হাফিয মাওলানা ফখরুযযামান : কওমি মাদরাসাশিক্ষা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও জাতীয়ভাবে এ শিক্ষাব্যবস্থার সনদের স্বীকৃতি নেই। কিন্তু এ জাতীয় হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এর সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ ছাত্র-শিক্ষক ও তাদের অবদানকে অস্বীকার করারও সুযোগ নেই। কারণ এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পড়–য়াদের মাধ্যমে জাতি বিভিন্ন সময় দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে রক্ষা পেয়েছে। এদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় জাতির ক্রান্তিকালে। এদের ঢেলে দেওয়া রক্তে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। ব্রিটিশ বেনিয়ারা এ উপমহাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল এদের ত্যাগ-তিতিক্ষায়। তারাই হাসিমুখে বরণ করেছিল ফাঁসির কাষ্ঠ। আযাদি আন্দোলনের বাকে বাকে নেতৃত্ব দিয়েছিল এরাই।বালাকোট, শামেলি, বাঁশের কেল্লা, সিপাহি বিপ্লব, ফরায়েজি আন্দেলন কোথায় নেই এরা? এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সংশ্লিষ্টরা জাগতিক মোহমুক্ত থেকে চারিত্রিক উৎকর্ষতা অর্জনের মাধ্যমে জাতির তরে স্বর্বস্ব বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ফলে সাধারণ জনতার কাছে এরা শ্রদ্ধার পাত্র। সমাজে রয়েছে এদের অসম্ভব প্রভাব। এ সবের পেছনে মূল ভূমিকা রয়েছে এই শিক্ষাব্যবস্থার। কওমি শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, যথাযথভাবে সঠিকভাবে পাঠদান হলে কুরআন হাদিস তথা দ্বীনের সকল শাখায় যোগ্য ব্যক্তি গড়ে ওঠার সাথে সাথে একজন চরিত্রবান ব্যক্তি হিসেবেও বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক।
অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এ নিয়েই মানব জীবন। এ তিন কালের মধ্যেই সবকিছু আবর্তিত। যারা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের ওপর সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি রেখে ভবিষ্যতের জন্যে সুচিন্তিত,সুপরিকল্পিত, সুবিন্যস্ত এবং সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারাই ইতিহাস সৃষ্টি করে; টিকে থাকে যুগ থেকে যুগান্তরে। এরাই হয় অন্যদের চলার পথের ধ্র“বতারা; দিক নির্দেশক।তাদের ইতিহাস আলোচিত হয় কাল থেকে কালান্তরে। তারা আন্দোলিত করে মানবতাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী। কিন্তু যারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়-তারা সময়ের ঘূর্ণাবর্তে, কালের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। তারা বিলীন হতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় না। ইতিহাসের আস্থাকুঁড়ে নিক্ষেপিত হতে বেশি কিছুর আয়োজন পড়ে না।
তাইতো দেখা যায়, কোন কোন সভ্যতা শতাব্দীর পর শতাব্দী আপন ঔজ্জ্বল্য প্রদর্শন করে চলছে। তার প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে। তা গ্রহণ করছে। এতেই খুঁজে নিচ্ছে আপন ঠিকানা। আবার কোনো কোনো সভ্যতা দেখা যায়- ঝড়ের বেগে এসে আবার বাদলের ন্যায় চলে গেছে। যেন বর্ষার বানের পানি।
সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। একটি জাতির উন্নতি-অবনতি, অগ্রগতি-পশ্চাদ্ভবতা, উত্থান-পতন, প্রভাব-প্রতিপত্তি এসব কিছু নির্ভর করে তার শিক্ষার ওপর। যে জাতি শিক্ষার ক্ষেত্রে যত অগ্রগামী তারা সর্বদিক দিয়ে মাথা উঁচু করে থাকে। আর শিক্ষার মান নির্ভর করে শিক্ষা কারিকুলামের ওপর। যে জাতির শিক্ষা কারিকুলাম যত উন্নত, যুৎসই, সময়ের চাহিদার সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ। সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সাধারণ মানুষের মন-মানসিকতার দিক বিবেচনা করে তৈরি; তারাই শিক্ষা দ্বারা উপকৃত হয়। এ ধরনের শিক্ষার মাধ্যমেই যোগ্য লোক সৃষ্টি হয়। বেরিয়ে আসে জাতির বিবেক, সমাজ হিতৈষী,জ্ঞানতাপস ব্যক্তিত্ব। যাদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হয় সঠিক পথে। সমাজ পায় আপন লক্ষ্যপানে পৌঁছার দিশা। এজন্যেই দেখা যায় সময়ের সাথে সাথে দুনিয়ার তাবত জাতি আপন শিক্ষাক্রমকে পরিবর্তন করে, পরিমার্জন করে, সংযোজন-বিয়োজনের ধারা অব্যাহত রাখে। আর না রেখে উপায়ই বা কি? আমরা নিজেরাই তো আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে সময়ের গতির সাথে কত সব পরিবর্তন করি।যেটা কিছু দিন পূর্বে থাকে আমাদের কাছে আঁকড়ে ধরার বিষয়, কিছু দিন পর চাহিদা, মন মানসিকতা ও পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে তাই হয় পরিত্যাজ্য। নতুনের আগমন ও পুরাতনের গমনই হচ্ছেদুনিয়ার সাধারণ রীতি। এর মধ্যেই আমরা আবর্তিত। তাই বলে পুরাতন সব সময়ই পরিত্যাজ্য,অপ্রয়োজনীয় তা কিন্তু নয়। আজ যেটাকে বিয়োগের খাতায় নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা যে কোনদিনই উপকারী ছিল না- তা কিন্তু নয়। এটাকে সর্বৈব সমালোচনা করার সুযোগ নেই; বরং একথা স্বীকার করতে হবে যে, তৎকালে এটাই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। এটাই ছিল যোগ্য লোক তৈরির মাধ্যম। এটাই ছিল সময়ের চাহিদা। তাই যেমন পুরাতনের সমালোচনা করা যাবে না, তেমনি নতুনকেও অস্বীকার করার জো নেই; বরং নতুন ও পুরাতনের সুসমন্বয় ঘটিয়ে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়াস চালাতে হবে। তবে‘সমন্বয়’ শব্দটি উচ্চারণ করা যত সহজ বাস্তবে প্রতিফলিত করা ততো কঠিন। বলতে গেলে দুর্গম গিরি কান্তার মরু ও কন্টকাকীর্ণ পিচ্ছিল পথ মাড়ানোর চাইতেও অনেক অনেক কষ্টকর ও দুঃসাধ্য। তবে এ সমন্বয়ে যারা যত বেশি পারদর্শিতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করেছে, তারা ততো সফল, ততো অগ্রগামী।তারাই নেতৃত্বের আসনে সমাসীন। তারাই পথ নির্দেশকের পদে অধিষ্ঠিত। তারাই হয়ে থাকে অনুসরণীয়-অনুকরণীয় এবং সর্বক্ষেত্রে বরণীয়।
মোটকথা, যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে শিক্ষাক্রমে সংস্কার সাধন সময়ের অপরিহার্য দাবি। তাই এ সংস্কার সাধনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো যেমন অনুচিত, তেমনি সংস্কারের নামে যথেচ্ছা হস্তক্ষেপ ও অনভিপ্রেত; বরং সর্বক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বনই কাম্য।
আমাদের এ উপমহাদেশে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসার সাহাবায়ে কেরামের যুগেই সূচিত হয়। কারণ, দেখা যায় হিজরি ২৩ সনেই আরবরা সিন্ধুতে আক্রমণ পরিচালনা করে সাহাবায়ে কেরামের আমলে; যদিও সার্বিক ও চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল তাবেঈনদের কালে। তবে অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ উপমহাদেশ প্রাক ইসলামি যুগে অনেক অনেক অগ্রগামী ছিল। এ অঞ্চল পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার তুলনায় মোটেই পিছিয়ে ছিল না। বরং বলতে গেলে অন্যান্য জাতির মতো এদেরও সম্মানজনক অবস্থান ছিল। তেমনি ইসলাম পরবর্তী সময়ে এতদঞ্চলের মহামনীষীরা আপন আপনকাননে সুরভিত ফুল ফোটাতে কার্পণ্য করেননি। ভ্রমরের স্বল্পতাও কখনো ছিল না। এসব বাগানের ফুটন্ত গোলাপসমূহ আপন সৌরভ ছড়িয়ে দিতে যেমন ছিলেন উদগ্রীব, তেমনি তাদের মাতোয়ারাকারী সুগন্ধি গ্রহণেও সব সময় একদল লোক আগ্রহী ছিল।