ইমরান আহমাদ::
১.
★ পঞ্চম শতকের স্পেন: ভিসিগোথ শাসনের নির্যাতনে পিষ্ট প্রজাকূলঃ
পঞ্চম শতকের কথা।
স্পেন তখন শাসিত ছিল ভিসিগোথদের দ্বারা। ভিসিগোথদের সংক্ষেপে “গোথ” বলা হত। যাদের মূল আবাসস্থল ছিল জার্মানি। তারা ছিল আরিয়ান খৃস্টান। বেদুইন এই জাতিটি বংশ পরম্পরায় বিভিন্ন দেশ জয় করে তাতে বসতি স্থাপন করে। যেগুলির মাঝে স্পেনও ছিল একটি। স্পেনে যতদিন আরিয়ান ভিসিগোথদের শাসন ছিল, ততদিন সেখানকার পরিবেশ ছিল ইহুদী অধিবাসীদের প্রতি সহনশীল। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায়, যখন ৫৮৯ খৃস্টাব্দে স্পেনের ভিসিগোথ রাজা রেকারেড খৃস্টীয় ক্যাথলিক বিশ্বাস গ্রহণ করে। ক্যাথলিকদের ধর্ম বিশ্বাস আরিয়ানদের থেকে অনেকটাই আলাদা। যদিও দুটো গোত্রই খৃস্টান। ভিসিগোথ রাজাদের ক্যাথলিক হবার পর থেকে রাজকার্যে চার্চের প্রভাব বেড়ে যায়। সাথে সাথে ইহুদীদের জীবনযাত্রায় নেমে আসে দুঃসহ অন্ধকার। চলে নির্যাতনের স্টিমরোলার। কাটছাঁট করে দেয়া হয় তাদের ধর্ম পালনের অধিকার। নাগরিক অধিকারও হয়ে পড়ে সংকোচিত। যার ফলে প্রায় ৯০,০০০ ইহুদী ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়। স্বেচ্ছায়ই হোক; বা জোরপূর্বক। নির্যাতনের এই ধারাবাহিকতায় ৬৩৩ খৃস্টাব্দে স্পেনের সমস্ত ইহুদীদের ব্যাপটাইজড করার পরিকল্পনা হয়। পরবর্তী ভিসিগোথ শাসনে এসব বিষয়ে কিছুটা শিথিলতা এলেও; ইহুদীরা নিষ্পেষণের যাঁতাকল থেকে আর মুক্ত হয় নি। ফলশ্রুতিতে ইহুদীদের অর্থনীতিতে নেমে আসে ব্যাপক ধ্বস। কারণ, তাদের পক্ষে অন্যদের সাথে বাণিজ্য করা ছিল প্রায় অসম্ভব। এভাবেই চলতে লাগল ৭১১ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত। মুসলিম শাসনের আগ পর্যন্ত তারা ব্রাত্য-ই ছিল
২.
★ মুর মুসলিমদের স্পেন বিজয়: নিপীড়ক ভিসিগোথদের পরাজয়ঃ
৭১১ সাল। স্পেনের ভিসিগোথ রাজা তখন রডারিক। তিনি ছিলেন খুবই দাম্ভিক, অত্যাচারী। তদুপরি ছিলেন অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী।
রডারিক খুব অল্প সময়ের জন্য স্পেন শাসন করতে পেরেছিলেন। তারপরেই পরাজিত হন মুরদের হাতে।
মিশরীয় ইতিহাসবিদ ইবনে আবদুল হাকিম ভিসিগোথদের পতন প্রেক্ষাপটের যে বর্ণনা দেন, তা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে যুগ যুগ ধরে গান, কবিতা গল্পের মাধ্যমে জনপ্রিয় লোকগাঁথা কিংবদন্তী হিসেবে প্রচলিত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
“স্থানীয় স্পেনিশ নেতা জুলিয়ান তার কন্যাকে পাঠান রডারিকের দরবারে পড়াশোনার জন্যে। কিন্তু রডারিক তাকে ধর্ষণ করেন। যার ফলে জুলিয়ান ক্ষিপ্ত হয়ে মুসলিম নেতাদের অনুরোধ করেন রডারিকের পতন ঘটানোর জন্য”
উপরোল্লিখিত লোকগাঁথা মুসলিমদের মাঝে জনপ্রিয় হলেও; পশ্চিমা ধাঁচের ইতিহাসে সঙ্গত কারণেই তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। বস্তুত রডারিকের পক্ষে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। বিশুদ্ধ ধারার ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দেয়। কিন্তু শুধু এই একটি ঘটনার কারণেই রডারিক তার সমর্থন হারান নি। রডারিক তার আশপাশের নেতাদের সমর্থন হারিয়েছিলেন আরো অনেকগুলো কারণে।
রডারিকের ক্ষমতা আরোহন ছিল বিতর্কিত। রডারিকের আগে রাজা ছিলেন উইটিজা। যার উত্তরাধিকাররা ছিল স্পেনের সিংহাসনের দাবীদার। কিন্তু ক্যাথলিক চার্চের বিশপরা ভিন্ন মতাবলম্বি প্রজা পীড়ন সহ তাদের অন্যান্য অবৈধ খায়েশ চরিতার্থে উইটিজার সন্তানদের পরিবর্তে মনোনীত করে রডারিককে। যা উইটিজার বংশধরদের ক্রুদ্ধ করে তোলে। উইটিজাররা পালিয়ে জুলিয়ানের কাছে আশ্রয় নেয়। জুলিয়ান সব রকমের সাহায্যের অঙ্গিকার দিয়ে তৎকালীন আফ্রিকার উমাইয়া গভর্নর মুসা ইবনে নুসায়েরকে অনুরোধ করেন রডারিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে। তার প্রেক্ষিতে মুসা তার জেনারেল তারিক বিন জিয়াদের উপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেন।
রডারিক একদিকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার, অন্যদিকে প্রজা বৎসল না হবার জন্যে সাধারণের সমর্থন লাভে ব্যর্থ। যার কারনে তার বিপুল সৈন্যবাহিনী থাকলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছিল পরিষ্কার। অন্যদিকে মুর জাতি ভিসিগোথদের মতই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা বেদুইন জাতি, তার উপর মুসলিম হবার ফলে আরবদের সহযোগিতা প্রাপ্ত। তাই জেনারেল তারিক বিন জিয়াদ মাত্র ৭০০০ সৈন্য নিয়ে রডারিকের লক্ষাধিক সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়ে মোটামুটি অনায়াসেই বিজয়ী হন এবং স্পেন দখল করেন। এভাবেই পতন ঘটে স্পেনের সর্বশেষ ভিসিগোথ রাজা রডারিকের। গোড়াপত্তন হয় আটশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম শাসন-সভ্যতার।
৩.
★ স্পেন বিজয়ী তারিকের বিজয়ের সেই ঐতিহাসিক দিন:
৩০ এপ্রিল। ৭১১ খৃস্টাব্দ।
তারিক তার সৈন্যদের নিয়ে স্পেনে পৌছে প্রথমে একটি পাহাড়ের কোলে অবতরণ করেন। যা পরবর্তীতে “জাবাল আত্ তারিক” বা “তারিকের পাহাড়” নামে পরিচিত হয়। এই “জাবাল আত তারিক” এর বর্তমান বিকৃত রূপই হচ্ছে “জিব্রাল্টার”। অবতরণের পরপরই তিনি তার সব নৌকা জাহাজ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। (যদিও এর সত্যতা নিয়ে ইতিহাসবেত্তারা বিভক্ত) হতবুদ্ধি হয়ে একজন সেনা জানতে চাইল, “এখন আমরা কী করে ফিরব?” তারিক শান্তভাবে জবাব দিলেন, “ফিরে যাবার জন্য তো আমরা আসিনি। হয় বিজয়, নতুবা শাহাদাতের মৃত্যু।”
সৈন্যদের উদ্দেশ্যে দেয়া তারেকের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু অংশ ছিল নিম্নরূপ:
“হে আমার যোদ্ধারা। কোথায় তোমরা পালাবে? তোমাদের পেছনে সাগর, সামনে শত্রু। তোমাদের আছে কেবল সাহস এবং ধী শক্তি। মনে রেখো, এদেশে তোমরা সেই এতিমদের চেয়েও হতভাগা যাদের লোভী মালিকদের সাথে টেবিলে বসতে হয়। তোমাদের সামনে শত্রু, যাদের সংখ্যা অগণ্য। কিন্তু তোমাদের শুধু তলোয়ার ব্যতিরেকে কিছুই নেই। তোমারা বেঁচে থাকতে পারবে; যদি শত্রুর হাত থেকে নিজেদের জীবনকে ছিনিয়ে আনতে পার। ভেবোনা আমি তোমাদের সাথে থাকবো না। আমিই সবার সামনে থাকব, এবং আমার বাঁচার সম্ভাবনাই সবচেয়ে ক্ষীণ।”
এই ভাষণে উজ্জীবিত হয় তারেকের সেনাদল। মুষ্টিমেয় মুসলিম সেনার প্রাণপণ যুদ্ধের ফলে স্পেনের মাটিতে রডারিকের অগণিত সেনাদলকে পরাজিত করে স্পেনের বুকে তারা স্থাপন করে মুরদের রাজ্য। মুরদের কাছে ভিসিগোথ সর্বশেষ রাজা রডারিকের পতন ঘটে। স্পেনের নামকরণ হয় “আন্দালুসিয়া”।
৪.
★মুর জাতি আসলে কারা?
ক্লাসিক্যাল গ্রীক এবং রোমান ইতিহাসবিদগণ কৃষ্ণ বর্ণের পূর্ব আফ্রিকার যাযাবর জাতিকে “বারবার” নামে অভিহিত করেছেন। “বারবার” থেকে বাংলায় “বর্বর” এবং ইংরেজী “barbaric” শব্দ গুলো এসেছে, যা এই জাতির যুদ্ধপ্রিয়তাকে প্রকাশ করে। বারবারদের একটি অংশকে “মুর” বলেও সম্বোধন করা হয়, যারা মিশর থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এরা উত্তর আফ্রিকাতেও প্রভাবশালী হয়। গ্রীক “মোরস” শব্দের অর্থ কালো, যেখান থেকে “মুর” শব্দটি এসেছে। মুর নামকরণের প্রকৃত কারণ তাদের কৃষ্ণকায় গাত্রবর্ণ, যা এদেরকে ইউরোপিয়ানদের থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টে্র অধিকারী করেছিল। পরবর্তীকালে ইউরোপিয়ানরা সকল স্প্যানিশ মুসলমানকেই মুর সম্বোধন করতো। আর এ কারণেই মুসলিম ইতিহাসবিদগণ দাবী করেন, “মুর” নামটি আসলে হেয় অর্থে প্রচলন করা হয়েছে। সে যাই হোক, স্পেন বিজয়ী জাতিটিকে বর্ণনার জন্যে “মুর” বর্তমানে প্রচলিত একটি শব্দ। বৃক্ষের পরিচয় যেমন করে থাকে ফলে, তেমনি মুররাও বিজ্ঞান সভ্যতায় তাদের অবদানের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে রেখে গেছে গৌরবময় চিহ্ন। ফলে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ ডিজিটাল যুগেও মুর সভ্যতা আজ অবাক এক বিস্ময়।
৫.
★ মুর সভ্যতার সৃজনী বৈশিষ্ট্য:
মুর শাসিত আন্দালুসিয়াতে ক্ষমতায় ছিল উমাইয়া রাজবংশ। এ সময়টাতে কর্ডোভা হয়ে উঠে ইউরোপের সবচে’ মনোরম শহর। জ্ঞান, শিল্প, কৃষ্টি, সভ্যতা, আধুনিকতা, পরিচ্ছন্নতা; এককথায় সবমিলিয়ে সেটি ছিল তিলোত্তমা নগরী। আধুনিক লন্ডন-প্যারিস সে তূলনায় নস্যিই। শিল্পোন্নত গ্রানাডা, সেভিল, মালাগা, টলেডো, ভ্যলেন্সিয়া না হয় বাদই দিলাম। এক কর্ডোভাতেই বিভিন্ন প্রকারের প্রায় ৫,০০০ মিল কারখানা ছিল। যেখানে সারা ইউরোপে তখন একটিও ছিল না। ইউরোপের ৯৯ ভাগ লোক যেখানে ছিল অশিক্ষিত; সেখানে কর্ডোভাতে ছিল ৮০০ পাবলিক স্কুল। ৭০ টি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। তৎকালীন বুনো ইউরোপে গোসলখানাকে হারাম বলে গণ্য করা হত, অথচ কর্ডোভাতে ছিল ৯০০ পাবলিক বাথ। দশম শতকে কর্ডোভাতে ছিল ৭০০ মসজিদ, ৬০০০০ প্রাসাদ, ৭০ টি সুবিশাল গণ লাইব্রেরী; যার সবচে’ বড়টিতে ছিল ৬,০০,০০০ বই। অন্যদিকে সে সময়কার খৃস্টীয় ইউরোপের সবচে’ বড় লাইব্রেরীতে ৪০০ এর বেশী ম্যানুস্ক্রীপ্ট ছিল না। ১৪০০ শতকের শেষে ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসে ছিল মাত্র ২০০০ টি বই। যেখানে তৎকালীন আন্দালুসিয়ায় প্রতি বছর ৬০,০০০ পুস্তিকা, কবিতা, সংকলন ইত্যাদি প্রকাশিত হত; সেখানে আধুনিক স্পেনেই এখন প্রতি বছর মাত্র ৪৬৩৩০ বই প্রকাশ করে থাকে।
তাছাড়া বিশ্বখ্যাত আলহামরা, আলকাজার, রোমানব্রীজ আর বিস্ময়কর কর্ডোভা জামে মসজিদের অনবদ্য কীর্তি তো বিশ্ববিশ্রুতই।
৬.
★ মুরদের শেষের শুরু:
১৬ ই জুলাই। ১২১২ সাল।
স্পেনের ভবিষ্যত গতিপথ নির্ণয়ে এই দিনটি ছিল ব্যাপক গুরুত্ববহ। ইতিহাসেরই টার্নিং পয়েন্ট। পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো সব একত্রিত হয়ে মুর রাজ্যের সাথে চরম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে মুরের অধিপতি সুলতান নাসিরের পতন ঘটায়। তার আগের বছর, অর্থ্যাৎ ১২১১ সালে মুর অধিপতি সুলতান নাসির পার্শ্ববর্তী খৃস্টান রাজ্যে এক হামলা চালান। যার প্রতিশোধ নিতে প্রতিপক্ষের সবাই ঐক্যবদ্ধ হন। পোপ ডাক দেন ক্রুসেডের। মুর সুলতানের পক্ষে ছিল আফ্রিকান বেশ কিছু অংশ: মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, সেনেগাল, মৌরিতানিয়া। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ আলফানসুদের পক্ষে ছিল পর্তুগাল ও স্পেনের উত্তরাংশের সমর্থন। এই বেদনাদায়ক যুদ্ধের ময়দান সিক্ত হয়েছিল মুসলিমদের হাটুসম রক্তের মাধ্যমে। ১২১২ সালে আলফানসু এবং তার সহযোদ্ধাদের কাছে পরাজয়ের পরে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি মুর রাজ্য। এর পরের ইতিহাস পরাজয়ের ইতিহাস। একের পর এক মুর মুসলিম অধ্যুষিত শহরগুলোর পতন ঘটতে থাকে। ১২৩৬ সালে বৃহত্তম রাজধানী শহর কর্ডোভার দখল নেন কাস্টিলের রাজা ফার্ডিন্যান্ড। ফার্ডিন্যান্ড সেভিল দখল করেন ১২৪৮ সালে এবং জেইন দখল করেন ১২৪৬ সালে।
৭.
★ অবশেষে ঝাড়ে বংশে উচ্ছেদ:
২রা জানুয়ারি। ১৪৯২ সাল।
পরাজয়ের ধারায় সর্বশেষ ঘটনাটি এ সময়ই ঘটে। গ্রানাডার শাসক আবু আবদুল্লাহ, যিনি ববদিল নামে স্পেনে পরিচিত,
ফার্ডনান্ড ও ইসাবেলার কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন। সেই সাথে আনুষ্ঠানিক ভাবে অবসান ঘটে মুর সাম্রাজ্যের। সমাধিস্থ হয় আটশ’ বছরের সোনালী ইতিহাস।
আমেরিকা বিজয়ী ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছিলেন এই আত্ম সমর্পণ অনুষ্ঠানে। তিনি লেখেন, “ইয়োর হাইনেস কর্তৃক মুরদের কাছ থেকে গ্রানাডা দখলের পর আমি শহরের দুর্গ আল হামরার টাওয়ারে রাজকীয় ব্যানার দেখেছি।”
ববদিলের এই আত্ম সমর্পন ছিল শর্তাধীন, বা চুক্তি ভিত্তিক যা “ক্যাপিচুলেশন অব গ্রানাডা” নামে পরিচিত। ১৪৯১ সালের ২৫ শে নভেম্বরের এই
চুক্তিতে ৬৭ টি ধারা অন্তর্ভূক্তি হয়, যাতে গ্রানাডার মুসলিম ও অন্যান্য অধিবাসীদের ধর্মীয়, ভাষাগত, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার সুরক্ষিত রাখা হয়।
কিন্তু হায়! এর পরবর্তী ইতিহাস ছিল বড়ই করুণ। কুখ্যাত আল হামরা ডিক্রির মাধ্যমে ইহুদীদেরকে চার মাসের মধ্যে স্পেন ত্যাগে বাধ্য করেন ইসাবেলা ও ফার্ডিনান্ড। এই আল হামরা ডিক্রি শেষ পর্যন্ত ১৯৬৮ সালে ভ্যাটিকান কর্তৃক বাতিল হয়। চুক্তি শর্ত বাস্তবায়ন না করে উল্টো ১৫০১ সালের মধ্যে মুসলিমদের দুটো চয়েস দেয়া হয় : ব্যাপটাইজ, অথবা বহিষ্কার। নির্মম গণহত্যার পর অবশিষ্টদের প্রায় সবাই ধর্মান্তরিত হল, যারা মরিস্কো নামে পরিচিত। বাকিরা হল দেশান্তর। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মরিস্কোদের বিশ্বাসঘাতকতা ধরা পড়ল যে, এদের অনেকে উপর দিয়ে খৃস্টান হলেও ভেতরে ভেতরে ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত। পরবর্তীতে মরিস্কোদেরকেও স্পেন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
৮.
★ মুরদের এই ভূমিধ্বস পতনের কারণ কী?
একজন রক্ষণশীল হিসেবে বলতেই হবে, ইসলাম থেকে দূরে চলে যাওয়াই এর আসল কারণ। তারিক তো স্পেনে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু এরপর সেখানকার রাজা বাদশারা যেভাবে বিলাসিতা, পাপাচারে মত্ত হয়েছেন, তাতে আটশ’ বছর টিকে থাকাটাই মনে হবে বিস্ময়ের। আর আপনি যদি প্রগতিশীল হন, তাহলে এই টিপিক্যাল কথা শুনে বিরক্ত লাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু রক্ষনশীলদের এরকম মনোভাব একেবারে অযৌক্তিক নয়। মুরদের পতনের মূল কারণ ছিল জাতীয় চেতনার বিলুপ্তি। একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জাতীয় চেতনা আঠার মতো কাজ করে। আন্দালুসিয়ার পরিবেশটি ছিল কিছুটা ভিন্নতর। এখানে ছিল আরব, অনারব মুর সহ বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মিশ্রণ। যার ফলে ভাষা ও সংস্কৃতির সমন্বয়হীনতায় জাতীয় চেতনা ছিল দুর্বল গাথুনিতে গাথা। এদের ধর্ম ছিল এক, কিন্তু ফেরকাগত কোন্দলে সে মূল্যবোধ ছিল উপেক্ষিত। যদিও রাসুল সা. অনারবের উপর আরবের কিংবা কালোর উপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই বলে ঘোষণা দিয়েছেন, বাস্তবক্ষেত্রে এই অধিবাসীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল। এছাড়া কেন্দ্রে ছিল আব্বাসীয় শাসন, যেখানে আন্দালুসিয়ায় চলছিল উমাইয়া শাসন। কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বারোয়ারী সংস্কৃতির আন্দালুসিয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী, যারা পাশের খৃস্টান শক্তিকে মোকাবেলা করতে সক্ষম। কিন্তু উমাইয়া শাসকরা শিল্প সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের উন্নতির দিকে খেয়াল রাখলেও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি মনোযোগী ছিলেন না। তাছাড়া গাদ্দারদের মাত্রাহীন উৎপাত সহ সব মিলিয়ে মুরদের পতন হয়ে উঠে অবশ্যম্ভাবী।
৯.
★ স্পেনের ক্ষমা প্রার্থনা:
স্পেনের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কুখ্যাত এই ম্যাসাকার, বহিষ্কার ও গণব্যাপটাইজের জন্য মুসলমানদের কাছে কখনো ক্ষমা না চাইলেও; রাজা জুয়ান কার্লোস ইতোমধ্যে শুধু ইহুদীদের কাছেই দু’বার ক্ষমা চেয়েছেন। যদিও মুসলিমদের তুলনায় তাদের ক্ষতি এক শতাংশও ছিলনা। একবার ১৯৯২ সালে ইসরাইলের সংসদে এবং দ্বিতীয়টি টলেডোর সিনাগগে। কিন্তু মুসলিমদের দাবী সত্ত্বেও তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন নি। যদিও তিন মিলিয়ন মুসলিমকে বহিষ্কার করা হয়, যারা পার্শ্ববর্তী মরক্কোতে আশ্রয় নেয়। আর সমপরিমাণকে গণহত্যায় নিঃশেষ করা হয়। আর বাকিদের ললাটে মরিস্কোর লাজ তিলক এঁটে দেয়া হয়। ইবনে হাকিম নামে একজন মরোক্কান বলেন, “আমার পরিবারে ১৪টি স্পানিশ নাম রয়েছে এবং আমরা স্প্যানিশ বলি। হারানো সে হোমল্যান্ডের জন্য আমরা এখনও ভালবাসা ধরে রেখেছি। আমি আশা করি না এত বছর পরে সে বাড়ী ও জমি ফেরত পাব। তবে আমাদের নৈতিক শক্তির বিজয় দেখতে চাই।” ইতিহাসবিদ গিবসন এ প্রসংগে লিখেছেন, “মুসলিমদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে সাড়া দেয়া প্রয়োজন। গ্রানাডার মুসলিমরা কি সেখানকার ইহুদীদের চেয়ে হীনতর?”