০১
হযরত থানবী রহ. এর প্রতি ভীষণ আসক্তি, আগ্রহ, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা রয়েছে আমার। এই আসক্তি কখন থেকে ঠিক বলতে পারব না।
তিনি যুগের মুজাদ্দিদ ছিলেন। ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভা। নিকট অতীতে কেন দূর অতীতেও তাঁর সমক্ষ খুঁজে বের করা কঠিন। হযরাতুল উস্তাদ মাও. নুর আলম খলিল আমিনী দা.বা. প্রায় ক্লাসে বলতেন, দারুল উলুম প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি উম্মতকে কী দিয়েছে? এত কষ্ট, পরিশ্রম ও টাকা বিনিয়োগের ফলাফল কী? যদি বলা হয় এই প্রতিষ্ঠান কেবল একজন ছাত্র হযরত থানবী রহ. -কে উপহার দিয়েছে; তাহলে সকল শ্রম ও পরিশ্রম সার্থক ও সফল।
২০০৫ সনে দেওবন্দ যাওয়ার আগে ঢাকায় পড়তাম। দাওয়াতুল হকের বদৌলতে এদেশের বহু মানুষের আমলি মশক হচ্ছে। থানবী রহ. এর খলিফা হারদুঈ হযরত রহ. প্রতিবছর বাংলাদেশে আসতেন। তাঁর আগমনে বিভিন্ন প্রোগ্রামে সাজ সাজ রব পড়ে যেত।
দাওয়াতুল হকের কল্যাণে জেনেছিলাম, আমাদের দেশের প্রচলিত সব আযান খেলাফে সুন্নত। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের আযানও সুন্নত তরিকায় হচ্ছে না। দাওয়াতুল হকের সংক্ষিপ্ত আযানই একমাত্র সুন্নত।
এ আকিদাই আমি পোষণ করতাম।
দেশের সকল আযানকে ঢালাওভাবে খেলাফে সুন্নত ঠাওরিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম।
দেওবন্দে গিয়ে নতুন এক জগতের সঙ্গে পরিচয় হল। কোনো এক সকাল সাতটা-আটটার দিকে দেওবন্দে গিয়ে পৌঁছুলাম। দুপুরে জোহরের নামাযের আযান শুনলাম। সুললিত কণ্ঠে খেলাফে সুন্নত তরিকায় আযান হচ্ছে (?)।
এই কষ্ট কিছু দিন লালন করতে হয়েছে। পরে কষ্ট দূরীভূত হয়েছে- আলহামদুলিল্লাহ।
দেশ থেকে দাওরা না পড়ে যাওয়ার কারণে নিয়মিত ক্লাস করতাম।
বিশেষত হযরত মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরি দা.বা. এর ক্লাস মিস হতো না কোনোক্রমেই।
তখন তিনি মিরমিযি ১ম এবং তাহাবি শরিফ পড়াতেন। অধুনা সহিহ বুখারি প্রথম খণ্ড পড়ান।
হুজুরের সব কথাই আমার ভালো লাগত; দারুণ ভালো। ফাহমে হাদস ও ফাহমে ইখতিলাফের ক্ষেত্রে তাঁর সমকক্ষ বর্তমানে নাই বললেই চলে। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’র ব্যাখ্যা রচনা করে পৃথিবীর ইলমী ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। ব্যাখ্যাটির নাম রাহমাতুল্লাহিল ওয়াসিআহ, মূলত উরদুতে; কিন্তু এর দু খণ্ডে আরবিও রয়েছে। ভূমিকা লিখেছেন মাও. নুর আলম খলীল আমিনী।
বলছিলাম আমাদের উস্তাদ মাও. পালনপুরি সাহেবের কথা। তিরমিযির 143 – باب ما جاء في الترسل في الأذان পড়ানোর সময় عن جابر [ بن عبد الله ] : أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال لبلال يا بلال إذا أذنت فترسل في أذانك وإذا أقمت فاحدر এই হাদিসের তাকরির করতে গিয়ে আযানে তারাসসুল এবং ইকামতে হদর করার মানে বুঝালেন।
সরাসরি বললেন, লম্বা করে আযান দেওয়া সুন্নত।
তখন মনে প্রশ্ন জাগল তাহলে হারদুঈ হযরত রহ. এর প্রচারকৃত আযান কি খেলাফে সুন্নত!
এই প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনি হযরত বলা শুরু করলেন :
“আমাদের হারদুঈয়ের হযরত রহ. লম্বা আযানের বিরোধিতা করতেন। দারুল উলুম দেওবন্দে লম্বা আযান হওয়ার কারণে তিনি এখানে আসতেন না।
আমার সঙ্গে একবার মিরাঠে একটি মাদরাসার মাহফিলে হযরতের সাক্ষাৎ হয়। আলোচনার প্রাক্কালে আমাকে বললেন, তুমি কেন আমার এ তাহরিকে শরিক হও না?
আমি বললাম, হযরত মাই আপসে মুত্তাফিক নেহী হু। তিনি বললেন, কেন?
আমি এসব দলিল বললাম। হযরত চুপ হয়ে গেলেন।
দেওবন্দ পৌঁছে আমি আমার ছোট ভাই মুফতি আমিন পালনপুরির লিখিত আদাবে আযান ওয়া ইকামত নামক পুস্তিকাটি ডাকযোগে হযরতের কাছে হারদুঈ পাঠিয়ে দিলাম। হযরতকা ইন্তেকাল হু গায়া আজতক কুই জওয়াব মুঝে নেহী মিলা।”
অবশেষে মুফতি সাহেব বললেন, য়েহ হযরত কে তাফাররুদাতাত মে সে হু সিকতা হে।
০২
দাওরায় বাংলাদেশের চল্লিশজন সাথী ছিল। ১৪৩৬ হিজরি মোতাবেক ২০০৬ সনে দেওবন্দে দাওরা হাদিস পড়েছেন এমন যে কেউ এ সংবাদ জানেন।
ক্লাস থেকে বের হয়ে দেশীয় বিভিন্ন সাথী জানালেন যে, মাও. আবদুল মালেক সাহেব দা.বা. নাকি এ বিষয়ে বিশাল মাকালা লিখে যাত্রাবাড়ীর হযরতের কাছে পাঠিয়েছেন। তাহকীক করার সুযোগ হয়নি। কারো জানা থাকলে জানাবেন। উপকৃত হব।
০৩
ইজমায়ে উম্মত বা জমহুর উম্মাহর সঙ্গে থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ। কুরআন-হাদিস দ্বারাও বিষয়টি প্রমাণিত। তবে উম্মতের কিছু খ্যাতিমান আহলে ইলম বিভিন্ন বিষয়ে কিছু একক মতামত পেশ করেছেন। এই একক মতামত কখনো স্বীয় মাযহাবের বিপরীত হয়েছে; আবার কখনো সকল মাযহাব ও মাশরাবের বিপরীতও হয়েছে।
কুরআন-হাদিসের গভীর জ্ঞান, ফিকহ-উসুলে ফিকহ, উসুল-ফুরু ইত্যাদি বিষয়ে অস্বাভাবিক পাণ্ডিত্য থাকার কারণে ইজতিহাদের আলোকে তারা এসব একক মত পোষণ করেছেন।
এই একক মতামতকেই তাফাররুদাত [تفرّدات] বলা হয়।
০৪
হিজরি অষ্টম শতাব্দীর বিখ্যাত আলেম শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. [৬৬১-৭২৮হি.]।
বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী এই মহামতি মনীষী হাম্বলি হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু মাসআলায় একক মত দিয়েছেন। এমনকি জমহুর ওলামায়ে কেরামের মতামতের বিপরীতে একক মতামতও দিয়েছেন। প্রায় ষাটটি মাসআলায় তিনি তাফাররুদাত করেছেন বলে জানা যায়।
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর জালালতে শান ও মাহাত্ম্যের বিষয়টি স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর তাফাররুদাত অনুসরণ করা যাবে না। কারণ, জমহুরের সঙ্গে থাকাই নিরাপদ রাস্তা। এজন্যেই ইবনে তাইমিয়া রহ. এর এসব তাফাররুদাতের বিরুদ্ধে বিখ্যাত আলেমগণ কলম ধরেছেন। আল্লামা তাকিউদ্দিন সুবকি রহ. [মৃত ৭৫৬ হি.] এ বিষয়ে একাই সাতটি পুস্তিকা প্রণয়ন করেছেন। যথা :
الاعتبار ببقاء الجنة والنار.
الدرة المضية في الرد على ابن تيمية.
شفاء السقام في زيارة خير الأنام.
النظر المحقق في الحلف بالطلاق المعلق.
نقد الاجتماع والافتراق في مسائل الأيمان والطلاق.
التحقيق في مسألة التعليق.
رفع الشقاق عن مسألة الطلاق.
এ বিষয়ে প্রায় শতের কাছাকাছি কিতাবের লিস্ট আমার কাছে রয়েছে।
তাই বলে কি যমানা ইবনে তাইমিয়াকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে?
না, তিনি স্বকীয়তা নিয়ে অমর হয়ে আছেন। তাঁর সুবিশাল ইলমি খেদমত কেয়ামত অবধি বেঁচে থাকবে- ইনশাল্লাহ।
তবে তাঁর বিরুদ্ধে কিতাব লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে, তার ইলমি খেদমতকে অস্বীকার করা। বরং এটাই ইসলামের প্রকৃত সৌন্দরয। তিনি ইজতিহাদের মাধ্যমে দলিলের আলোকে একক মত দিয়েছেন, সে মত গ্রহণ করা যাবে না। কোনো ইমামেরই সকল মত গ্রহণীয় ও অনুসরণীয় নয়।
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. আল্লামা ইবনুল হুমাম রহ. এমনকি খাতিমুল মুহাক্কিকীন আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রহ. থেকেও একক মতামত পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও তারা আমাদের চোখের মণি, মাথার তাজ।
০৫
এই তাফাররুদাতা আমাদের যমানার কোনো আহলে ইলম থেকেও প্রকাশ পেতে পারে। শায়খুল ইসলাম মাও. হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. তাদায়ি [تداعي] এর সাথে তাহাজ্জুদের জামাত করতেন। ওলামায়ে দেওবন্দ এটাকে হযরতের তাফাররুদাতের মধ্যে শামিল করেছেন। পরের কেউ এ মত গ্রহণ করেন নি। মাও. তাকি উসমানি সাহেব দা.বা. এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যা ফাতাওয়া উসমানিতে সংযুক্ত হয়েছে।
তাহলে আযানের বিষয়টি হারদুঈ হযরত রহ. এর তাফাররুদাতের মধ্যে শামিল করাই যথোপযুক্ত হবে। ঠিক এ কথাটিই মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরি দা.বা. বলেছিলেন।
তাফাররুদাতে কারো অনুসরণ না করাই শ্রেয়। কোনোক্রমেই তাফাররুদাত অনুযায়ী ফতোয়া দেওয়া যাবে না।
সকল পথ ও মতের ইমামদের থেকেই কিছু-না-কিছু তাফাররুদাত প্রকাশ পেয়েছে; সেগুলো বাদ দিয়ে ইজমায়ী বা ঐকমত্যপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা দরকার। আজ অনেকেই দেখি, ওই তাফাররুদাত আঁকড়ে রেখেছেন। কাজটি মোটেও ঠিক হচ্ছে না।
আকায়েদ, হাদিস, ফিকহ, সিয়াসত বা রাজনীতি সকল পথের ইমামদের তাফাররুদাত পরিহার করা একান্ত কর্তব্য। তাফাররুদাত প্রতিষ্ঠা করা কোনো মুমিনের জীবনের মিশন ও ভিশন হতে পারে না।
أخيراً : اقول
من نظر في سيرة ابن تيمية واطلع على كتبه شهد بعظمته في علمه ودينه وجهاده ، وأما ما يتعلق ببعض فتاويه التي تفرد بها فكل إنسان يؤخذ من قوله ويترك ، وهنا نعيد كلمة الحافظ ابن حجر العسقلاني رحمه الله تعالى :
فالذي أصاب فيه وهو الأكثر يُستفاد منه ويُترحم عليه بسببه ، والذي أخطأ فيه لا يُقلَّد فيه ، بل هو معذور .
والله تعالى أعلم
والحمد لله رب العالمين
এটাও পড়তে পারেন
কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ
খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...