আয়েশা স্ট্যাসি : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব মুসলমানেরই প্রিয়। অসংখ্য অমুসলিমও তাঁকে সম্মান করেন ও মর্যাদা দিয়ে থাকেন। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর প্রভাব পারলৌকিক ও ইহজাগতিক, উভয় ক্ষেত্রেই বিস্তৃত।
মহাত্মা গান্ধী মহানবী সা: সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি এমন একজন মানুষ যিনি অঙ্গীকারের খুঁটিনাটিও পূরণের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক; বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য যার আন্তরিকতা অনন্য; যিনি নির্ভীক এবং স্রষ্টার প্রতি ও নিজ জীবনের মিশনের ব্যাপারে যাঁর পরম আস্থা রয়েছে।’ সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা স্রষ্টার উপাসনা এবং সমাজে একের সাথে অন্যের কাজকর্মের ক্ষেত্রে তাঁকে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তরূপে গণ্য করে থাকেন।
রাসূল মুহাম্মদ সা: আমদেরকে ইসলাম শিখিয়েছেন। আর ইসলাম শিক্ষা দেয় প্রতিবেশীদের প্রতি সদয় ও সুবিবেচিত আচরণের। ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ইত্যাদি নির্বিশেষে পড়শিরা আমাদের কাছ থেকে মর্যাদা ও মানবিকতার দাবিদার।
বলা হয়েছে, হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণের বিষয়ে রাসূল সা:কে জোর দিয়ে বলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নবী করীম সা: উল্লেখ করেন, একপর্যায়ে তিনি ভেবেছিলেন, জিবরাঈল আ: প্রতিবেশীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার পর্যন্ত দিয়ে দেবেন। তাদের সাথে সদয় আচরণের ব্যাপারে তিনি এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। (আল বুখারী)
আল্লাহতায়ালার মহান বাণী মানব জাতিকে পৌঁছিয়ে দেয়াই ছিল রাসূলুল্লাহ সা:-এর লক্ষ্য। আল-কুরআনে আল্লাহ প্রতিবেশীর ব্যাপারে আদেশ দিয়ে বলছেন, আল্লাহর ইবাদত করো এবং ইবাদতের বেলায় আর কাউকে শরিক করো না তাঁর সাথে এবং মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, দরিদ্র, সে প্রতিবেশী যে তোমার নিকটাত্মীয়, আর যে প্রতিবেশী তা নয়, তোমার পার্শ্ববর্তী সঙ্গী, অসহায় পথচারী (যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে), নিজের দাস-দাসী; তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। নিশ্চয়ই, আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না, যারা অহঙ্কারী ও দাম্ভিক (আন-নিসা, আয়াত নম্বর-৩৬)।
যেসব নারী-পুরুষ মহানবী সা:-এর আশপাশে থাকতেন, তাঁদের সবসময়েই মনে করিয়ে দেয়া হতো আল্লাহতায়ালার প্রতি এবং পরস্পরের প্রতি বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে। প্রায় সময়ে শোনা যেত, রাসূল সা: তাদের সৎ কাজ করতে এবং দায়িত্বের কথা মনে রাখতে তাগিদ দিচ্ছেন।
রাসূল সা: বলেছেন, আল্লাহ ও শেষ (বিচারের) দিনে যে বিশ্বাস করে, সে যেন প্রতিবেশীর ক্ষতি কিংবা তাকে বিরক্ত না করে (আল বুখারী)।
মহানবী সা: শুধু সাহাবীদেরই নয়, আমাদের সবাইকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহর প্রতি ঈমানদার ব্যক্তি তার ভাই বা বোনকে ক্ষুধার্ত থাকতে কিংবা দুরবস্থায় জীবন কাটাতে দিতে পারেন না।
আর আজ বৃদ্ধ মানুষেরা নিঃসঙ্গ ও অবহেলিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছেন। এখন আমাদের ঘরে খাবার আছে, অথচ কাছের ও দূরের প্রতিবেশীরা রয়েছেন অভুক্ত। এমন এক দুঃসময়ে আমাদের ধর্মপ্রাণ পূর্বসূরিরা যে নজির রেখে গেছেন, তা মনে করাই উত্তম।
রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের একজন, হজরত আবু যার গিফারী রাদিআল্লাহ তায়ালা আনহুকে বলেছিলেন তাঁর ঝোলে পানি মিশিয়ে তা বাড়াতে, যেন তা থেকে কিছুটা তার পড়শিকে দিতে পারেন (মুসলিম)।
আরেকজন সাহাবী, হজরত আবদুল্লাহ ইবন উমর রা: একদিন একটি ভেড়া জবাই করার পর তাঁর ভৃত্যকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এই গোশতের কিছুটা আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীকে দিয়েছ?’
ঈমানদারকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে অন্যকে উপহার দিতে, যদি তার দাম কম হয়, তবুও। উপহারের আসল মূল্য হলো সে মহৎ চেতনা, যাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এটি কাউকে দেয়া হয়। উপহার দেয়ার অভ্যাস পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতা বাড়িয়ে দেয়।
উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা রাদিআল্লাহ তায়ালা আনহা রাসূলুল্লাহ সা:কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কোন প্রতিবেশীকে উপহার দেবো?’ তিনি জবাব দিলেন, যার দরজা তোমার দরজার সবচেয়ে কাছে (মুসলিম)।
যদিও নিকটতম প্রতিবেশীর কথা বলা হচ্ছে, আমাদের মনে রাখা চাই ইসলাম সব প্রতিবেশীর খোঁজখবর নিতে এবং তাদের সাহায্য করতে বলে। এটা হলো, বৃহত্তর সমাজে অন্যদের অভাব ও চাহিদা উপলব্ধি করার ব্যবস্থা।
যখন কেউ সত্যিকার অর্থেই ইসলামের শিক্ষা অনুধাবন করতে সক্ষম হন, তিনি বুঝতে পারেন যে, সমাজের কোনো একজন সদস্য দুর্ভোগ পোহালে তা পুরো সমাজেরই কষ্টের নামান্তর। বিপদ-আপদ আর দুর্যোগ-দুর্বিপাকে কিংবা প্রয়োজনের সময়ে আমরা পরিবারের পরে প্রতিবেশীদের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে থাকি।
পাড়া-পড়শির সাথে সম্পর্ক খারাপ থাকলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। একই পাড়া বা মহল্লায় যারা পাশাপাশি, কাছাকাছি বাস করেন, তারা কে কোন ধর্মের বা ভাষার লোক, তা বিবেচনা না করেই একে অন্যকে বিশ্বাস এবং পরস্পর নির্ভর করতে পারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিবেশীদের অবশ্যই এই নিরাপত্তা বোধ করতে হবে যে, তাঁর সম্মান ও সম্পত্তি দুটোই নিরাপদ।
রাসূল সা: একজন ভালো প্রতিবেশীকে ‘একজন মুসলমানের জীবনের একটি আনন্দ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, এ জীবনে একজন মুমিনের জন্য সুখ বয়ে আনে যেসব বিষয়, সেগুলোর মধ্যে আছে একজন সৎ কর্মপরায়ণ প্রতিবেশী, একটি সুপরিসর বাড়ি এবং উন্নতমানের একটি অশ্ব। (আল হাকিম)
ভালো প্রতিবেশী তিনিই যিনি আরাম ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারেন। এ কারণে, আল্লাহর ওপর যাঁর ঈমান আছে, তিনি প্রতিবেশীদের ব্যাপারে সুবিবেচক ও উদার হওয়ার জন্য যথাসাধ্য প্রয়াস পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
হজরত মুহাম্মদ সা: প্রতিবেশীদের ক্ষতি বা বিরক্ত করার বিরুদ্ধে তাঁর সাহাবীদের সতর্ক করেছিলেন। হাদিসে বলা হয়েছে, কোনো এক মহিলা অতিরিক্ত নামাজ-রোজা করতেন, দান-খয়রাতেও ছিলেন মুক্তহস্ত, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার প্রতিবেশীদের সাথে কর্কশ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতেন না। তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা:কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, এই মহিলা জাহান্নামীদের একজন, যার শাস্তি হবে এহেন আচরণের জন্য (আল বুখারী)।
একই হাদিসে বলা হয়েছে, অন্য এক মহিলার ব্যাপারেও নবী করীম সা:কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যিনি নামাজ-রোজা যতটা করণীয়, ততটুকুই করতেন, আর দান করতেন সামান্য। তবে প্রতিবেশীদের সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলতেন না এবং কাউকে অপমানও করতেন না। রাসূলুল্লাহ সা: তাঁকে জান্নাতীদের অন্যতম বলে উল্লেখ করেন। এই হাদিসটি ১৪ শ’ বছর আগের মতো আজও সত্য।
ইসলাম পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী এবং বৃহত্তর সমাজের সংহতিকে খুব গুরুত্ব দেয়। প্রতিবেশীর প্রতি সদয় ও সদবিবেচক হতে ঈমানদারদের বারবার বলা হয়েছে। যদি কারো প্রতিবেশী ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করে না এবং মন্দ আচরণ করে, তখন করণীয় কী? সে অবস্থায় প্রতিবেশী মুসলমান ধৈর্য ধরে সয়ে যাওয়া উচিত এবং ক্রোধের প্রকাশ ঘটানো ঠিক হবে না।
উন্নত নৈতিকতা ও সদাচরণ এবং ক্ষমার মনোভাব দিয়ে মুমিন ব্যক্তি প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক ভালো করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এটা করা হবে এ আশায় যে, আল্লাহতায়ালা এ জন্য দেবেন বিরাট পুরস্কার। প্রকৃত ঈমানদার (পুরুষ বা মহিলা যা-ই হোন) বিরক্তিকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করে যান ধৈর্যের সাথে। দুঃসহ অবস্থা সৃষ্টি হলে প্রতিবেশীর মন্দ আচরণের ঘটনা প্রকাশ করে দেয়া যেতে পারে শেষ উপায় হিসেবে।
মহানবী সা: একবার এক লোককে বলেছিলেন তাঁর সব জিনিসপত্র রাস্তার মাঝখানে এনে জড়ো করার জন্য। ওই লোক তার প্রতিবেশীর সাথে আর বাস করতে পারছিলেন না, এর ইঙ্গিত ছিল এর মধ্যে। ওই মন্দ পড়শিটি অবিলম্বে মাফ চাইল এবং তার প্রতিবেশীকে বিনীত অনুরোধ জানায় নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে (আল বুখারী)।
কেউই চায় না যে, তার মন্দ আচরণের কথা প্রকাশ পেয়ে যাক। আর এটা একজন মুসলিমের বেলায় সবিশেষ সত্য। কারণ, তার ধর্ম চায়, তার নৈতিক মান উন্নীত হোক সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
শ্রদ্ধা, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমার মতো গুণকে ইসলাম খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে এই গুণাবলির প্রয়োগ উন্নত নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ একমাত্র সত্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁর ইবাদতের অন্তর্নিহিত এসব গুণ।
লেখিকা : অস্ট্রেলীয় নওমুসলিম। কাতারের দোহায় ফানার কালচারাল ইসলামিক সেন্টারে লেখালেখির কাজের পাশাপাশি মানবিক – মনস্তত্ত্ব বিষয়ে ডিগ্রি নেয়ার জন্য পড়াশোনা করছেন।
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
সৌজন্যে : অন্যদিগন্ত