৫ই জুমাদাল উখরা ১৪৩৭ হিজরী, মোতোবেক ১৫ মার্চ ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে জামেয়া দারুল উলূম করাচির শাখা প্রতিষ্ঠান ‘হেরা ফাউন্ডেশন স্কুল’ এ শাইখুল ইসলাম মুফতি মুহাম্মাদ তকী উসমানী সাহেব দাঃ বাঃ এর ভাষণ।
জামেয়া দারুল উলূম করাচির শাখা ‘হেরা ফাউন্ডেশন স্কুল’ তাদের হেফজসমাপনী ছাত্রদের সমাবর্তন উপলক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। তাতে বড় বড় ওলামায়ে কেরাম, বিজ্ঞ ও সুদক্ষ শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন । হযরত মুফতি মোহাম্মাদ তকি ওসমানি সাহেব এ অনুষ্ঠানে শিক্ষা কারিকুলামের ব্যাপারে যে সারগর্ভ ভাষণ দিয়েছিলেন তা ছিল খুবই প্রাণবন্ত, মনোমুগ্ধকর ও যুগান্তকারী। এতে তিনি চমৎকার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন । এ ভাষণটি তকি ওসমানি সাহেব নিজে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা, সংযোজন ও বিয়োজন করে প্রকাশের অনুমতি দিয়ে আমাদেরকে কৃতার্থ করেছেন । আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে আমাদেরকে উপকৃত হওয়ার এবং আমল করার তৌফিক দান করুক । আমীন । ভাষণটি বাঙ্গালি পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করেছেন বিশিষ্ট অনুবাদক কাজী মোহাম্মদ হানিফ।
نحمده و نصلي علي رسوله الكريم. اما بعد
উপস্থিত জামিয়ার সম্মানিত ও স্বনামধন্য প্রিন্সিপ্যাল, বিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলি ও শ্রোতাবৃন্দ ! সকলের প্রতি রইলো আমার আন্তরিক সালাম।
আমি জানি আপনারা দীর্ঘ সময় ধরে এ অনুষ্ঠানের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন। আমি মনে করি আপনারা যে সময় এ অনুষ্ঠানে ব্যয় করেছেন তা ইনশাআল্লাহ আপনাদের আত্মার খোরাক হিসেবে বিবেচিত হবে। সময় অনেক হয়ে গেছে। খাবারেরও সময় নিকটবর্তী। তাই আমি বেশী সময় নেব না। তবে আমি অত্যন্ত সংক্ষেপে ‘‘হেরা ফাউন্ডেশন স্কুল’’ এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। জামিয়ার প্রিন্সিপাল মুফতি আজম পাকিস্তান হযরত মাওলানা মুফতি রফি উসমানী সাহেব দা.বা. বিভিন্ন বৈঠকে এবং বিভিন্ন সুযোগে এ প্রসঙ্গে বারবার আলোচনা করেছেন। আমিও আমার শ্রদ্ধেয় পিতার (রহ.) এ কথা ইতোপূর্বে কয়েক জায়গায় আলোচনা করেছি। আমার শ্রদ্ধেয় পিতা কোনো পাকিস্তানের সাধারণ শিক্ষা কারিকুলাম পর্যবেক্ষণ করে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদেরকে বলেছিলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আমাদের বাস্তবে নতুন একটি ব্যাপকভিত্তিক ও সার্বজনীন শিক্ষা কারিকুলামের প্রয়োজন।
এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতবর্ষে বড় বড় তিনটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রশিদ্ধ ও প্রচলিত ছিল।
এক. দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষা ব্যবস্থা।
দুই. মুসলিম ইউনিভার্সিটি আলীগড়ের শিক্ষাব্যবস্থা।
তিন. দারুল উলুম নদওয়াতুল ওলামার শিক্ষাব্যবস্থা।
আমার শ্রদ্ধেয় পিতা প্রায় ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে বলেছিলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সরকারিভাবে এদেশে না আলীগড়ের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন, না নদওয়াতুল ওলামার শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন, না দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন। বরং সরকারিভাবে আমাদের এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন যা আমাদের পূর্বসূরীদের শিক্ষাব্যবস্থার ধারাবাহিকতার সাথে যুক্ত। আমার একথা শুনে আপনারা হয়তো অবাক হবেন যে, দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতি আজম এবং দারুল উলুম দেওবন্দের এক কৃতিসন্তান ও বরপুত্র বলছেন, ‘পাকিস্তানে এখন আর দেওবন্দের শিক্ষাকারিকুলামের প্রয়োজনীয়তা নেই বরং আমাদের নতুন একটি শিক্ষা করিকূলামের প্রয়োজন।’
ভারতে প্রচলিত তিনটি শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আকবর এলাহাবাদী যথার্থই বলেছেন:
‘দেওবন্দ হলো জাগ্রত অন্তরের ন্যায়। নদওয়া হলো বিচক্ষণ মুখপাত্র। আর আলীগড়ের উপমা হলো সম্মানের সাথে উদরপূর্তির মাধ্যম।’
আমার শ্রদ্ধেয় পিতা যে কথা বলেছিলেন তা অত্যন্ত গভীর ও সূক্ষ্মদর্শী কথা। তা না বুঝার কারণে আমাদের অনেকে ভুল বুঝাবুঝির শিকার হয়েছেন। এ তিনটি শিক্ষাব্যবস্থা যা ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল সেগুলো মূলত ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল ছিলো। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার পাল্টা ব্যবস্থা ছিল। নতুবা আপনি যদি এর পূর্বের মুসলিম বিশ্বের হাজার বছরের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তা ভাবনা করেন তাহলে তাতে মাদরাসা ও স্কুলের পার্থক্য দেখতে পাবেন না, সেখানে ইসলামের শুরু থেকে নিয়ে আধুনিককাল পর্যন্ত অব্যাহতভাবে মাদরাসা ও জামেয়াসমূহে একই সময়ে ধর্মীয় শিক্ষাও দেয়া হতো এবং সাথে সাথে যুগোপযুগী দুনিয়াবি শিক্ষাও দেওয়া হতো।
ধর্মীয় জ্ঞানে পরিপূর্ণ আলেম হওয়াতো প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ফরযজ আইন নয়, বরং ফরজে কেফায়া। কোনো এলাকা বা দেশে যদি প্রয়োজন পরিমাণ আলেম হয়ে যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট এলাকার সবার পক্ষথেকে এ ফরজ দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়। তবে দীনের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজে আইন। পূর্বকালে প্রতিষ্ঠিত সকল মাদরাসায় ফরজে আইন পরিমাণ ইলমের শিক্ষা প্রত্যেককেই দেওয়া হতো। তবে যে ইলমে দীনের বিশেষজ্ঞ হতে চাইতো তার জন্য সে সুযোগ ছিলো আর যে যুগোপযুগী আধুনিক জ্ঞানে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে চাইতো তার জন্য তা অর্জন করারও ব্যবস্থা ছিল।
আমি কয়েক বছর আগে মরক্কোতে গিয়েছিলাম। শ্রদ্ধেয় বড় ভাই হজরত মাওলানা মুফতি রফী উসমানী সাহেব দা. বা. গত বছর মরক্কোতে গিয়েছিলেন। মরক্কোর একটি শহরের নাম হলো ফাস। আমি গত বছর এ শহরে গিয়েছিলাম। আমার বড় ভাই এবছর সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানে জামেউয়াতুল করউইয়্যিন নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। আমরা যদি ইসলামি ইতিহাসের প্রসিদ্ধ জামেয়াসমূহের অনুসন্ধান করি তাহলে আমরা প্রসিদ্ধ চারটি জামেয়ার সন্ধান পাই। সর্ব প্রথমটি হলো এ জামেয়াতুল করউইয়্যিন। দ্বিতীয়টি হলো তিউনিসিয়ার জামিয়া যাইতুনাহ। তৃতীয়টি হলো মিসরের জামিয়াতুল আযহার। চতুর্থটি হলো ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দ । ঐতিহাসিক ক্রমাধারাও অনুরূপ ।
সর্বপ্র্র্রথম ইউনিভার্সিটি হলো জামেয়াতুল কারউইয়্যিন । এটা তৃতীয় শতাব্দীর ইউনিভার্সিটি হওয়ার ব্যাপারে ইতিহাসের গ্রন্থে দাবী করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত সেই দাবীর প্রত্যাখান আমার নজরে পড়েনি । এটা শুধু ইসলামি জগতের প্রথম ইউনিভার্সিটি নয় বরং সমগ্র দুনিয়ার প্রাচীনতম ইউনিভার্সিটি।
ঐ সময় জামেয়াতুল কারউইয়্যিন ইউনিভার্সিটিতে সেসব বিষয় পাঠদান করা হতো সেগুলো হলো: আরবি ভাষা, তাফসির, হাদিস, ফেকাহ এবং তার সাথে সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞান, শারীরিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, জোতির্বিদ্যা ইত্যাদি। যেসব বিষয়কে আজ আধুনিক বিষয় বলা হয়। সেইসব বিষয় সেখানে পাঠদান করা হতো। আল্লামা ইবনে খালদুন (রহ.), আল্লামা ইবনে রুশদ (রহ.), কাজী ইয়াজ রহ. সেখানে পাঠদান করেছেন পূর্বসূরীদের এক দীর্ঘ তালিকা আছে যারা সেখানে পাঠদান করেছেন। তাদের আসন আজ পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে। ওখানে আল্লামা ইবনুল আরাবী মালিকী (রহ.) ও পাঠদান করেছেন। তাদের আসনসমূহ সংরক্ষিত আছে। এটা পৃথিবীর প্রাচীনতম ইউনিভার্সিটি। ছোট ছোট মাদরাসাতো সর্বত্রই ছিল কিন্তু জামিয়াতুল করউইয়্যিন ইউনিভার্সিটির মর্যাদা রাখতো। এখানে আধুনিক জ্ঞান, ধর্মীয় জ্ঞান, ও জাগতিক সকল জ্ঞান বিজ্ঞান পড়ানো হতো । এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো সে যুগের অর্থাৎ হিজরি তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অনেক নমুনা সংরক্ষিত আছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের আবিষ্কৃত ঘড়ি ও অন্যান্য্য আবিষ্কার এখনো সেখানে গেলে দেখতে পাবেন।
একটু লক্ষ করুন! এটা তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর ইউনিভার্সিটি। ইসলামী জ্ঞানের বিদগ্ধ পন্ডিতগণ সেখান থেকেই তৈরী হয়েছেন। দার্শনিক ইবনে রুশদ (রহ.) সেখান থেকেই তৈরী হয়েছেন। সেখান থেকে বড় বড় বিজ্ঞানী জন্ম হয়েছে। তাহলে সমস্যাটা কী? যতটুকু ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা করা ফরজে আইন তাতো একত্রে সবাইকে শিখানো হতো । এরপর যদি কেউ ধর্মীয় জ্ঞানে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে চাইতো তাহলে সে ইলমে দীনের ক্লাসও ঐ জামেয়াতুল করউইয়্যিনেই করতো। কেউ যদি অংক শাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করতে চাইতো তাহলে সে শাস্ত্রও সে সেখানে পড়তো। চিকিৎসাবিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করতে আগ্রহীরাও সেখানেই পড়তো। এসকল নেজাম এভাবেই চলতো। জামিয়া যাইতুনাহ, জামিয়াতুল আযহারও এভাবে চলতো এবং এখনো এভাবেই চলে। এ ইউনিভার্সিটি তিনটি আমাদের প্রাচীনকালের ইউনিভার্সিটি। সেগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষা ও জাগতিক শিক্ষা একই সাথে একই ছাদের নিচে দেওয়া হতো।
ইতিহাসের এদিকে তাকিয়ে একটু খেয়াল করুন- আল্লামা কাজী ইয়াজ (রহ.) -যিনি হাদিস ও সুন্নতের ইমাম ছিলেন- তার অবয়ব আকৃতির দিকে তাকান, আল্লামা ইবনে খালদুন (রহ.) যিনি ফিলোসফি ও ইতিহাসের ইমাম ছিলেন তার অবয়ব আকৃতির দিকে তাকান উভয়ের বাহ্যিক আকার অবয়বে কোনো পার্থক্য পাবেন না। ইনি দীনের আলেম আর উনি দুনিয়ার আলেম এমন কোনো বাহ্যিক বিভাজন ছিল না। তাদের অবয়ব আকৃতি তাহজীব তামাদ্দুন, তাদের জীবন-পদ্ধতি, তাদের কথা বলার ঢং ও মুখের ভাষা সব একরকম ছিল। আমাদের যেসব প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী গত হয়েছেন, যেমন: ফারাবী (রহ.), ইবনে রুশদ (রহ.), আবু রাইয়ান আল বিরুনি (রহ.) তাদের সকলের অবয়ব আকৃতির দিকে তাকান অতপর মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কিরামের দিকে তাকান উভয় দলের আকার আকৃতি একই রকম ছিল। যদি তারা নামায পড়েন তাহলে এরাও নামায পড়েন। যদি তাদের নামাযের মাসায়েল জানা থাকে তাহলে এদেরও আবশ্যকীয় সীমা পর্যন্ত জানা আছে। যদি তাদের রোজার মাসায়েল জানা থাকে তবে এদেরও জানা আছে। ধর্মের মৌলিক শিক্ষা যা শিক্ষা করা প্রত্যেকের জন্য ফরজে আইন তা প্রত্যেক ব্যক্তিই জানতো। আর ওইসব ইউনিভর্সিটিতে দীন দুনিয়ার সববিষয় পড়ানো হতো। পার্থক্য শুধু তখন থেকে সৃষ্টি হয়েছে যখন থেকে ইংরেজরা ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে এদেশ থেকে দীন ধর্মের কবর রচনার প্রয়াস চালিয়েছিল। তখন আমাদের আকাবের মাশায়েখরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে মুসলমানদের দীনি ইলমের সুরক্ষার জন্য কমপক্ষে যতটুকু ফরজে কেফায়া ততটুকু সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এরকম আলেমে দীন তৈরী করার ব্যবস্থা করেছিলেন যারা ধর্মীয় জ্ঞানে পান্ডিত্য অর্জন করে সাধারণ মুসলমানদের ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণ করতে এবং তাদের ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবে। যে কাজ সরকারি উদ্যোগে ব্যাপকভাবে করার কথা ছিল সেই কাজ তারা নিজেরা করে মুসলমানদের দীনের সংরক্ষণ করেছিলেন। এজন্যই তারা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠান আলহামদুলিল্লাহ সেই বিশাল খেদমত আঞ্জাম দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
যদি পাকিস্তান সঠিক অর্থে ইসলামি রাষ্ট্র হতো এবং সঠিক অর্থে তাতে ইসলামি বিধিবিধান প্রয়োগ হতো, তাহলে সে ক্ষেত্রে আমার শ্রদ্ধেয় পিতার কথা অনুযায়ী পাকিস্তানে না আমাদের আলীগড়ের শিক্ষা কারিকুলামের প্রয়োজন ছিল, না নদওয়ার, না দারুল উলুম দেওবন্দের। আমাদের জামিউল করউইয়্যিনের প্রয়োজন ছিলো। আমাদের জামিয়া যাইতুনার প্রয়োজন ছিল। যেখানে সবধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞান পাঠদান করা হতো। সেসব ইউনিভর্সিটির সকল শিক্ষার্থী দীনের রংয়ে রঙিন হতো। কি ইঞ্জিনিয়ার কি ডাক্তার কি বিচারক কি সরকারি আমলা সবাই দীনের রঙে রঙিন থাকতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমাদের উপর এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে যা আমাদেরকে দাসত্বসূলভ মনোভাব ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। আকবর এলাহাবাদী যথার্থই বলেছিলেন : আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধু উদরপূর্তি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে।
ইংরেজদের প্রবর্তিত এ শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে যে ক্ষতির সম্মুখিন আমরা হয়েছি তা হলো মুসলমানদের অতীত ইতিহাস এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের উত্তরাধিকার ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এ নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ফলে দীনি ও দুনিয়াবী জ্ঞান বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মুসলমান সমাজ মোল্লা ও মিষ্টারে ভাগ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় যে ছাত্র এ শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে উঠেছে সে দীনের মৌলিক ফরজ সম্পর্কেও জানে না। দ্বিতীয়ত: তাদের মন মস্তিস্কে এ চিন্তা চেতনা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যদি উন্নতি অগ্রগতি চাও তাহলে শুধু পশ্চিমাদের অন্ধ অনুসরণ করো। তৃতীয়ত: মুসলমানদের তাহজীব তামাদ্দুন ও কৃষ্টিকালচার পাল্টে দেয়া হয়েছে। সকলের মস্তিস্কে একথা বসিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যদি উন্নতি ও সমৃদ্ধি চাও তাহলে তা শুধু পশ্চিমাদের চিন্তা চেতনা ও তাদের ধ্যান ধারনার মধ্যেই পাবে। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যেই রয়েছে কাঙ্খিত সুখ শান্তি ও উন্নতি অগ্রগতি। এ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে যেসব লোক শিক্ষিত হয় তাদের অধিকাংশ সব সময় ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিতদের সমালোচনা করে। তারা বলে মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত আলেম ওলামারা কোনো কিছু আবিষ্কার করে না। আবিষ্কারের দরজা ও ইজতিহাদের পথ তারা বন্ধ করে রেখেছে। এর জবাবে আমি বলবো: কোরআন সুন্নাহ ও ফেকাহতে যে ইজতেহাদ প্রযোজ্য তা তো অনেক জটিল প্রক্রিয়ার অধীন, এর জন্য বিশেষ জ্ঞান ও যোগ্যতা অপরিহার্য । এটা সবার জন্য ও সর্ব ক্ষেত্রে উন্মুক্ত নয়, কিন্তু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এর দরজা সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত ও তথ্য যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আবিষ্কারের পথ কারো জন্য বন্ধ নয়। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ও সাধারণ সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আপনারা কেন এমন বিজ্ঞানী তৈরী করতে পারলেন না যারা পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের সাথে টেক্কা দিতি পারে। এ শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা করে এমন চিকিৎসাবিজ্ঞানী কেন তৈরী হলো না যারা চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে গবেষনা করে নতুন নতুন রোগের ঔষধ আবিষ্কার করতে পারে। এমন সৌরবিজ্ঞানী কেন জন্ম নিলো না, যারা নতুন নতুন গ্রহ নক্ষত্র আবিষ্কার করতে পারে। ইজতিহাদ ও আবিষ্কারের দরজা যেখানে সম্পূর্ণরূপে খোলা সেখানে উল্লেখযোগ্য কোনো আবিষ্কারের খবর নেই অথচ ইজতেহাদের পথ যেখানে খুবই সংকীর্ণ এবং নানা শর্তের জালে আবদ্ধ সেখানে কেন ইজতেহাদ হলো না এটা নিয়ে তাদের অভিযোগের অন্ত নেই।
কয়েকদিন আগে আমাকে জনৈক ব্যক্তি একটি ভিডিও ক্লিপ দেখিয়েছিলেন। সেখানে দেখলাম আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তি জনৈক আলেমের কাছে প্রশ্ন করছেন: মাওলানা! ওলামায়ে কেরাম যে দীনি খেদমত করছেন তা তো ঠিক আছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানের কোন বিজ্ঞানী কেন তৈরী হলো না? কেন কোনো মুসলমান বিজ্ঞানী উল্লেখযোগ্য কোনো কিছু আবিষ্কার করতে সক্ষম হলো না? আমি ওলামায়ে কেরামের কাছে এর উত্তর চাই।
এর উত্তরে আমি বলবো: কোনো আলেমকে এ প্রশ্ন না করে আপনি নিজেকে নিজে এ প্রশ্ন করুন, আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় কেন বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক তৈরী হলো না? ইসলাম বা কোনো আলেম কি এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে? আবিষ্কারের পথ কি কেউ রুদ্ধ করে রেখেছে? আসল কথা হলো সরকারের সব সুযোগ সুবিধা আপনারা পেয়েছেন। আবিষ্কারের পথও খোলা ছিল। তা সত্ত্বেও ‘‘মানসিক দাসত্বের’’ কারণে আপনারা নিজেরাই আবিষ্কারের পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। ইংরেজ বা পশ্চিমারা যে মতবাদ বা থিউরি দিচ্ছে নিঃশ্চিন্তে তা গ্রহণ করে নিচ্ছেন। যে রোগের যে ওষুধ তারা বলে দিচ্ছে নিজেরা গবেষণা না করে তাই মেনে নিচ্ছেন। তারা যদি কোনো জিনিসকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে ঘোষণা করে তাহলে আপনারা বিনা দ্বিধায় তাদের সাথে তাল মিলান। সব বিষয়ে তাদের মতামত চূড়ান্ত বলে মনে করেন। এতদিন যাবৎ ডিমের কুসুমের ব্যপারে ডাক্তাররা বলতেন যে, এটা কোলেস্টরল সৃষ্টি করে; যা হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এখন সেই ডাক্তাররাই বলছেন, ডিমের কুসুম খান। এতে কোনো সমস্যা নেই। ডাক্তাররা কেন এভাবে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন? কারণ পশ্চিম থেকে এ ব্যপারে ঘোষণা এসেছে তাই আমাদের ডাক্তাররা নির্দ্বিধায় তা মেনে নিয়েছেন।
আমাদের এদেশে পথে ঘাটে ও বনে বাদাড়ে অগণিত ও অসংখ্য ভেষজ উদ্ভিদ ও লতা পাতা রয়েছে । আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা যদি এগুলো নিয়ে গবেষণা করতো! তারা যদি মারাত্মক কোন ব্যাধির ওষুধ আবিষ্কার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতো ! রাসুলে কারিম (সঃ) কালোজিরার উপকারিতার কথা বলে গেছেন । এটা নিয়েও যদি নতুন কোন গবেষণা হতো ! গবেষণা হবে কি ভাবে ? তারা তো গবেষণার দরজা বন্ধ করে বসে আছেন । তারা চেয়ে আছেন পশ্চিমের দিকে, সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে তা চোখ বুজে মেনে নিবেন । বস্তুত তারা ইজতিহাদ ও গবেষণার খোলা দরজাকে বন্ধ করে বসে আছেন অথচ কোরআন সুন্নাহ নিয়ে আলেমরা কোন নতুন গবেষণা করছেন না কেন সে প্রশ্ন তুলছেন। এটা মূলত দাসত্বসলূভ মনোভাবের ফল। মানসিক দাসত্ব ও পরাধীনতার কারণে আমাদের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা আজ স্থবির হয়ে আছে ।
আধুনিক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার একটি ক্ষতি হলো, এটা আমাদেরকে মানসিকভাবে ইংরেজদের গোলাম করে রেখেছে । এর আরেকটি ক্ষতি হলো এ শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের চিন্তা চেতনার মোড় সম্পূর্ণরূপে ঘুরিয়ে দিয়েছে । আগে জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল উন্নত ও মানবিক আর এখন তা হয়ে গেছে হীন ও অর্থনৈতিক। অর্থাৎ আগে জ্ঞান অর্জন করতো ও বিদ্যা শিখতো সমাজের উপকারের জন্য, দেশ ও দেশের সেবা করার উদ্দেশ্যে । এটা ছিলো মুখ্য উদ্দেশ্য । আর চাকরি বাকরি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল গৌন । কিন্তু আজ জ্ঞান ও বিদ্যা বিক্রি করে অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা মুখ্য হয়ে গেছে আর জনসেবা হয়ে গেছে গৌন। যে যত বড় শিক্ষিত সে অর্থ উপার্জনে তত বেশি মরিয়া । যারা গ্র্যাজুয়েশন করছে, মাষ্টার করছে, পি এইচ ডি ডিগ্রি নিচ্ছে তাদের ব্রেইন রিডিং করে দেখুন এই তথ্যই ফুটে উঠবে । তারা পড়াশোনা করছে ক্যারিয়ার গঠন করার জন্য কিংবা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য । শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হয়ে গেছে অর্থ উপার্জন । তাই কেউ শিক্ষিত হয়ে যদি ভালো চাকরি না পায় বা বিপুল পরিমাণে অর্থ উপার্জন করতে না পারে তাহলে তাকে ব্যর্থ মনে করা হয় । জ্ঞান ও বিদ্যা বুদ্ধির মাধ্যমে সমাজের সেবা এবং দেশ ও দেশের উপকার যে করতে হয় এ শিক্ষা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই বললেই চলে । এ কারণে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিতরা অর্থ উপার্জনের ধান্ধায় লেগে আছে । তারা না দেশের চিন্তা করে না দশের । দিনরাত শুধু টাকা আর টাকার স্বপ্ন দেখে । তারা উন্নত ক্যারিয়ার আর মাল্টিন্যাশনাল কোমপানি কিংবা কর্পোরেট চাকরির ভাবনায় ডুবে থাকে । ব্যতিক্রম যে নাই সে কথা আমি বলছি না । কিন্তু তাদের সংখ্যা কত পার্সেন্ট হবে ? আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদের কতজন নিঃস্বর্থ ভাবে দেশ ও দশের সেবায় এগিয়ে আসেন ? হিসাব করলে এ সংখ্যা হতাশাব্যাঞ্জকই হবে । অথচ আমাদের নবী (সাঃ) আমাদেরকে এ দোয়া শিখিয়েছেন:
اللهم لا تجعل الدنيا اكبر همنا ولا مبلغ علمنا و لا غاية رغبتنا
‘হে আল্লাহ দুনিয়া যেন আমদের সবচেয়ে বড় ধ্যানের বস্তু না হয় । কিংবা আমাদের বিদ্যা অর্জনের উদ্দেশ্য না হয় এমনকি দুনিয়া যেন আমাদের মূল আকাঙ্ক্ষার বস্তুতেও পরিনত না হয় ।’
কিন্তু আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা কী করলো ? আমাদের বিদ্যা-বুদ্ধি, ধ্যান-জ্ঞান ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র বানিয়ে দিলো দুনিয়াকে। আমাদেরকে আত্মকেন্দ্রিক করে দিলো । শিক্ষিত মানুষগুলোকে উদরচিন্তায় ডুবিয়ে দিলো ।
আমার শ্রদ্ধেয় পিতা শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যে কথা বলেছিলেন তার উদ্দেশ্য হলোঃ ঔপনিবেশিক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার ফলে আমাদের আর্থসামাজিক ও মানসিক যে চেতনা ও চিন্তাধারা পাল্টে গেছে তা যথাস্থানে ফিরিয়ে আনা । এর জন্য আমাদেরকে সে পথ অনুসরন করতে হবে যে পথ দেখিয়েছে জামিয়া করউইয়্যিন ও জামিয়া যাইতুনাহ এবং প্রথম যুগে জামিয়া আজহার । আমি জামিয়া আজহারের ক্ষেত্রে ‘প্রথম যুগে’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছি । এর কারণ হলোঃ উপনিবেশের বিষবাষ্প এ প্রতিষ্ঠানটিকে প্রভাবিত করে তার মূলধারা থেকে বিচ্যুত করে দিয়েছে ।
পাক ভারত উপমহাদেশ থেকে ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানে তো জামিয়াতুল
করউইয়্যিনের পথ অনুসরণ করা দরকার ছিল । কিন্তু সরকার যেহেতু তা অনুসরণ করেনি এবং ধর্মীয় জ্ঞানের সুরক্ষার যথাযথ ব্যবস্থাও করেনি । তাই ওলামায়ে কেরাম বাধ্য হয়ে দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষাব্যবস্থার অনুসরণে মাদরাসা প্রতিষ্ঠান করেছেন। যেন কমপক্ষে নববি ইলমের তথা ধর্মীয় জ্ঞানের সুরক্ষা নিশ্চিত হয় । আলহামদুলিল্লাহ । ওলামায়ে কেরাম প্রতিকূল পরিবেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দীনি ইলেম সংরক্ষণের জন্য যে ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করেছেন এবং বড় বড় খেদমত সম্পাদন করেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর । দীনি ইলমের সংরক্ষণের জন্য পৃথিবীর আর কোনো দেশের ওলামায়ে কেরাম ব্যপকভাবে এমন ত্যাগ স্বীকার করেছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই। যাই হোক যতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশের শাসকশ্রেণি ও সমাজব্যবস্থা পরিপূর্ণরূপে ইসলামি ধাঁচে গড়ে না উঠবে এবং ইসলামি সরকার জামিয়াতুল করউইয়্যিনের মতো দীন ও দুনিয়ার সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু না করবে ততদিন পর্যন্ত আমরা এ (কওমি/দেওবন্দি) মাদরাসাসমূহকে যথারীতি সংরক্ষণ করবো এবং দেওবন্দের আকাবিরগণ যেভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন আমরা যথাসম্ভব সেভাবে এগুলোকে বহাল রাখবো । এগুলোর উপর আমরা কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেবো না । কেননা মুসলমানদের দীনের সুরক্ষা এ মাদরাসাসমূহের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে । তদুপরি আমাদের দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা যদি ইসলামি হয়েও যায় তবুও দীনি শিক্ষার বিশেষজ্ঞ আলেম তৈরির অঙ্গঁন হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানগুলো বহাল থকবে ।
সাধারণ শিক্ষার সাথে (ফরজে আইন পরিমাণ) দীনি শিক্ষাকে সমন্বিত করার যে কাজ সরকারিভাবে করা হচ্ছে না, আমরা ধীরে ধীরে সে কাজ আমাদের মাদরাসাসমূহের মাধ্যমে সম্পাদন করতে চাচ্ছি । আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান দীনের রঙে রঙিন করে আমাদের মাদরাসার পরিবেশে পাঠদানের চেষ্টা আমরা করছি। আলহামদুলিল্লাহ, পাকিস্তানে দীনি মাদরাসার সংখ্যা প্রয়োজন অনুপাতে যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু এ মাদরাসাসমূহ ফরজে কেফায়ার শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মাত্র এক শতাংশ ছাত্র/ছাত্রী এসব মাদরাসায় পড়াশোনা করছে। অবশিষ্ট ৯৯% ছাত্র/ছাত্রী যে শিক্ষাব্যবস্থার অধীন শিক্ষা লাভ করছে সে শিক্ষাব্যবস্থার ফলে তারা মানসিকভাবে (পশ্চিমাদের) গোলামে পরিণত হচ্ছে। আমি “হেরা ফাউন্ডেশন স্কুল’’ এর শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের বারবার একথা বলেছি এবং এখনো বলছি: ‘আপনাদের আসল উদ্দেশ্য হলো: আমাদের এই নতুন প্রজন্মকে পশ্চিমাদের মানসিক গোলামি থেকে রক্ষা করুন। আপনারা আমাদের সন্তানদের মনে একথা বসিয়ে দিন যে, আমরা স্বাধীন জাতি এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র চিন্তার অধিকারী। আমরা আমাদের নবীজীর চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী।’
পশ্চিমায় একথা ছড়িয়ে দিয়েছে এবং তা আমাদের মনে বসিয়ে দিয়েছে যে, ‘‘পশ্চিমাদের চিন্তা চেতনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানই সব কিছুর মূল এবং তাতেই রয়েছে উন্নতি এবং অগ্রগতির চাবিকাঠি।’’ আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মন ও মগজ থেকে এ চেতনা দূর করে দিন। তাদের মধ্যে ইসলামি চেতনা ও স্বাতন্ত্রবোধ জাগিয়ে তুলুন। এ মহৎ উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই আমরা হেরা ফেউন্ডেশন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। ‘পশ্চিমা সব কিছুই খারাপ’ একথা আমি বলছি না। বস্তুত: পশ্চিমাদের মধ্যে খারাপ যেমন আছে তেমন তাদের কাছে অনেক ভালো জিনিসও আছে। তাই যা ভালো তা গ্রহণ করবেন আর যা কিছু মন্দ তা ছুড়ে মারবেন। পশ্চিমা দর্শন, ব্যবস্থাপনা ও চিন্তা চেতনার ব্যাপারে আল্লামা ইকবাল রহ. যে পর্যবেক্ষণ আমাদের সামনে পেশ করেছেন, তা মুসলিম জাতির জন্য অমূল্য সম্পদ ও আলোকবর্তিকারূপে গণ্য হওয়ার যোগ্য। আল্লামা ইকবাল রহ. বলেছেন:
‘পাশ্চাত্যের যে উন্নতি-অগ্রগতি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি আমরা দেখছি তা বাদ্যযন্ত্র এবং নগ্ন মহিলাদের নৃত্যের কারণে অর্জিত হয়নি। বরং তারা তা লাভ করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টা তদবিরের মাধ্যমে। জ্ঞান সাধনার আগুনের মাধ্যমেই তাদের উন্নতির প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। নির্দিষ্ট আকারের পোশাকে (শার্ট-প্যান্ট) জ্ঞান-বিজ্ঞান নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান তো চেষ্টা সাধনা করে অর্জন করার জিনিস। জুব্বা-পাগড়ি আধুনিক জ্ঞান–বিজ্ঞানের পথে প্রতিবন্ধক নয়।’
বাস্তবেই পশ্চিমারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে কয়েক শতাব্দীর মেহনতের ফলে আজ পার্থিব উন্নতি অগ্রগতি ও সীমাহীন প্রভাব-প্রতিপত্তির শীর্ষে আরোহণ করেছে। আমরাও যদি আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, দীন-ধর্ম বহাল রেখে স্বাধীনভাবে জ্ঞান-চর্চায় আত্মনিয়োগ করি তাহলে আমরাও উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করতে সক্ষম হবো। পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞান ধর্মহীনতার উপর কখনো নির্ভরশীল নয়। পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উন্নতি অগ্রগতি অর্জন করতে হলে পোশাক-আশাক ও জীবন-যাপন পদ্ধতি পশ্চিমাদের ধাচে গড়তে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ আমাদের অনেকে এমন হীনমন্যতার শিকার হয়ে আছে। তারা মনে করে পশ্চিমা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করতে হলে নিজেদের বাহ্যিক বেশ-ভূষা ও জীবনাচারকেও পশ্চিমাদের আদলে গড়ে তুলতে হবে। এ চিন্তা-চেতনার কারণে আমরা মানসিকভাবে পশ্চিমাদের গোলামে পরিণত হয়েছি। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা স্বাধীনভাবে তথা নিজেদের মতো করে চিন্তা করতে পারি না। এ তত্ত্ব ও বাস্তবতাটিকেই আল্লামা ইকবাল রহ. খুব চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার কথাগুলো আমাদের ঘুমন্ত চোখসমূহ জাগিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। তিনি পশ্চিমাদের শিক্ষায় শিক্ষিত ও তাদের ধ্যান-ধারনায় লালিতদের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:
‘তোমরা কেবল অন্যদের জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করলে এবং একেই প্রকৃত জ্ঞান মনে করে তৃপ্ত হয়ে গেলে। শুধু তাই নয়, এ জ্ঞানের রঙে নিজেদের আপাদমস্তক রঙিন করে নিলে। তাদের বেশ-ভূষায় আচ্ছাদিত হয়ে গর্ব করছো। আমার ভ্রম হচ্ছে, তোমরা কি তোমরা না অন্য কেউ?
তোমাদের বিবেক-বুদ্ধি অন্যদের চিন্তা চেতনার শিকলে বন্দী হয়ে আছে। তোমাদের গলায় যে শ্বাস প্রশ্বাস যাতায়াত করে তাও অন্যদের তন্ত্রীর মাধ্যমে। তোমাদের মুখে যে ভাষা চর্চিত হয় তাও অন্যদের কাছ থেকে ধার করা। শুধু তাই নয়, তোমাদের মনের গহীনে যে আশা আকাঙখা উদিত হয় তাও বিজাতি থেকে গ্রহণ করা। তোমরা সূর্য নও চাঁদ। ধার করা আলোয় কিঞ্চিত আলোকিত। আরবের সে নবী যিনি তোমাদেরকে সূর্য বানিয়েছিলেন। তিনি যদি পৃথিবীর বুকে আবার আগমন করেন তাহলে তিনি তোমাদেরকে দেখলে বলবেন: ‘‘তোমরা তো আমার নও,’’ হায় আমাদের দুর্ভাগ্য! আমাদের অবক্ষয়!’
আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ ভয়াবহ পরিণাম থেকে বাঁচাতে হলে তাদেরকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখানোর জন্য আমাদের এমন কিছু প্রতিষ্ঠান দরকার যেখানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ শিক্ষা এমনভাবে দেওয়া হবে যে, সেখানের শিক্ষার্থীরা পশ্চিমাদের মানসিক গোলাম হবে না, উপরন্ত তারা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্য্যতা-সংস্কৃতি ও দীন-ধর্মের ভাবধারার সাথে বেড়ে উঠবে।
জামিয়া দারুল উলুম করাচি উম্মাহর এ প্রয়োজনটিকে অনুভব করে দারুল উলুমের পরিবেশ ও সীমানার মধ্যে প্রথমে একটি উর্দূ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর সেটা করা হয়েছিল আমার পিতামহুদয়ের জীবদ্দশায়। আর এখন ‘‘হেরা ফাউেন্ডশন স্কুল’’ নামে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মুসলমানদের ধর্মীয় প্রয়োজনকে সামনে রেখে এর সিলেবাস ও শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। আমরা মনে করি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় হওয়া উচিত । কিন্তু দাসত্বসূলভ মানসিকতায় আমরা এমনভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছি যে, ইংরেজি জানা ও ইংরেজি শিক্ষাকে আমরা বিদ্যাবুদ্ধির মাপকাঠি মনে করি । এটা আমাদের মধ্যে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি ইংলিশ মিডিয়ামের পেছনে দৌড়াচ্ছে। আর স্বাভাবিকভাবে এসব শ্রেণির শিশুরা বড় হয়ে দেশ ও সমাজের নেতৃত্বের আসনে বসছে। তাই তাদেরকে ইংরেজির সাথে সাথে দীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে আমরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের ইংলিশ মিডিয়ামে দীনি শিক্ষার পাশাপাশি আগ্রহী ও মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে হেফজও পড়ানো হয়। আপনারা একটু আগে প্রদর্শনীতে সবকিছু দেখেছেন।
আমার ছেলে ইমরান আশরাফ ওসমানি সম্পর্কে আপনারা জানেন। আমি তার সম্পর্কে বেশি কিছু বলবো না। আলহামদুলিল্লাহ, সে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে দারুল উলুমের এ শাখাটিকে অত্যন্ত সুনামের সাথে পরিচালনা করে আসছে। তার সহকর্মীরাও তাকে সহযোগিতা করছে। বিশেষ করে মাওলানা নাজীব সাহেব এর উন্নতির জন্য দিনরাত অনেক পরিশ্রম করছেন। আল্লাহ সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের নিয়তে এখলাস দান করুন। আমাদের কর্মপদ্ধতিকে যথার্থ করে দিন। সব ধরনের বিপদ আপদ ও বিচ্যুতি থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন। আমাদের এই কাজটিকে তার সন্তুষ্টি মোতাবেক পরিচালনা করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
ভাষান্তর: কাজী হানিফ
৫ রমজান ১৪৩৭ হিজরী