ধর্মের ইতিহাস বিচারে প্রচলিত মার্কসীয় দৃষ্টিকোন যা কেবলই ধর্ম “কিভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে বিলম্বিত করেছিল অথবা শ্রেণী নিপীড়ন টিকিয়ে রাখার জন্য ভাবাদর্শিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল”–এ সম্বন্ধেই আলোকপাতে আবদ্ধ একটি গড়পড়তা অতি-সরলীকরন। মার্কস নিজেও আধুনিকতাপূর্ব মানবসমাজে সভ্যতার একধাপ থেকে অন্যধাপে অগ্রগতির ক্ষেত্রে ধমের্র গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন। সুতরাং এটা কেবল “ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিচার-বুদ্ধিহীন ভীতিই” নয় যা একটি শ্রেণী সমাজে গণমানুষকে ধর্মপরায়ণ করে তোলে। বরং এটি হলো সামাজিক সচেতনতার একটি বিশেষ রূপ, অথবা মার্কসের ভাষায় বললে, “সে মানুষের আত্মসচেতনতা যে হয় নিজেকে এখনও খুঁজে পায় নি নয়তো ইতিমধ্যেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে”। মার্কস অন্যত্র মন্তব্য করেন যে, ধর্ম অনেক সময় “বাস্তব দুর্দশার অভিপ্রকাশ এবং তার বিরূদ্ধে প্রতিবাদও হয়ে উঠতে পারে”। কাব্যদীপ্ত ভাষায় অসাধারণ সংবেদ ও সুক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টিজাত সারমর্ম ব্যক্ত করেছেন এভাবে, “নিপীড়ত সৃষ্টিজীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়”। দীর্ঘশ্বাস ছাপিয়ে হৃদয়ের অধিষ্ঠান তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। হৃদয় মানুষের, পরমার্থিকতা উদয়ের।
মার্কস-এঙ্গেলস এর প্রত্যয় অনুসারে একটি ধর্ম যে জাতির মধ্যে উদ্ভূত হয়েছে, যে বিশেষ প্রথা-পদ্ধতি এবং আচার অনুষ্ঠান ঘিরে চর্চিত হয় তা থেকে আলাদা করলে, আশ্রিত সাংস্কৃতিক প্রকাশের খোলস ছাড়িয়ে বাইরে নিয়ে আসলে তার একটি বৈশ্বিক রূপ ধরা পড়বে। ভাবাদর্শিক পর্যায়ে একটি বিশ্বধর্ম যে সমাজিক গড়নের মধ্যে উদ্ভূত হয়েছে তা-থেকে শুধুমাত্র একটি বিবেচ্য-মাত্রার স্বাধীন সক্রিয়তাই ভোগ করে না বরং এটি সমাজের একটি উপাদান হিসাবে বিরাজ করা সত্ত্বেও ঐ সমাজের সামাজিক সম্পর্কসমূহের মধ্যে চুড়ান্ত রূপান্তরের ক্ষেত্রে একটি বস্তুগত-শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে যেকোনো চিন্তা বা আদর্শ মানুষের মনজয় করে একটি বস্তুগত নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠতে পারার যে ধারণা মার্কস পোষণ করতেন তা স্মরণ করা যেতে পারে। হেগেলের অধিকার দর্শন পর্যালোচনার ভূমিকায় এই আলোচনা তিনি করেছেন। ধর্মকে– আইনী, রাজনৈতিক এবং ভাবাদর্শিক চরিত্রের অন্যান্য সামাজিক সম্পর্কসমূহের মতোই কেবলমাত্র উপরিকাঠামোর সাথে সম্পর্কিত বলে দ্বিবিভাগ করা এবং সেই বিভাজনজনিত পৃথকীকরণের বরাতে উৎপাদন সম্পর্কসমূহের অন্তর্গত কোনো বিষয় হিসাবে না দেখাটা স্পষ্টতই ভ্রান্তিমূলক এবং মার্কসীয় পদ্ধতি সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ।
মার্কসীয় কাঠামোর মধ্যে একটি বিশ্বজনীন ধর্মকে দুনিয়াতীত ধ্যান-ধারণা, আবেগানুভুতি ও ভাব প্রকাশের একটি পদ্ধতি যা ইতিহাসের উত্তুঙ্গ সন্ধিক্ষণে সামনে চলে এসেছে বলে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। তবে ধর্মের ধ্যান-ধারণা এবং চিন্তা-ভাবনাসমূহ পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং সামাজিক সম্পর্ক সমূহের বিভিন্ন ধরনের বিকাশের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিনিয়তই সারবত্তা এবং গঠন উভয় দিক দিয়েই পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনসমূহ উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে ঘটে চলা আমূল রূপান্তরের ফলে উদ্ভূত নতুন সামাজিক নীতিমালার সাথে শুধুমাত্র পুনরায় খাপ খাওয়ানোর দিকেই ঝোকে না, বরং তাদের রূপ রূপান্তরেও অংশগ্রহণ করে। যেমন এঙ্গেলস বিশ্বজনীন ধর্মগুলোর উত্থানকে, বিশেষত ‘‘ইসলাম ও খিস্ট্রধর্মের বেলায় তা ধর্মীয় আবরনে একটি ঐতিহাসিক লড়াই সংগ্রামের অভিব্যক্তি’’ বলেই ব্যাখ্যা করতে বেশি পছন্দ করতেন। এ ব্যাপারটা আরও স্পষ্টরুপে দেখা যায় এশীয় সমাজসমুহের ইতিহাসে। একারণেই মার্কস প্রশ্ন তুলেছিলেন “প্রাচ্যের ইতিহাস বারবারই ধর্মের ইতিহাস হিসাবে হাজির হয় কেন?’’ এই প্রশ্নটি তুলে মার্কস মূলত বিভিন্ন ধর্মসমূহের নিজস্ব সভ্যতার সাথে সম্পৃক্ত সামাজিক ভূমিকার দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
উপরোক্ত তাত্ত্বিক ছকটি ইসলামকে বুঝার ক্ষেত্রে খুবই দরকারি। এবং মার্কসীয় দৃষ্টিকোন থেকে ইসলামের ন্যায় একটি বিশ্বজনীন ধর্মের ঐতিহাসিক বিচার করতে গেলে এটি যে সভ্যতার জন্ম দিয়েছে তারও একটি বিচার অবশ্যই করতে হবে। উল্লেখ্য, এঙ্গেলস খ্রিস্টধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সাথে ইসলামকেও বিশ্বজনীন ধর্মজ্ঞান করতেন।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের ইতিহাস এবং ইসলামি সভ্যতার চরিত্র নিয়ে ইতমধ্যেই প্রচুর লেখাজোখা হয়েছে। যাতে মার্কসীয় তত্ত্ব থেকে জারিত ও প্রচারিত বিভিন্ন ধারণা এবং প্রকরণ ব্যবহার করে বিভিন্নজন বিভিন্ন মতামতে উপনীত হয়েছেন। যেমন, একদিকে, A Short History of the World এর সোভিয়েত ঐতিহাসিকগন, যারা ইসলাম যে সামাজিক বিন্যাসের মধ্যে আবির্ভূত হয়েছিল– “আরব্য উপদ্বীপে সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কসমূহের উত্থান”, তাকে কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তারা ইসলামের প্রসারের মধ্যদিয়ে আরবদের একত্রীকরণকে এবং “যাযাবর ও স্থায়ী বাসিন্দা উভয়েরই সামন্তীয়করণ” প্রক্রিয়ার এপিঠওপিঠ হিসাবে দেখে থাকে। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে দূরপাল্লার-বাণিজ্য পেশার ভেতর দিয়ে জন্ম নেওয়া মক্কার বণিক সম্প্রদায়ের নিয়ামক চরিত্রটিকে সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং তা স্পষ্টতই ৭ম শতকের আরবীয় সমাজের সাথে সম্পর্কিত প্রকৃত সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয় নি। তাছাড়া এ মত মার্কস ও এঙ্গেলসের শুধুমাত্র ছড়ানো ছিটানো কয়েকটি মন্তব্যকে ধর্মতাত্ত্বিকভাবে ভর করে গঠিত। এসব মন্তব্যে অনেক সময় ইসলামী সভ্যতা প্রসারকালে এর অওতাধীন অঞ্চলসমূহে সামন্ততান্ত্রিকতার পথ-যোগানোর প্রতি অন্তস্থিত প্রবণতার দিকে ইংগিত করা হয়েছিল মাত্র। এ গোঁড়া মতের বিপরীতে মন্টেগোমারি ওয়াট এবং ম্যাক্সিম রুডিনসন-এর মতো প্রাচ্যতাত্ত্বিকরা খাঁটি তথ্যউপাত্তের উপর ভিত্তি করে এবং মার্কসীয় ধারণাসমূহ একটু উদারভাবে প্রয়োগ করে তাদের মতামত হাজির করেন। এই সমস্ত ঐতিহাসিকরা ইসলামকে ৭ম শতকে মক্কার উচ্চ বাণিজ্যিকিকৃত সামাজিক পরিস্থিতির উৎপন্ন হিসাবে দেখে থাকে। তারা ইসলামকে আরবের বেদুইন গোত্র সমূহের নৈরাজ্যকর বর্বরতার বিরুদ্ধে মক্কা মদীনার স্থায়ী বাসিন্দাদের একটি ভাবাদর্শিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। এই ব্যাখ্যানুযায়ী মক্কা-মদীনায় ইসলামী ক্ষমতার প্রতিষ্ঠালাভ এবং পর্যায়ক্রমে সকল আরবগোত্রের তা গ্রহণ করাকে গোত্রীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ– যার ফলে সমগ্র আরব সমাজ বৈষয়িক সংস্কৃতির এক নিম্ন পর্যায়ে স্থবির হয়ে ছিল, তার বিরুদ্ধে সভ্যতার আবেষ্টনে জড়িয়ে উন্নিতকরণ প্রয়াসী একটি শহুরে মতবাদের বিজয় হিসাবে চিত্রায়িত করা যায়। এটা স্পষ্টতই মক্কার বড় বড় ধনকুবেরদেরকে দমনের মধ্য দিয়েই মাত্র সম্ভব ছিল, যারা বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোচ্চুরি বিশেষ করে আরবের মধ্য দিয়ে পরিচালিত বহির্বাণিজ্যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েমের মাধ্যমে মাঝারি-পর্যায়ের এবং কম বিত্তবান বণিকদের শোষণ করতো।
মুসলিম ঘরানা থেকে আসা মার্কসবাদি এবং কতিপয় র্যাডিকাল উদারপন্থীর লেখা-জোখায়ও কমবেশি এরকম একটি ব্যাখ্যা দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে মোহাম্মদ হাবিব, আলি মোহাম্মদ ফাহমি, আহমদ আল কুদসি, এবং আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এসব লেখকদের ইসলামি ঐতিহ্যের উৎস সমূহের সাথে এবং কোরআন-উত্তর সময়কালে যেসব অঞ্চলে তা বিকশিত হয়েছে তার সাথে সরাসরি পরিচিতি রয়েছে। এছাড়াও তারা ইসলামি সমাজে হাল জমানায় চলতে থাকা মৌলবাদি বনাম প্রগতিশীলদের তর্ক-বিতর্ক সম্পর্কেও বেজায় ওয়াকিবহাল। এই সমস্ত লেখকদের কতিপয় ইসলামের মধ্যে নগর-সভ্যতার প্রতি উৎসাহ প্রদানের নির্ভুল প্রবণতার উপর জোরারোপের পাশাপাশি ইসলামি সামাজিক মূলনীতিসমূহের সাথে সমাজতন্ত্রের নৈকট্য দেখাতে চান।
এই সমস্ত বিচার বিশ্লেষণ মার্কস ও এঙ্গেলসের ইসলাম সম্পর্কিত ছড়ানো-ছিটানো মন্তব্য সমূহের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু কেউই মার্কস ও এঙ্গেলসের মন্তব্য সমূহের খুব বেশি পদ্ধতিগত বিচার-বিবেচনা করে নি। বিশেষ করে, এসব মন্তব্য কি ধরনের তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে গঠিত, কোন ক্রম এবং প্রেক্ষিতে এসব করা হয়েছিল এবং বিশেষ করে তারা যে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর জোর প্রদান করেছিলেন, যা তাদের ভিন্ন ভিন্ন উক্তিতে পরিলক্ষিত হয়, সেসব বিষয় সঠিকভাবে উপলব্ধি করার তাগিদে কোনো অনুসন্ধান চালানো হয় নি। অথচ এধরনের বিস্তারিত নিরীক্ষণ ছাড়া ইসলাম সম্পর্কে মার্কস ও এঙ্গেলসের সুক্ষ পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া সম্ভব নয় এবং ইসলামি সমাজের বিশ্লেষণে তাদের মেধাবী অর্ন্তদৃষ্টিও সঠিকভাবে ব্যাবহার করা যাবে না। এখানে আমরা মার্কস ও এঙ্গলসের চিঠিপত্র এবং বিভিন্ন লেখা-জোখায় প্রাপ্ত কিছু অতি পরিচিত মন্তব্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চেষ্টায় মনোযোগ দিব আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহতারাম ইকতিদার আলম খানের একটি লেখা আশ্রয় করে।
মার্কস ও এঙ্গেলস ইসলামি সভ্যতা সম্পর্কে অধ্যায়নে আগ্রহী হয়ে উঠেন ১৮৫৩ সালের দিকে, যখন তারা ইওরোপের বাইরের সমাজ সমূহের প্রাকপুঁজিতান্ত্রিক গড়ন এবং পশ্চিমা-পুঁজিতান্ত্রিক আগ্রাসনের মুখে তাদের বিলীন হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনুসন্ধান করার পদক্ষেপ নেন। ইসলাম সম্পর্কে তাদের প্রাথমিক ভাবনা মূলত গীবন কর্তৃক আরবদের ইতিহাস সম্পর্কিত লেখাজোখার উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। গীবনের লেখাজোখা তৎকালীন ইওরোপীয় প্রাচ্য-ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে, এক অর্থে সম্পূর্ণ আলাদা এক ধারার সূচনা করেছিল। আরবদের চরিত্র সম্পর্কে ইওরোপীয় প্রাচ্য-ব্যবসায়ীদের মুল্যায়ন তখনও পর্যন্ত “ইসমাইলের উত্তরসুরিদের স্বাধীনতা-প্রেমি রোমান্টিক ইমেজ এবং নৈতিকতা ও বিবেক বর্জিত স্বেচ্ছাচারি বর্বরদের” মধ্যে খাবি খাচ্ছিল। ইসমাইলের উত্তরসুরীদের অনুকুলে নবীত্ত্ব ও অলৌকিকতার ফল হিসাবে আরবরা অনন্ত মুক্তি উপভোগ করছিল, গীবন এই যাজকীয় মতামত ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। গীবন বলেন, আরবদের স্বাধীনতা প্রিয়তা কোনো নরগোষ্ঠীগত ব্যাপার নয় বরং তারা যে ভৌগলিক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতো তারই ফল ছিল। ইসলামের আবির্ভাবকালে মক্কার অর্থনৈতিক কাঠামোর বিশ্লেষণে তিনি মক্কার ভৌগোলিক অবস্থানের উপর জোর দেন সবচেয়ে বেশি। গীবনের মতে, মক্কা ছিল ইয়েমেনি বন্দরসমূহকে সিরিয়ার বসরা এবং দামাস্কাসের সাথে সংযোগকারি বাণিজ্যবহর চলাচলের মিলনস্থল। যেখানে বিনিময় বাণিজ্যের মধ্যদিয়ে প্রচুর ধন সম্পদের আমদানি হতো । তার মতে, ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে এমন একটি সমাজে যা বিকশিত হয়েছিল আরব ও ইয়েমেনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পূর্ব-পশ্চিমের বাণিজ্যের মধ্যদিয়ে। সুতরাং ইসলামকে কোনো আধা-বর্বর বেদুইনদের সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি হিসাবে নয় বরং আরব জাতিকে সভ্যতার একটি উচ্চস্তরে ঐক্যবদ্ধকারি হিসাবে পাঠ করতে হবে।
মার্কস ও এঙ্গেলস গীবনের এসব মতামত সম্পর্কে কিছুটা সহানুভুতিশীল ছিলেন বলে মনে হয়। তবে এ পর্যায়ে মার্কস প্রধানত মুসলিমদের শাসনাধীন অঞ্চলসমূহে ইসলামি প্রতিষ্ঠানাদির আর্থসামাজিক গতিধারা সম্পর্কে অনুসন্ধানে মনোযোগ দেন। অন্যদিকে এঙ্গেলস মূলত ইসলমি বিশ্বাসের সামাজিক উৎস এবং বিশ্ব-ইতিহাসে এর কি ভূমিকা সে বিষয়ে অনুসন্ধানে নিবিষ্ট হন। এ বিষয়টি ১৮৫৩ সালে তাদের কয়েকটি চিঠিপত্র থেকে জানা যায়।
মার্কসকে লেখা ১৮৫৩ সালের ১৮ মে তারিখে একটি চিঠিতে এঙ্গেলস চার্লস ফস্টারের The Historical Geography of Arabia বইটি পাঠ করে যেসব সিদ্ধান্ত টানেন সে বিষয়ে আলোচনা করেন। বইটি ছিল বিভিন্ন স্থানের নাম, গোত্রীয় বংশবৃত্তান্ত, প্রাক-ইসলামি শিলালিপি– যেগুলি মাত্র কয়েকবছর আগে ইয়েমেনে পরিচালিত একটি ইন্ডিয়ান নৌ-অভিযানের সময় আবিস্কৃত হয়, সেসবের বিস্তারিত পাঠ সম্বলিত। বইটিতে প্রাচীন খ্রিস্টান এবং গ্রীক উৎস সমূহ হতে প্রচুর সাক্ষ্য প্রমাণের সহায়তা নেয়া হয়েছিল। যাইহোক, এঙ্গেলস বইটির একটি ভাসাভাসা পাঠ থেকে কয়েকটি অনুমানমূলক সিদ্ধান্ত টানেন যার উপর ভিত্তি করে তিনি তার ইসলামি ঐতিহ্য সম্পর্কিত মুল্যায়নটি হাজির করেন। তার বিশ্লেষণের কেন্দ্রীয় বক্তব্য ছিল “মোহাম্মদের ধর্মীয় বিপ্লব ছিল অন্যান্য ধর্মীয় আন্দোলনগুলোর মতোই একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া, এবং সেই পুরোনো ও স্বাভাবিকের দিকে একটি কথিত প্রত্যাবর্তন”। তিনি ইসলামকে খ্রিস্টান ধর্ম এবং ইহুদী ধর্মেরও পূর্ববর্তী সময়কালের আরবদের বিস্মৃত সেই পুরোনো একেশ্বরবাদি ঐতিহ্যের পুনরুত্থান হিসাবেই চিত্রায়িত করেন। ইসলামকে বিশ্বজনীন প্রাসঙ্গিকতাহীন একটি ‘কৃত্রিম’ ধর্ম হিসাবে বিবেচনা করা এবং উর্বর চন্দ্রভূমি(ফারটাইল-ক্রিসেন্ট) অঞ্চলে প্রাক-ইসলামি বসতি স্থাপন এবং ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে আরবদের বিপুল প্রসারের মধ্যে গুণগত তফাৎ না করাকে মার্কস কখনই পুরোপুরি অনুমোদন করেন নি। যা মার্কসের ১৮৫৩ সালের ২ জুনে এঙ্গেলসকে লেখা চিঠিটি থেকে জানা যায়। সেখানে মার্কস এঙ্গলসকে যেই সামাজিক গড়নের মধ্যে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল তার রূপদানে আন্তদেশীয় বর্হিবাণিজ্যের গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। মার্কস গীবনের চমৎকার অন্তদৃষ্টিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আরও বলেন যে, ইওরোপ থেকে এশিয়ার বাণিজ্যিক গমনাগমন পথ পরিবর্তনের ফলে যে ব্যাবসায়িক অবনতি দেখা দিয়েছিল তাও ইসলামের আবির্ভাবের ক্ষেত্রে একটি গুরুতপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ইসলামি সম্প্র্রসারণের ফলে উর্বর চন্দ্রভূমিতে বড় বড় নগরের উত্থানের ঘটনা, যা নগর সভ্যতার প্রতি উৎসাহ প্রদানে ইসলামের অন্তর্গত স্বভাবের ইংগিত করে। এর সাথে মিলিয়ে মার্কস ফ্রাসোয়া বার্নিয়ারের মুঘলদের সময়কালের বিশাল বিশাল নগর সমূহের পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করেন। মার্কস এঙ্গেলসের ব্যাবিলনের উত্থানকে ব্যাপকহারে ক্রমবর্ধমান পণ্য উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে গঠিত ৭ম এবং ৮ম শতকের মুসলিম সভ্যতাকে ইউফ্রেতিসের উপত্যকায় আরবদের আগমনে জেগে ওঠার সাথে তুলনায় একমত পোষণ করেন নি। মার্কস বার্নিয়ারের ‘‘প্রাচ্যের নগরসমূহ’’ এবং মোঘল সামরিক ব্যবস্থার উপর লেখাজোখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, ইসলামি ঐতিহ্যের শিকড়ে প্রথিত রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার ফলে এশিয়ার সর্বত্রই উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া একটি নগরায়ন ঘটেছে। আরব তুর্কি মোগল যে শাসকই হোক না কেন। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, মার্কস ইসলামের ইতিহাস বিচারে এঙ্গেলস থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করছেন। তিনি বলেন যে, ইসলামী সভ্যতার প্রকৃতি অনুসন্ধানে ইসলামের উত্থানে অবদান রাখা প্রাক-ইসলামি চিন্তাধারা ও সামাজিক প্রবণতা সমূহের উপর গুরুত্ব না দিয়ে বরং ইসলামি শাসন ব্যবস্থার অধীনে যে সামাজিক প্রক্রিয়া এবং প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে উঠেছে সেসবের একটি সুক্ষ বিচারের মধ্য দিয়েই শুরু করতে হবে।
মার্কস তার ঐ পত্রে ইসলামি বিশ্বে কোনো “ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ত্ব ছিল না”, বর্নিয়ারের এই মত পুরোটাই অনুমোদন করে একেই ইসলামি সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হিসাবে আখ্যা দেন। কেননা এটিই ইসলামি সমাজে পরিলক্ষিত বিশেষ ধরনের সামাজিক গড়নের পিছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে; যা আদিম স্তর থেকে এশিয়ার সমাজিক উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছে এবং প্রাচ্য পশ্চিম ইওরোপ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক গতিপথ অনুসরনে করে। এই সময় মার্কস বার্নিয়ার এবং পরবর্তীতে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কতিপয় কর্মকর্তা কতৃক পরিলক্ষিত “ভূমিতে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতি”কে ইসলামি শাসনের ফল হিসাবে আখ্যা দেন। ১৮৫৩ সালের ১৪মে তারিখে এঙ্গেলসের প্রতি অন্য একটি চিঠিতে মার্কস বলেন যে সমগ্র এশিয়াজুড়ে ভূমিতে কোনো সম্পত্তি না থাকার নীতিটা মুসলমানরাই সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিল। এসব মন্তব্য তিনি স্পষ্টতই বার্নিয়ার এবং অন্যান্যদের উপর নির্ভর করেই করেছিলেন। কিন্তু এসব লেখকরা ভারতবর্ষের ভূমি-সম্পর্কের বিচিত্র ধরন সম্পর্কে উপলব্দি করতে খুব বেশি সক্ষম ছিলেন না। মার্কস এবং এঙ্গেলসও মুঘল সাম্রাজ্যের রাজস্ব ব্যাবস্থার মূল দলিলপত্রসমূহ বা ভূমিতে বিভিন্ন ধরনের অধিকার নির্ধারণ করে দেয়া ইসলামি দলিদস্তাবেজ সমূহের কোনোটিই পড়ার সুযোগ পান নি। এবং এ কারণেই তাঁরা তাদের এই অশুদ্ধ মতামত আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পান নি। তবে মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের মতের ব্যাপারে কখনই গোঁড়া ছিলেন না, যা পরবর্তী লেখাজোখাতে স্পষ্ট হয়। তবে মার্কস ও এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে তারা যেই তর্কের লাইন ধরে এই ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন সে বিষয়ে একটি পর্যলোচনা করে নিলে ভাল হবে।
ইসলামি শাসনের ফল হিসাবে ভূমিতে ব্যাক্তি মালিকানার অনুপস্থিতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত টানতে গিয়ে মার্কস ইসলামি রাজনৈতিক তত্ত্বসমূহ বা এর আইনী নীতিমালা সমূহের অধ্যয়নের উপর নির্ভর করেন নি বরং তিনি শতশত বছরজুড়ে মুসলিম শসনাধীনে থাকা অঞ্চলসমূহের কিছু প্রশাসনিক দলিল-পত্রাদি ঘেটে ভূমিতে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি না থাকার বিষয়ে মন্তব্য করেন। ১৮৫৩ সালের ১৪মে তারিখের চিঠিতে মার্কস মোহাম্মদের অনুসারিদেরকে সর্বপ্রথম ভূমিতে সম্পত্তি না থাকার নীতি প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব দেয়ার পাশাপাশি এ মন্তব্যও করেন যে, যেসব অঞ্চলসমূহ সল্পসময়ের জন্য ইসলামি শাসনাধীনে ছিল সেসব অঞ্চলে আবার ভূমিতে সম্পত্তির অস্তিত্ব দেখা যায়। এথেকে বুঝা যায় যে মার্কস এ বিষয়টি পরিস্কার করতে চাচ্ছেন যে ভূমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উপস্থিত থাকার বিষয়টি শুধুমাত্র ভারতের ঐসব অঞ্চলের সাক্ষপ্রমানসমূহে পাওয়া যায় যেসব অঞ্চল অপেক্ষাকৃত কম সময়ের জন্য ইসলামি শাসনাধীনে ছিল। যেমন বাংলা ও বিহার যেখানে একটি লম্বাসময় জুড়ে ইসলামি শাসন ছিল, মার্কসীয় পাঠ অনুযায়ী এসব অঞ্চলে লক্ষনীয়ভাবে ভূমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতি ছিল। এভাবে মার্কস মনে হয় মুসলিম শাসনাধীনে বিরাজিত এশীয় ধরন নামক সামাজিক গড়ন সমূহকে প্রাচ্যজগতের বাকি অঞ্চল থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। এই গড়ন সমূহের প্রধান চরিত্র ছিল কৃষক স¤প্রদায়ের উপর একটি বিছিন্ন ক্ষুদ্র শাসক-গোষ্ঠীর জন্য কৃষির উৎপাদনে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি নিশ্চিত করা এবং আত্মসাৎ করে একটি স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো বজায় রাখা। এরকম একটি পরিস্থিতিতে কৃষক সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে কোনো প্রকার অর্থনৈতিক স্তরভেদ সম্ভব হতো না। অন্যদিকে আবার এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসক শ্রেণী এবং কৃষক শ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব সংঘাতও, বড় আকারের জনকল্যান-মূলক কর্মকান্ডের জন্য রাষ্ট্রের উপর কৃষক শ্রেণীর একান্ত নির্ভরশীলতার কারণে, কখনও দানা বাঁধতে পারে নি। মুসলিম রাষ্ট্র ও এ ধরনের দায়িত্ব পুরো গ্রহণ করে নেয়ার ফলে বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্কসমুহের মধ্যে বিরাজমান বিরোধ সমূহ দানা বাঁধেনি এবং সমাজ একটি অন্তহীন বন্ধাবস্থার মধ্যে পতিত হয়।
সৌজন্যে : চিন্তা.কম