বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সন্ধ্যা ৬:৪৮
Home / কওমি অঙ্গন / কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার পথ ও পদ্ধতি (একাদশ পর্ব)

কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার পথ ও পদ্ধতি (একাদশ পর্ব)

madrassaদ্বিতীয় বিষয় পাঠ্যসূচী। বর্তমানে মাদরাসাগুলোতে যে পাঠ্যসূচী প্রচলিত সেটা মৌলিকভাবে দরসে নিজামীর সিলেবাস। এ সিলেবাস একজন আলেমের সব প্রয়োজনকে সামনে রেখেই প্রণীত হয়েছিল এবং প্রত্যেক বিষয়ে এমন কিতাব অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল যা দ্বারা শুধু স্থুল কিছু তথ্য জানার পরিবর্তে সুগভীর পাণ্ডিত্য ও দৃষ্টির তীক্ষ্নতা, মেধার প্রখরতা সৃষ্টি হয়। এ লক্ষ্য সামনে রেখে আমাদের দৃষ্টিতে মাদরাসা শিক্ষার মৌলিক এ কাঠামোতে এখনো আমূল কোন পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। অবশ্য মেধা শক্তির ক্রম অবক্ষয় এবং সময়ের স্বল্পতার কারণে ধর্মীয় ও আইনগত বিশেষ প্রয়োজনে সিলেবাসের বিভিন্ন দিক পুনরায় দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে শূন্যতা বা ক্রটি পরিলক্ষিত হচ্ছে তা নিম্নরূপঃ
১। মাদরাসা শিক্ষার সাথে আরবি ভাষার যে নিগূঢ় ও গভীর সম্পর্ক তা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। আরবি ভাষা সব ধর্মীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্য অন্যতম মাধ্যম ও সিড়িঁতুল্য। কিন্তু আমাদের মাদরাসাসমূহে আরবি ভাষার রুচি এবং আরবি বলা ও লেখার যোগ্যতা দুঃখজনকভাবে বিলুপ্তির পথে দ্রুত পা বাড়াচ্ছে। ভাল মেধাবী ছাত্ররা আরবি ভাষায় রচিত কিতাবপত্র বুঝার যোগ্যতা অর্জন করলেও মাত্র দু’একজন ছাড়া সকলেই আরবি লেখা ও বলার সামান্যতম অনুশীলন থেকেও বিরত। এ সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ উদাসীন ও মধ্যম শ্রেণীর অধিকাংশ ছাত্রদের আরবি রিডিংও বিশুদ্ধ নয়। আর আরবিতে প্রবন্ধ রচনা, গ্রন্থ সঙ্কলন, বক্তৃতা প্রভৃতির যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্র তো উচ্চ মেধাবী শ্রেণীর মধ্যেও সোনার হরিণের মত দুর্লভ হয়ে গেছে।
অবশ্য এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ,মাদরাসায় আরবি পাঠদানের মূল লক্ষ্য কোরআন-হাদিস ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মূল উৎসে অবাধ বিচরণ করতে সহায়তা প্রদান। যার জন্য আরবি লেখা ও বলা অত্যাবশ্যক নয়।
কিন্তু প্রথমতঃ বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো আরবি বলা ও লেখার অনুশীলণ বন্ধের মারাতœক প্রভাব আরবি বুঝা ও পড়ার উপর পড়েছে। দ্বিতীয়ত যদিও আরবি লেখা ও বলা মূল উদ্দেশ্য নয় কিন্তু তা যে একটি প্রশংসিত যোগ্যতা তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর আরবি ব্যাকরণ (নাহু,সরফ) উচ্চতর ভাষাজ্ঞান (বালাগাত) ও আরবি সাহিত্য পড়ার পরও যদি এ প্রশংসণীয় যোগ্যতা অর্জিত না হয় তাহলে তা কম দুঃখজনক নয়।
তৃতীয়তঃ মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক সম্পর্ক দিন দিন জোরদার হবার প্রেক্ষিতে মাদরাসাগুলোতে আরবি লেখা ও বলায় পারদর্শী ব্যক্তি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। যেন তারা আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ অক্ষুন্ন রাখতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হল বাংলা-পাক-ভারতের প্রতিভাবান ওলামায়ে কেরাম উর্দূ-ফার্সী ভাষায় জ্ঞানের যে অমূল্যরত্ন জাতিকে উপহার দিয়েছেন তারা তা ভাষান্তর করে আরব বিশ্বকে পরিচিত করতে পারবে। আর এ উদ্দেশ্য সাধন আরবি লেখা ও বলার উচ্চতর যোগ্যতা ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে আরবি ব্যাকরণ সাহিত্য ও ভাষাজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করা হয়। কিন্তু এর সবটুকুই তত্ত্বগত (Theorical) দিকটার জন্য। উন্নত অনুশীলন ও চর্চার কোন গুরুত্ব নেই। আর তার ফলাফল হল একজন ছাত্র নাহু সরফের সব নিয়ম, সূত্র এবং সে সবের দর্শন, এতদসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংশয় ও তার নিরসন ইত্যাদি কঠিন বিষয়গুলো শরহেজামী, শরহে আব্দুল গফুর, শরহে এসাম প্রভৃতি গ্রন্থের সহায়তায় অনেকটা ঠোটস্থ করে ফেলে। কিন্তু তাকে যদি সে বিষয়গুলো থেকে কিয়দাংশ আরবিতে লিখে দিতে বলা হয়, তা যে শুধু তার জন্য দুঃসহ চাপ হয় তা নয় বরং অনেক সময় আরবি দু’এক লাইন লেখতে গিয়ে তার কলম বেঁকে যায়। সহজ সহজ ব্যাকরণের নিয়মগুলো বাস্তব ব্যবহারের সময় ভুল করে বসে। অথচ সব নিয়ম কানুন আগা গোড়া তার মুখস্থ। আর কেউ যদি কোনো রকম ব্যাকরণের সীমা অক্ষতভাবে পারও হয়ে যায় তবে আরবি লিখনীরিতিতে তারও নির্ঘাত ভুল থেকে যাবে। সুতরাং মাদরাসাগুলোতে আরবি সুন্দর ও নির্ভুল করার প্রতি অধিক সচেষ্ট হতে হবে। যেন মাদরাসার পরিবেশে গুরুত্বসহ আরবি চর্চা হয়। এই জন্য নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলো বিশেষ উল্লেখযোগ্যঃ-
(ক) প্রাথমিক স্তরগুলোর পাঠ্য তালিকায় আরবি ব্যাকরনের এমন পুস্তক সংযোজন করতে হবে, যেগুলোতে ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একটি মূল সূত্রের অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে ছাত্রদের কচি মগজে তা গেঁথে দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আবার অনুশীলনের মাধ্যমে ছাত্রদেরকে তা প্রয়োগ করতে অভ্যস্তও করা হয়। আরব রাষ্ট্রগুলোতে এ মানের অসংখ্য পুস্তিকা তৈরি হয়েছে। যেমনঃ- প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য “আন্নাহউল ওয়াজেহ” উচ্চতরপর্যায়ের জন্য ‘‘আন ন্নাহউল ওয়াফী’’ এইসব কিতাব নেসাবভূক্ত করতে হবে।
(খ) নিবন্ধ লিখন ও আরবি সাহিত্যের ব্যবহারিক চর্চার জন্য নির্ধারিত সময়ের যথারীতি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ লক্ষে প্রচুর পুস্তিকাও রচিত হয়েছে। যেমনঃ- ‘‘আল উসলুবুস সহীহ লিল ইনশা’’ ‘‘মুয়াল্লিমুল ইনশা’’ ইত্যাদী। এক্ষেত্রে এসব বইয়ের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। অনুরূপ ‘‘বালাগাত’’ ( উচ্চতর ভাষা জ্ঞান ) বিষয়ের জন্য আমাদের পাঠ্যক্রমে যে ‘‘মুখতাসারুল মা’আনী’’ গ্রন্থটি অন্তর্ভুক্ত আছে তা এ বিষয়ে যোগ্যতা‌ অর্জনের জন্য আদৌ যথেষ্ট নয় এবং এ গ্রন্থ দ্বারা বালাগাতের মূল উদ্দেশ্য সামান্যও অর্জিত হয় না। সুতরাং তার পরিবর্তে বা সাথে ‘‘দুরুসুল বালাগাত’’ অথবা ‘‘আল বালাগাতুল ওয়াজেহা’’ এমনভাবে পাঠদান প্রয়োজন যেন ছাত্রদের উচ্চতর আরবি ভাষার জ্ঞান অর্জিত হয়।
(গ) আরবি ভাষার রুচি সৃষ্টির জন্যে এসব পন্থা অবলম্বনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো মাদরাসার পূর্ণ পরিবেশে আরবির অধিক প্রচলণ। এ লক্ষার্জনে নিমিত্তে আমাদের মতামত হলো চতুর্থ শ্রেণীর উপরের ক্লাশে আরবির মাধ্যমে পাঠদান প্রয়োজন। যদি প্রথম বারে তা সম্ভবপর না হয় অন্তত মাদরাসার সব ঘোষণা, অফিসিয়্যাল কর্মকান্ড পরীক্ষার কাগজপত্র, ফলাফল অবিলম্বে আরবি মিডিয়ামে করা উচিত এবং ক্রমান্বয়ে মাদরাসার পরিবেশ এমনভাবে তৈরী করতে হবে যেন আরবিই শিক্ষার পরিপূর্ণ মাধ্যমে পরিণত হয়।
(ঘ) শিক্ষকবৃন্দ ও ব্যবস্থাপকগণ পারস্পরিক এবং ছাত্রদের সাথে আরবির মাধ্যমে কথোপকথন করার অভ্যাস সৃষ্টি করতে অধিক মনোযোগ দেয়া উচিৎ। এতে খুব তড়িৎ আরবি প্রচলণের চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। প্রথমে প্রথমে কিছুটা কষ্টকর মনে হলেও ধৈর্যসহ তা চালিয়ে গেলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে। বিস্ময়কর ফলাফল দেখা দিবে। ইনশাআল্লাহ।
(ঙ) এক/দুই মাস অন্তর অন্তর আরবি সেমিনারের আয়োজন করা উচিৎ, যেখানে ছাত্ররা আরবি বক্তৃতা এবং প্রবন্ধ পাঠ করতে পারবে।

মূল : আল্লামা তকি উসমানি

ভাষান্তর : কাজী মোহাম্মদ হানিফ

শাইখুল হাদিস, জামিয়া আরাবিয়া মারকাজুল উলুম, কাঁচপুর, নারায়ণগঞ্জ

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে জরুরী কিছু কথা!

কমাশিসা ডেস্ক: শুক্রবার ২৫সেপ্টেম্বার ২০২০. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনি যখন কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির ...