সিরাজী এম আর মোস্তাক::
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের ইতিহাস বড় গৌরবের। প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা ম্লান করে দিয়েছে, সে গৌরবকে। এটি শুধু অবৈধ নয়, কলঙ্ক ও বৈষম্যের বিষয় বটে। পৃথিবীর কোথাও এমন মুক্তিযোদ্ধা কোটা নেই। সকল দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়, কিন্তু কোটা পালন করা হয়না। তারা মনে করে, স্বাধীনতা কারো একার নয়। এটি সবার। স্বাধীনতা কতিপয় সম্মুখ যোদ্ধার নয়। শহীদ, আহত, বন্দি ও শরণার্থী নির্বিশেষে কষ্টভোগী সকল জনতার। এদের কতিপয়কে তালিকাভুক্ত করলে, অন্যদের অবমাননা করা হয়। কাউকে কোটাভুক্ত করলে, অন্যকে বৈষম্য করা হয়। এটি যুদ্ধনীতি পরিপন্থি। বাংলাদেশে উক্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা এমন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে, যেন ইংরেজদের শোষণও হার মেনেছে।
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ, বন্দী, আত্মত্যাগী বা শরণার্থী বিশেষায়িত ছিলনা। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুসারে দেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত ছিল। একজন আত্মত্যাগী ও বন্দী যোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিজেও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়েছিলেন। এভাবে জাতীয় চার নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়েছিলেন। তারা কোন খেতাব নেননি। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধনীতি অনুসারে মাত্র ৬৭৬ জন যোদ্ধাকে খেতাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা কোটাভুক্ত করেননি। তাই বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বৈষম্য ছিলনা।
বর্তমানে উক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বহুগুণে বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অসাধু রাজনীতিবিদগণ নিজেদের স্বার্থে ৬৭৬ জন সহ আরো প্রায় দুই লাখ ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা এবং একচল্লিশ নারীকে বীরাঙ্গনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। তাদের জন্য অবৈধ কোটানীতি করেছে। তাদের সন্তান-সন্ততি এমনকি নাতি-নাতনিদেরকেও কোটা সুবিধার আওতাভুক্ত করেছে। তাদেরকে রাষ্ট্রীয় সম্পদে অবৈধ প্রাধান্য দিয়েছে। নিয়ম করেছে, স্বাধীনতার পর এযাবতকালে সকল ক্ষেত্রে ত্রিশভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পরিপালনে যতটুকু ভঙ্গ হয়েছে, তা পূরণে। তাই বিগত কয়েক বছর যাবত শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটাতেই নিয়োগ হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পালন হয়েছে এবং হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগেও কোটার মাধ্যমে কম যোগ্যরা নিয়োগ পেয়েছে। এতে জাতি মেধাশুণ্য হয়ে পড়েছে। যুবসমাজ অজ্ঞতার সাগরে নিপতিত হয়েছে। অজ্ঞ সমাজে যেসব অন্যায়-অনাচার ও কুসংস্কার থাকে, দেশে তাই শুরু হয়েছে। দেশের বিচার, প্রশাসনসহ সকল বিভাগে মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগীদের দৌরাত্মে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশে মারাত্মক বৈষম্য ও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জল ইতিহাস প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদানকারী ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যা প্রসঙ্গে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। সুতরাং প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকলে, আমাদের অস্তিত্বও হারিয়ে যাবে।
যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ৬৭৬ থেকে দুই লাখ হয়েছে এবং নানা সুবিধাসহ কোটা চালু হয়েছে, তা সহজে বাতিল করার নয়। এতে লাখ লাখ মানুষের স্বার্থ জড়িত। একটি মন্ত্রণালয়ও রয়েছে। তাদের ইচ্ছায় দেশের সরকারও পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরলে, তারা কখনো বাড়াবাড়ি করতে পারবেনা। কেননা মুক্তিযোদ্ধা কোটার সঠিক কোনো ভিত্তি নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণদানকারী ত্রিশ লাখ শহীদের বিপরীতে দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা আদৌ সঠিক নয়। পৃথিবীর কোথাও শহীদ ও যোদ্ধা সংখ্যায় এতো ব্যবধান নেই। যে কোনো যুদ্ধে শহীদের চেয়ে যোদ্ধা সংখ্যা বেশী হয়। যোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ, আহত, বন্দী ও গাজী সবই থাকে। যোদ্ধাদের সকলেই শহীদ হয়না। তাদের একাংশ মাত্র শহীদ হয়। সকল শহীদই এক একজন যোদ্ধা বিবেচিত হয়। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও তাই হয়েছিল। সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছিল। তাই প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় শহীদদের মর্যাদা মোটেও কম হবার কথা নয়। দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদের চেয়ে শহীদদের সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদের প্রাপ্যও কম থাকার নয়। সে হিসেবে, এতোদিন ত্রিশ লাখ শহীদের পরিবারকে বঞ্চিত করে যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধা দেয়া হয়েছে, তা অবৈধ ছিল। অতএব, প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করলে, কারো প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই। যারা বাড়াবাড়ি করবে, জনগণই তাদের সমুচিত শিক্ষা দেবে।
এরপরও কি মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে? আসলে, অতি দ্রুত এ কোটা বাতিল করা উচিত। বঙ্গবন্ধুসহ ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকেই মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া উচিত। ত্রিশ লাখ শহীদ, সকল বন্দী ও শরণার্থীদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করা উচিত। দেশের ষোলকোটি নাগরিককে ‘৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। অতএব, বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দেশবাসীর কাছে আমার সশ্রদ্ধ জিজ্ঞাসা, বর্তমানে প্রচলিত অবৈধ, বৈষম্যমূলক ও বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর কতকাল চলবে?