ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের প্রাদেশিক নির্বাচন অর্থাৎ, বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এখনো নির্বাচনের শিডিউল ঠিক হয়নি। কিন্তু ইতোমধ্যে ওই নির্বাচনকে মাথায় রেখে ‘সঙ্ঘ পরিবারের’ মুসলমান বা ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা ও হুমকি দেয়া শুরু হয়ে গেছে। ‘মুসলমানদের ভারত থেকে বের করে দেয়া হবে’, ‘মুসলমান উৎখাতের ডাক’ অথবা ‘ভারতকে মুসলিম মুক্ত করা হবে’ ইত্যাদি বলে হুমকি দেয়া শুরু হয়ে গেছে। আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ মানে, সঙ্ঘ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এর ঠাকুর বা সাধ্বী সদস্যরা এ রকম হুমকি দেয়া শুরু করেছে।
বিজেপি ইসলামবিদ্বেষী দল, ইসলামবিদ্বেষ মূল রাজনৈতিক পুঁজি। উসকানি দিয়ে দলটি হিন্দুত্ব জাগাতে চায়, যে শুড়শুড়িতে দলের ভোটের বাক্সে বরকত আসবে। এই হল ফরমুলা। এ ছাড়া সঙ্ঘ পরিবারে অন্তর্ভুক্ত সব সামাজিক, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক সংগঠনের লক্ষ্যও ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানো। বিশেষত যেকোনো রাজ্যে নির্বাচনের আগে ইসলামবিদ্বেষী প্রপাগান্ডা এই প্রতিষ্ঠানগুলো এক বিশেষ প্যাটার্ন মেনে করে থাকে।
সাধারণভাবে বিজেপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো ইসলামবিদ্বেষ প্রচার করলেও নির্বাচনের আগে এমন প্রচারের সুনির্দিষ্ট ধরন দেখা যায়, তবে প্রথমত এই বিদ্বেষ প্রচার এমনভাবে এমন ভাষ্যে করে যেন ফলাফলে সে বক্তব্য ট্রানস্লেট হয়ে ভোটের বাক্স ভরে ওঠে। যেমন সদ্যসমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের বিধানসভা নির্বাচনে যে পদ্ধতিতে ইসলামবিদ্বেষ প্রচার করা হয়েছে সে পদ্ধতি মেনে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের আগে প্রচার করা হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ বা আসামের নির্বাচনের বেলায় কখনোই বলা হয় নাই যে ‘ভারতকে মুসলমানমুক্ত করা হবে’। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে যেভাবে ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে একই সময় ঘটা আসামের নির্বাচনে সেভাবে ছড়ানো হয় নাই।
অনেকে মনে করেন মুসলমান জনসংখ্যা বেশি থাকলেই ইসলামবিদ্বেষী বিজেপির জিত ঠেকানো যায় এ ধারণা ভিত্তিহীন। আসামে মুসলিম জনসংখ্যা ৩৪ শতাংশ । তা সত্ত্বেও বিজেপি একাই এই প্রথম আসামে জিতেছে। বিজেপি গতবারের মানে ২০১১ সালের মাত্র পাঁচ আসন থেকে এবার এক লাফে একাই ৬০ আসন পেয়েছে, যেখানে মোট আসনসংখ্যা ১২৬। ফলে নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি কে কী নেবে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান ভোটার সংখ্যা আসামের থেকে কম, প্রায় ৩০ শতাংশ । অথচ মমতার সঠিক কৌশলের কারণে এই ৩০ শতাংশ ভোটকে পুঁজি করে মোট আসনের ৭২ শতাংশ মমতা নিজের পক্ষে আনতে সক্ষম হয়েছে। মোট ২৯৪ আসনের মধ্যে একাই তৃণমূল ২১১ আসন নিজের পক্ষে এনেছে। অর্থাৎ নির্বাচনে জিততে মুসলমান জনসংখ্যার সাথে অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলোকেও যদি সঠিকভাবে বিবেচনায় রাখা যায় তবে মমতার মতো ফলাফল আসতে কোনো সমস্যা হয় না। আর তা না পারলে আসামের মতো ৩৪ শতাংশ মুসলমান ভোটার থাকা সত্ত্বেও করুনভাবে হারতে হতে পারে।
আসামে বিজেপি কেন ক্ষমতায় আসতে পারল এর পেছনে প্রধান কারণ বলা হচ্ছে, বিজেপি এবারের নির্বাচনে প্রধান ইস্যু বানাতে সক্ষম হয়েছিল অনুপ্রবেশ ইস্যুকে। স্পষ্ট করে বললে, বাংলাদেশ থেকে তথাকথিত মুসলমান বাঙালি অনুপ্রবেশকারী, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে তাদের ফেরত পাঠাতে হবে এই দাবি। এটা ঠিক যে ১৯৪৭ সালের আগে সেই ভাসানীর আমল থেকেই লাইনপ্রথা, বাঙালি প্রবেশ ইস্যু আছে। বাংলাদেশ থেকে ইকোনমিক মাইগ্রেন্টরা আসামের পাহাড়ি ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে পাহাড়ের বাসিন্দা বোরো জনগোষ্ঠীর আবাস এনক্রোচ করে আরো পাহাড়ে ওপরে উঠিয়েছে। কিন্তু বহু বিতর্কের পরে এখন সব পক্ষই একমত যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে কাট-অফ লাইন ধরে এর পরে কেউ যদি বাংলাদেশ থেকে আসামে গিয়ে থাকে তবে তাকে ফেরত পাঠানো হবে। এটাই অনুপ্রবেশকারীর চেনার ভিত্তি। ভারতের সুপ্রিম কোটের সিদ্ধান্তও তাই। কিন্তু সে জন্য আইডেনটিফিকেশনের কাজ কখনোই শেষ করা হয়নি।
অনেকেরই ধারণা, চিহ্নিতকরণ শেষ হলে খুব বেশিসংখ্যক মানুষ আইডেনটিফাইয়েড হবেন না। তবে যেকোনো সীমান্ত এলাকায় যেমন চাকরি বা সুবিধাজনক পেশার কাজ পাওয়ার সূত্রে ইকোনমিক মাইগ্রেশন দেখা যায় । তেমন সীমিত জনসংখ্যা আসামে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রায় সব পক্ষই নানান উছিলায় চেয়েছে এই ইস্যুটাকে জিইয়ে রাখতে স্থানীয় রাজনীতিতে, পেটিস্বার্থে ব্যবহার করতে। তবে এই নির্বাচনে বিজেপির সফলতা এটাই যে আসামের সব সমস্যার মূল কারণ হল ‘অনুপ্রবেশ’ এবং সেটা না জানি এক বিরাট সংখ্যা এই অনুমান দলটি প্রতিষ্ঠা করেছে। যেন অনুপ্রবেশ ইস্যু মিটে গেলেই আসামের বাসিন্দাদের কাজ পাওয়া থেকে শুরু করে উন্নত জীবনযাত্রার মান সবই হাতে এসে যাবে।যা হোক, সার কথা হলো, কখনো কেন্দ্র এই চিহ্নিতকরণ প্রকল্পে টাকা দেয় নাই, কখনো টাকা বরাদ্দ দিলেও কাজে অগ্রগতি নেই এসব নানান কারণে ও অজুহাতে ইস্যুটা জিইয়ে থেকেছে।
অনুপ্রবেশ ইস্যুর সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্টতার দিক থেকে পাহাড়িদের সাথে থাকলেও গোটা আসামের ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তো এবারের নির্বাচনে এই প্রথম পাহাড়ি বোরোদের এবং স্থানীয় অসম গণপরিষদ বা অগপ সমতলি অসমীয়দের অ্যালায়েন্সের নির্বাচন হলো। এই অ্যালায়েন্সের ঘটক হলো কেন্দ্রের বিজেপি। আর উপায় হলো হিন্দুত্বের স্লোগান, যেটা হাজির করা হয়েছে অনুপ্রবেশ বিরোধী বক্তব্য দিয়ে। অনুপ্রবেশ হলো মূলশত্রু। কারণ অনুপ্রবেশ মানে মুসলমান। আকার-ইঙ্গিতপূর্ণ অর্থ সাজিয়ে এমন বয়ান হাজির করা হয়েছে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অর্থাৎ এই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরে যিনি মুখ্যামন্ত্রী হলেন সর্বানন্দ সনোয়াল। মূলত অগপ-এর নেতা ছিলেন, অনুপ্রবেশ ইস্যুতে যে ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল সেই যুবছাত্র আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতা । তিনি ২০১১ সালে বিজেপিতে যোগ দেন। বিগত ২০১৪ সালের মোদির নির্বাচনেরও আগে বিজেপির সাথে অগপ-এর অ্যালায়েন্সের ফলে মোদির পক্ষে এ নেতা কাজ করেন। আসামে বিজেপির ভোটের শতকরা হার বাড়াতে ভূমিকা রাখেন। আর সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি মোদি সরকারের কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী হন। এবার কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হন।
আসামের রাজনীতিতে উগ্র-অসমীয় জাতীয়তাবাদ এখনো তুঙ্গে, আর অনুপ্রবেশের বিরোধিতা এটাও উগ্র হয়ে ওঠার পক্ষে ঘি ঢেলেছে। বিজেপি সেই স্থানীয় ভাষায় খিলঞ্জিয়া বা আদিবাসী অসমীয় (অসমীয় হিন্দু ও মুসলমানসহ) আইডেনটিটি সেই ধারণাটাতে হাওয়া দিয়েছে। আর ঠিক এসবের বিপরীতে হলো আসামের কংগ্রেসের বাইরের রাজনৈতিক দল বদরুদ্দিন আজমলের অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ) দল। এটি মূলত আসামে মুসলমান ভোটারের দল। বিগত ২০০৫ সালে আগের ‘মাইগ্রেশন আইন সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ’ বলে রায় দেয়ার প্রেক্ষিতে বদরুদ্দিন আজমল এই দলের জন্ম দেন। সেই থেকে এটা একটা আঞ্চলিক দল, সাধারণত কংগ্রেসের সাথে সেকুলারিজমের জোটবদ্ধতা করে থাকে। সর্বসাকুল্যে তার দলের প্রাপ্ত কনস্টিটুয়েন্সি বা মোট আসন ১৮ (২০১১-এর নির্বাচনে) আর এবারের নির্বাচনে কমে ১৩ তে দাড়িয়েছে , যেখানে আসামের মোট আসনসংখ্যা ১২৬। কিন্তু এবারের বিজেপির অ্যান্টি-মুসলমান (অনুপ্রবেশ) ও অসমীয় ‘খিলঞ্জীয়’ আইডেনটিটি এর ভোট কৌশলের বিপরীতে আজমলের অবস্থা শোচনীয়। বিজেপি মানে করে যেন ওই দুই আইডেনটিটির বিরুদ্ধে আজমল বড় বাধা। এ দিকে আবার এই পরিস্থিতিতে তিনি যেসব নির্বাচনী বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছিল। আসামে সরকার গড়তে লাগে ৬৪ আসন। তিনি দাবি করেছিলেন, তিনি নির্বাচনে ৩০ আসনের কাছাকাছি সংগ্রহ করে সরকার গঠনে নির্ধারক হয়ে উঠতে যাচ্ছেন। এর ফল হয়েছিল উল্টো। হিন্দুরা ভয় পেয়ে বিজেপিকে ভোট দেয়া নিশ্চিত করেছিল যেন আজমল কোনো নির্ধারক ফ্যাক্টর না হয়ে যান।
এবারের ভোটের বুথ ফেরত জরিপে দেখা গেছে, নির্বাচনে মোট হিন্দু ভোটারের ৬৩ ভাগ বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। বিপরীতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারকে দিয়েছে ২৪ ভাগ হিন্দু ভোট। গত ২০১১ সালের নির্বাচনে এই হার ছিল কংগ্রেসে আর বিজেপি প্রায় কাছাকাছি কংগ্রেস ৩৯ শতাংশ আর বিজেপি ৪৩ শতাংশ। ফলে কৌশল ও হাওয়া না বোঝা আজমল তার গতবারের ১৮ আসন এবার নেমে কোনোমতে ১৩তে টিকেছে। আবার আজমল এবং কংগ্রেস এই দুইয়ের মধ্যে মুসলমান ভোট ভাগ হয়েছে শুধু নয়, বরং অনেক কনস্টিটুয়েন্সিতে এই দুই দলের লড়াইয়ের ফাকে বিজেপির প্রার্থী জিতে গেছে। এক কথায় বললে, আজমলের প্রতিটা কৌশল বিজেপির পক্ষে গেছে। বিজেপি যেখানে কেন্দ্রের বা সর্বভারতীয় দল হয়েও আঞ্চলিকতার ওপর ভারকেন্দ্র রেখেছে, আঞ্চলিক আইডেনটিটির ওপর জোর দিয়েছে, হিন্দু পরিচয়ের ওপর জোর দিয়েছে সেই পরিস্থিতিতে মুসলমান পরিচয়কে মুখ্য করে বিজেপি ঝড় মোকাবেলা অসম্ভব শুধু না, তা বিজেপির পক্ষে গেছে।
এর বিপরীতে আমরা যদি তুলনা করি, মমতার তৃণমূলে পশ্চিমবঙ্গের ৩০ ভাগ মুসলমান ভোটারের সবচেয়ে বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। সিপিএম অথবা মুসলিম লিগের প্রার্থীকেও মমতা নিজের দলে এনে প্রার্থী করে জিতিয়ে এনেছেন। কিন্তু বিশেষ দিক হলো তিনি মূলত হিন্দু বলয়ের কনস্টিটুস্টেন্সির। সেটা টিকিয়েই তিনি একই সাথে মুসলমান ভোট নিজের ব্যাগে পুরেছেন। ত্যাগ করেননি। নির্বাচনী প্রপাগান্ডায় মুসলমান ইস্যু আনেননি। কিন্তু যা করার সাংগাঠনিক পর্যায়ে ঠিকই করেছেন। এতে মমতা প্রমাণ করেছেন বিজেপির নির্বাচনী কৌশলের বিপরীতে সঠিক নির্বাচনী কৌশল একমাত্র তারটাই সঠিক এবং সবচেয়ে কার্যকর।
আবার বিজেপির হিন্দু ভোটের জিগির তোলাও যে সবখানে কার্যকর তাও না। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ বিহার। যত বেশি হিন্দুত্ব আর গরুর গোশত নিষিদ্ধের ড্রাম বাজিয়েছিল বিজেপি ততই সেখানে তার গো-হারা হার হয়েছে। সম্ভবত এর মূল কারণ স্থানিয় জনগোষ্ঠীর কমবিনেশন। সামনে যে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের কথা বলছিলাম সেখানেও জনগোষ্ঠীর কমবিনেশন প্রায় একই রকম। ফলে এখানে বিজেপির হিন্দুত্ব কৌশল বিহারের মতোই ধরাশায়ী হতে পারে। যদিও কোনো দলই এখনো তাদের কৌশল হাজির করেনি।
সূত্র : অন্যদিগন্ত