পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামের প্রতি আকর্ষণ ও ইসলাম গ্রহণের হার ক্রমেই বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলাম এখন দেশটির সমাজ ও সংস্কৃতির অন্যতম অংশ। যারা ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। মার্কিন নওমুসলিম ‘মনিকা ওয়েট’ এইসব সৌভাগ্যবান মার্কিন নারীদের একজন।
‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট’ বা ‘ওয়ালস্ট্রিট দখল কর’ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে খ্যাত মার্কিন নওমুসলিম ‘মনিকা ওয়েট’ ইরানে উপস্থিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসেই ঘটেছে এই শুভ ঘটনা। মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীতে ছয় মাস কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে মনিকার। বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে গবেষণা ও যাচাই-বাছাইয়ের পর ইসলামে দীক্ষিত হয়েছেন এই মার্কিন মহিলা। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি নিজের নতুন নাম রেখেছেন ‘নার্গিস’। কিভাবে মুসলমান হয়েছেন তা তুলে ধরতে গিয়ে নওমুসলিম নার্গিস বা সাবেক ‘মনিকা ওয়েট’ বলেছেন:
“বেশ কিছু দিন ধরে একটা প্রশ্ন আমার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। প্রশ্নটা হল, কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আমাদের ধর্মে তথা খ্রিস্ট ধর্মে ভবিষ্যত ও জীবন-পদ্ধতি সম্পর্কে গুরুত্ব দেয়া হয় না? পাশ্চাত্যে আমাকে বলা হতো- শক্তিমান হও, উপযুক্ত পেশা বা চাকরি বেছে নাও, উত্তম জীবনের অধিকারী হও, আদর্শ স্বামী ও সন্তানের অধিকারী হও। কিন্তু এসব কাজের উদ্দেশ্য কী তা আমাকে কেউ বলত না। এ অবস্থায় একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কুরআনের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এরপর অনুভব করলাম যে আমার জন্য খ্রিস্ট ধর্মের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে এবং এ ধর্ম আমার ইচ্ছা বা চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছে না ও দেখাতে পারছে না কোনো স্পষ্ট বা উজ্জ্বল ভবিষ্যত, অথচ এই ভবিষ্যত ইসলামে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ইরানে উপস্থিত হওয়ার পর আমি নিজকে নিয়ে ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আরো বেশি চিন্তা-ভাবনার সুযোগ পেলাম। জীবনের মূল উদ্দেশ্য কী এবং কেনই বা সর্বোত্তম পন্থায় জীবন যাপন করব- এইসব প্রশ্নই আমাকে ইসলামের প্রতি উৎসাহিত বা আকৃষ্ট করেছে।”
যেসব বিষয় ইসলামকে অন্য ধর্মগুলোর চেয়ে বেশি মহিয়ান করেছে, সেসবের মধ্যে নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের অবসান অন্যতম। ইসলাম জাতি, বংশ, নারী-পুরুষের পার্থক্য-ভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বকামিতাকে ধ্বংস করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী, পুরুষ, ধনী-গরিব, সাদা-কালো এবং সুদর্শন ও অসুদর্শন মানুষ সবাই সমান।
একমাত্র খোদাভীতি, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক গুণাবলী-এসবই শ্রেষ্ঠত্বের সত্যিকার মানদণ্ড। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন: “হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক প্রিয় যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।”
নারী সম্পর্কে ইসলামের বিধানগুলো নির্ভুল ও সুশৃঙ্খল এবং এক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধগুলো সর্বোচ্চ মাত্রায় রক্ষা করা হয়েছে। এভাবে ইসলাম নারীকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং তাকে দেখিয়েছে প্রকৃত মর্যাদার পথ।
মার্কিন নওমুসলিম নার্গিস বা সাবেক ‘মনিকা ওয়েট’ এ প্রসঙ্গে বলেছেন : “যেসব বিষয় ইসলাম সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করতে আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে নারীর প্রতি মানুষের আচরণের ধরন ও বিশেষ করে নারীর প্রতি ইরানি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণ। যখন মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিলাম তখন পেশাগত প্রয়োজনে ইরানের সঙ্গে পরিচিত হই। এ সময় আমি ইরান সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করে এটা বুঝতে পেরেছি যে, নারীর সঙ্গে ইরানিদের দৈনন্দিন আচরণ নারীর প্রতি পশ্চিমাদের আচরণের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নারীরা কেন ইরানে এত সম্মানিত তার কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি ইসলামকে আবিস্কার করেছি। এ ধর্মের কারণেই মানুষের দৃষ্টিতে নারী এতটা মর্যাদা, সম্মান ও শক্তিমান সত্তা হিসেবে বিবেচিত হয়।”
মার্কিন নওমুসলিম নার্গিস বা সাবেক ‘মনিকা ওয়েট’ অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি তার দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রসঙ্গে বলেছেন, “বর্তমানে আমেরিকায় যা ঘটছে তা সাগরের একটি বিন্দু বা ফোঁটা মাত্র। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে আরো বড় ধরনের ও ব্যাপক ফলদায়ক অনেক ঘটনা ঘটবে। মার্কিন জনগণ তাদের সরকারের নানা নীতি এবং সম্প্রসারণকামী ও কর্তৃত্বকামী নানা খাহেশ মেটানোর কাজে জনগণকে বর্ম হিসেবে ব্যবহারের নীতির ব্যাপারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। আর এইসব ক্ষোভই তারা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করছে।”
ইসলাম সঠিকভাবে জীবন যাপনের নিয়ম শেখায়। এ জন্যই এ ধর্ম জীবনের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর আদর্শ। কিন্তু পাশ্চাত্য নানা স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসলাম সম্পর্কে ভুল ও অস্পষ্ট নানা ধারণা প্রচার করেছে যুগে যুগে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন নওমুসলিম নার্গিস বা সাবেক ‘মনিকা ওয়েট’ বলেছেন, “আমি নিজের চোখে ইরান ও ইসলাম সম্পর্কে বাস্তবতাগুলো দেখার পর এটা বুঝতে পারি যে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো কত বিকৃতভাবে ইসলাম সম্পর্কে অবাস্তব চিত্র তুলে ধরছে। তাই আমি এইসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি এবং ইরানে দাঁড়িয়েই পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা ঘোষণা করছি। আমি ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনের জন্য আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করব।”
বিশিষ্ট ইংরেজ লেখক হার্বার্ট জর্জ ওয়েলস বলেছেন, “ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা নিয়ে প্রত্যেক মর্যাদাবান মানুষ গর্ব করতে পারে। একমাত্র এ ধর্মই সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে অবগত ও সর্বত্র সভ্যতাযুক্ত যা আমি বার বার বলেছি।”
মার্কিন নওমুসলিম নার্গিস বা সাবেক ‘মনিকা ওয়েট’ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পেরে গর্ব অনুভব করছেন। তিনি বলেছেন, “ইসলামকে ধর্ম হিসেবে মনোনীত করতে পেরে আমি এখন খুবই খুশি। কারণ, এ ধর্ম মানবীয় সব চাহিদাগুলো মেটাতে সক্ষম। আমি আশা করছি ইসলামী বিধানগুলো মেনে চলা ও কুরআন থেকে অনুপ্রেরণা নেয়ার মাধ্যমে একজন সত্যিকার মুসলমানের মত জীবন যাপন করতে পারব।”
পাশ্চাত্যে বস্তুবাদের জোয়ার এবং নৈতিকতাহীনতা ও আধ্যাত্মিক শূন্যতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সেখানে ইসলামের আকর্ষণ ক্রমেই বাড়ছে। কারণ, একমাত্র ধর্মবিশ্বাসই আধুনিক যুগের সংকটগুলোসহ মানবজাতির সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “মানুষ বস্তুগত সমৃদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছার পরও যদি জুলুমপূর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করে, মানুষের মধ্যে যদি বলদর্পিতাই প্রতিষ্ঠিত থাকে ও দুর্বলদের অধিকার পদদলিত হয় শক্তিমানদের হাতে, বিশ্বে কল্যাণকর জ্ঞানের আলো আর মানবতা থাকে প্রভাবহীন, আর প্রতারণাই হয়ে পড়ে স্বাভাবিক রীতি তাহলে বলতে হবে মানবজাতি অজ্ঞতা এবং বিচ্যুতির মধ্যেই রয়ে গেছে। আসলে মানবজাতিকে মুক্ত করার জন্য ইসলামের চিরকল্যাণকর মুক্তির বিধানগুলো বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।”