন্ত্রে পরিণত করেছিল এই কারণে যে, যাতে ইতিমধ্যে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে রাষ্ট্র-আয় চুরি করার লক্ষ্যে এগুলোকে উদ্বৃত্ত হিসেবে তুলে ধরা হলো এবং যারা ক্ষমতায় ছিল তাদের দুর্নীতির জন্য অর্থের জোগান দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হলো এসব ওয়াক্‌ফ প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

একটি সমাজের অগ্রগতি ও উন্নতির পূর্বশর্ত হচ্ছে পড়া। না-পড়লে সমাজ থেমে যাবে। হবে অবনতি। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে পড়ার ব্যাপারটাকে মুসলিমরা সামগ্রিকভাবে পরিহার করা শুরু করেছে। সবধরনের জ্ঞান এখন সীমিত করে ফেলা হয়েছে ডিভিডি, লাইভ স্ট্রিমিং আর ইউটিউব লেকচারের মধ্যে। আমাদের সমাজ যেন ‘লাইক’ আর ‘শেয়ার’-এর মধ্যে বন্দি হয়ে গেছে। এর সাথে বই পড়া এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে জ্ঞান অর্জনের কোনো সম্পর্ক নেই। উপরোক্ত জিনিসগুলোর আবেদন অবশ্যই আছে। বিশেষ করে সমাজে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রভাব ফেলছে সেগুলোর ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা জাগানো এবং মনযোগ আকর্ষণের জন্য এগুলোর দরকার আছে। কিন্তু সমাজের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তির জন্য বই পড়ার সংস্কৃতির কোনো বিকল্প এগুলো হতে পারে না।

আজ তাই এটা শুনতে আর আশ্চর্য লাগবে না যে, পৃথিবীর শীর্ষ ৫৬ বই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটাই মুসলিম বিশ্বে অবস্থিত নয়। আল-কুর’আন, বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোর বাইরে অন্যান্য শীর্ষ বিক্রিত ও বহুল পঠিত বইয়ের কোনোটাই মুসলিম বিশ্বের নয় বা কোনো মুসলিম লেখক লেখেননি। নিজের বিশেষায়িত ক্ষেত্রের বাইরে সাধারণ পড়াশোনার চল নেই বললেই চলে। বই পড়তে অনীহা মুসলিম বিশ্বে বই পড়া নিয়ে মহাসংকটের দিকেই ইঙ্গিত করে। আমাদের সমাজে যে অজ্ঞতা গেঁড়ে বসছে তারও টের পাওয়া যাচ্ছে। প্রয়োজন এখন উপরোক্ত সমস্যাগুলোর বাঁক ঘুরিয়ে দেওয়া।

বই পড়া নিয়ে অনীহা ঠেকানোর জন্য প্রয়োজন আলোকিত নেতৃত্ব। বহুমাত্রিক এবং বহুবছরব্যাপী পরিকল্পনা। রিডিং ক্লাব বা বই-পড়া কর্মসূচির মাধ্যমে এটা শুরু হতে পারে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বই-পড়া নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। আর এগুলোর তত্ত্বাবধানে থাকতে পারে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কমিটি। এছাড়া বই প্রকাশনা এবং লেখকদের পেছনে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আয়োজন করা যেতে পারে বই পড়া নিয়ে বিভিন্ন ফেস্টিভাল। এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত যে ধারা চলে আসছে: ‘চাকুরির জন্য ডিগ্রি অর্জন—এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন বই পড়া ও বোঝার দিকে মনোযোগ দেয় সেই লক্ষ্য অর্জনে পরিবর্তন আনতে হবে।

“পড়ো” এ আদেশটি জীবনভর জ্ঞান অর্জনের জন্য আদেশ। মুসলিম বিশ্বে পুনরায় বই পড়ার সংস্কৃতি চালুর প্রণোদনা।

লেখক : ড. হাতেম বাযিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রতিষ্ঠিত জাইতুনা কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যাপক। পাশাপাশি তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত। ড. বাযিয়ান ২০০২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন ও ইসলামিক স্টাডিজ নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের Islamophobia Research and Documentation Project-এর পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন ।

সূত্রঃ Daily Sabah

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে জরুরী কিছু কথা!

কমাশিসা ডেস্ক: শুক্রবার ২৫সেপ্টেম্বার ২০২০. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনি যখন কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির ...